ভারত-পকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে ওঠার ঘটনাবলি ব্যাপক ও তাৎপর্যময়। এটা ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজ বা রাষ্ট্র এবং আরো বহুবিধ বিষয়ের অধীনে পাঠ এবং পুনর্পাঠযোগ্য। সেকালে আসাম রাজ্যের সিলেট অঞ্চল একটি পৃথক ব্যবস্থায় অর্থাৎ গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানভুক্ত হয়। এই যে গণভোটের মাধ্যমে আসামের সিলেট জেলার কয়েকটা থানা যুক্ত করা হয় ভারতের সঙ্গে, কয়েকটাকে যুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে, তার সন্ধি-দুরভিসন্ধি এবং বিপর্যয়ের বিষয়টি নিশ্চয় স্বতন্ত্রভাবে পাঠের দাবি রাখে। একথা আগেই বলে নেওয়া ভালো যে সাতচল্লিশের দেশভাগ সুরমা-বরাক উপত্যকার জনজীবনে কী প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং এ নিয়ে কোনো সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে কি না, আমি অনেক দিন থেকেই তা খোঁজ করছিলাম। প্রায় বছর খানেক আগে অনেকটা মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতোই একটি গ্রন্থ আমার হাতে এল। কারণ ঠিক এই বিষয়েই যে একটি উপন্যাসগ্রন্থ পেয়ে যাবো এরকমটি ভাবতে পারিনি। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈদের ছুটিতে ভারতের আসাম প্রদেশের শিলচরে ভ্রমণকালেই বইটির সাক্ষাৎ পাই। সিলেটের অনেক অঞ্চলের মানুষের নিকট ভারতে যাওয়া মানে ‘হ-পারো যাওয়া’। সুরমা নদী ভারত-বাংলাদেশের যে অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করে অগ্রসর হয়েছে, তার দুপারের লোকজনের নিকট ভারত-বাংলাদেশ গমনাগমন মানে ‘হ-পারো যাওয়া’। অর্থাৎ সুরমা নদীর এপার-ওপার। এর মধ্যে দুই দেশের অস্তিত্ব ছিল না; ছিল নদী অতিক্রমের বিষয়। রেডক্লিফ মহাশয় সাতচল্লিশে দুদেশের সীমানা চিহ্নায়নের মাধ্যমে মাঝখানে এক দুস্তর পারাবার তৈরি করেন। পেছনে পড়ে থাকে হৃদয়চেরা দীর্ঘশ্বাসেরা। এই বিভক্তির ফলে দুপারের জনজীবনে জান-মাল ও সংস্কৃতির যে ক্ষরণ হয়, সেটিরই অনায়াস রূপান্তর ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ নামক গ্রন্থটি। সত্তরোর্ধ ইমাদ উদ্দিন বুলবুল তাঁর এই বইটি আমার হাতে তুলে দেন। লেখক গল্পবাজ। তাঁর গল্প বলার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। সমগ্র উপন্যাসের কাহিনিটা তিনি দাদু-নাতির গল্পের ভেতর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন। ইতিহাসের জটিল সব ঘটনা যা সাধারণ মানুষের জীবনকে বিড়ম্বিত করেছিল সেটি সাবলীলভাবেই বলে গিয়েছেন দাদা-নাতির গল্পে।
‘সুরমা নদীর চোখে জল’ একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব জেলা সিলেটের ইতিহাস ও সমাজজীবনই এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। ভৌগোলিক দিক থেকে উপন্যাসটির কাহিনি বর্তমান ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিব্যাপ্ত। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তখন সিলেট অঞ্চলের জনগণ এক ঐতিহাসিক কাণ্ড করে বসেন। পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে এখানকার জনসাধারণের মধ্যে দু’রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পাকিস্তান বা ভারতভুক্তির প্রশ্নে এখানে গণআন্দোলন সূচিত হয় — কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জমিয়ত-এ-উলাম-এ হিন্দ প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও তাদের কর্মীরা নিয়ে নিজ নিজ পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলে। বেনিয়া শাসকদল তখন রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করে। ‘ঘর’ ও ‘কুড়াল’ মার্কায় ভোটাভুটি হয়। মুসলিম লীগের মার্কা ছিল ‘কুড়াল’, কংগ্রেসের ছিল ‘ঘর’। মুসলিমলীগ পাকিস্তানের পক্ষে আর কংগ্রেস ছিল ভারতভুক্তির পক্ষে। মোট ভোটার ছিল ৫ লক্ষ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ’৪৭-এর ৬ ও ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় গণভোট; পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে ভোট দেয় ২ লক্ষ ৩৯ হাজার ৬১৯ জন। অপরপক্ষে ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট পড়ে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪১টি। ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি পড়ে পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে। এরই ভিত্তিতে সিলেট অঞ্চল পাকিস্তানভুক্ত হয়; কিন্তু সিলেটের সবটা জায়গা পাকিস্তান পায় না। তৎকালীন সিলেট ছিল বর্তমান হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও করিমগঞ্জ (বর্তমানে ভারতের একটি জেলা) সাবডিভিশন নিয়ে একটি জেলা। ভাগাভাগির সময় রেডক্লিফ একপ্রকার চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েই সিলেটের অন্তর্গত করিমগঞ্জ সাবডিভিশনের সাড়ে তিন থানা ভারতভুক্ত করে সীমানা চিহ্নিত করেন। ভগ্ন এবং খণ্ডিত ভূভাগ নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলের মানুষের মন কান্দে। ফলে সীমান্তের দুদিকের মানুষজন শুধু স্থাবর সম্পদই হারায় না, তাদের রক্তের সম্পর্কগুলোও ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও শাসন ব্যবস্থার অধীন হয়। এই যে দেহ ও আত্মার বিভক্তি ও মর্মযন্ত্রণা এটিই ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ উপন্যাসের মূল উপজীব্য। বিষয়টি দুদেশের জনগণের জন্যই খণ্ডিত হৃদয় ও দেশ-প্রান্তরের বিয়োগান্তক কাহিনি। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল ভারতের নাগরিক হলে কী হবে, তিনি মূলত সিলেটের জনজীবনে দেশভাগ ও লোকজীবনের উত্তরাধিকার বহন করেন। কারণ তিনি এবং তাঁর পাত্রপাত্রীরা যে অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন সেটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলারই জীবনধারা, ভূ-প্রকৃতি এবং সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চৈতন্যের ফসল।
‘সুরমা নদীর চোখে জল’-এর কাহিনি বর্তমানে দুই দেশব্যাপী বিস্তৃত। এর আয়তন বলতে গেলে মহাকাব্যিক। অর্থাৎ সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং এ-সময়কালে ভারত জুড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে এ-উপন্যাসের আপাত নায়ক জামানের জন্ম হয়। জন্মকালটা তার মা স্মরণ করেন ‘রায়টের বছর’ বলে। সে-বছর যেদিন ‘শাকিলার স্বামী রহমান মিয়া মোকদ্দমার জন্য কাটিগড়া গিয়েছিলেন। গাড়ি থেকে নামার পরই দাঙ্গার কবলে পড়েন’ সেদিনই জামানের জন্ম। এভাবে জামানের জন্মকাল স্মরণের মধ্যে একটা ঘটনাগত ক্ষতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন লেখক। উপন্যাসে তিন পুরুষের কাহিনি বিবৃত করেন বুলবুল — দুই দেশকালের পটভূমিতে তিনি দাদা-নাতির গল্পের মধ্য দিয়েই পাঠককে দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টি, পাকভারত যুদ্ধ এসবের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি বিকশিত করেন। আর অবধারিতভাবেই উঠে আসে একই ভাষা, লোকাচার ও চারিত্র্যগুণ সত্ত্বেও সিলেটের ভূখণ্ড ও জনজীবনের বিচ্ছিন্নতার রক্তক্ষরণ। উপন্যাসের নায়ক জামান তার ঠাকুরদার নিকট থেকেই দেশভাগের বয়ান শোনে —
‘পাকিস্তানে যাইমু না ভাতর মাড় খাইমু না।’
অপরপক্ষ শ্লোগান দেয় —
‘কাছাড়েতে যাইমু না বেঙের ছালন খাইমু না।’
রেফারেন্ডামের সময়ের স্লোগান এটি। আরো অনেক রকম স্লোগানে তখন মুখরিত হয়েছিল সিলেট। জামানের দাদা সাজিদ মিয়া তখন যুবক। সাজিদ মিয়াই ‘সুরমা নদীর চোখের জল’-এর প্রথমখণ্ডের নায়ক। কিন্তু এ উপন্যাসের একজন প্রকৃত নায়ক আছে, সে হচ্ছে শিশু জামান — এই জামানই পরবর্তীকালে নায়ক হয়ে ওঠে। সে তার ঠাকুরদা সাজিদ মিয়ার নিকট গল্প শুনে শুনে বড় হয়। গল্প শোনার মধ্য দিয়ে সে শুধু লোকালয়, গ্রামীণ জীবনের কথাই জানে না, যৌথ পরিবারের মমতারসে সিক্ত হয় এবং দাদাজানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় তার মন ভরে ওঠে। তাই যখন হেমন্তে ধান তোলার সময় সাজিদ মিয়া উতল বা ধানখলায় রাত্রিযাপন করতে যান তীব্র শীতের মধ্যে, তখন সে একধরনের প্রতিবাদ করে পরিবারের জোয়ান মানুষদেরকে উতলে যাওয়ার কথা বলে। পরিণত বয়সে জামান একরাতে স্বপ্নে শকুনের রাজাকে দেখতে পায়। এতে সে আতঙ্কিত হয় অনাগত দিনগুলোতে দুর্দশা বা দুর্ভিক্ষের কথা ভেবে। কিন্তু একটা জিনিস তার ভালো লাগে। অনেক বছর পর শকুনের রাজাকে দেখতে পেয়ে তার একধরনের ভালো লাগা কাজ করে।
ওপারে উৎপন্ন বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে। এরই পললগঠিত সিলেট অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে সুরমা উপত্যকা নামে পরিচিতি পায়। দেশভাগ হয়, নদীও ভাগ হয়। এমনকি কিছু দূর পর্যন্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দুদেশের সীমানা চিহ্নিত করে অগ্রসর হয়। সুতরাং নদীর পারে পারে থাকে মিলিটারি, তাদের শ্যেনদৃষ্টি থাকে নদীর দুপারের মানুষের দিকে। মিলিটারিদের তাক করা বন্দুক মানুষের যাপিত জীবনকে শুধু ক্ষতবিক্ষত করে না, আক্ষরিক অর্থেই বুলেটবিদ্ধ করে। উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় শক্তি লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতিকে চিত্রিত করতে কোনো কৃত্রিম ভাষার ব্যবহার করেননি, সিলেটি ভাষার বাকবিন্যাস, শব্দবন্ধ ও কথ্যরীতিতেই কথোপকথন সম্পন্ন করেছেন। তার পাত্রপাত্রীরা উচ্চশিক্ষিত তো নয়ই, অনেকের অক্ষরজ্ঞানও নেই — তারা কথা বলেছে সিলেটি উপভাষায়। এজন্য উপন্যাসটি সিলেটের ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রত্নসম্পদ বটে। দুই দেশে পরিণত হওয়ার কারণে তার উপন্যাসের নায়ক জামান হারায় শৈশবে সুরমা নদীতে অবগাহনের সুযোগ, ওপারে ফুফুর বাড়ি যাতায়াতের রোমাঞ্চ এবং ফুফুর আদরের উষ্ণতা।
ভারতের করিমগঞ্জ দিয়ে বয়ে আসা বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশমাত্রই সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। দেশভাগের ফলে মানুষের ভাব, ভালোবাসা ও প্রাত্যহিক জীবনে যে সংকট তৈরি হয় তাতে পরস্পরের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। উত্তরকালে সে-রক্তই যেন প্রবাহিত হয় সুরমা ও কুশিয়ারার জলধারায়। লেখক প্রতীকী অর্থেই উপন্যাসের নাম রেখেছেন ‘সুরমা নদীর চোখে জল’, যেন মানুষের হৃদয়ের কষ্টে ভারাক্রান্ত নদীর চোখে নেমেছে জলের ধারা। নদী যেন জীবন্ত মাতৃময়ী।
তবু এটি শুধু সুরমা-বরাক উপত্যকার মানুষের ঐতিহাসিক ঘটনাবলিই প্রকাশ করে না — সমাজসংস্কৃতির এক অনবদ্য নিদর্শন নিয়ে হাজির হয় যা পাঠককে ভিন্নতর জগতে নিয়ে যায়। এজন্যে আগামী দিনের পাঠক এটি থেকে লোকজীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির পাঠগ্রহণ করে আনন্দিত হতে পারেন নিঃসন্দেহে। কারণ সিলেটের জনজীবনে লেগেছে কর্পোরেট হাওয়া, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এখন ক্ষয়িষ্ণু। একথা এজন্য বলা যে ইমাদ উদ্দিন সমাজের ছোটখাটো পেশা যেমন ধানভানা, বেগারখাটা, বিয়েবাড়ির নানারকম প্রস্তুতি — সুপারিকাটা, মসলাবাটা, দারু বা জ্বালানী কাঠ কাটা ইত্যাদি বিলুপ্ত পেশাজীবনকে তুলে এনেছেন তাঁর উপন্যাসে। গ্রামে তখন দরিদ্র নারী ঢেঁকিতে ধানভানাকে পেশা হিসেবেই নিয়ে ছিলেন। এরকমই একটি নারীচরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার উপন্যাসে। নারীচরিত্রটি স্বামীপরিত্যাক্তা কিন্তু প্রাণবন্ত ও প্রদীপ্ত যৌবনা। সে-ই জামানদের বাড়িতে জমিলার বিয়ে উপলক্ষ্যে দিন পনেরো আগে অসে — ধান ভানে, সুপারি কাটে, নানাকাজে বেগার খাটে। জমিলার বিয়ে উপলক্ষ্যে তাকে সিলেটি বিয়ের গীত গাইতেও শোনা যায় —
ইঙ্গুল মন্দির ঘরে
কাজল কোঠায় বসিয়া
পাশা খেলইন বা দামদে
বালী সামনে লইয়া
গ্রামীণ জনপদে কীভাবে শিশুজীবনে যৌনতার সঙ্গে পরিচিতি ঘটে, এ উপন্যাসে তার একটি দৃশ্য চিত্রিত করেছেন ইমাদ উদ্দিন বুলবুল। একদিন সেবুল রতিকামী মাদী ছাগলটিকে পাঠাওয়ালীর বাড়িতে নিয়ে যায়, যাওয়ার সময় জামানকে সঙ্গে নেয়। বলে, —
‘ছাগী ডাকছে, পাঁঠার বাড়িত যাইমু’।
মাইল কয়েক দূরে পাঁঠাওয়ালা বাড়িতে ছাগীটিকে নিয়ে যায় তারা। অঞ্চলটায় বেশিরভাগ লোকজন মুসলিম, পাঁঠা পোষেন না। টিলার উপর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা হুঙ্কার দিতে থাকে —
‘খবরদার, আমার পাঁঠার ধারে আইয়ো না। আগে পয়সা দাও।’
কমদামের পুরানো একটা নীল শাড়ি পরা মহিলা সেবুলের নিকট আসতেই সেবুল তার হাতে একটা আট আনার কয়েন তুলে দেয়। পাঁঠার মজুরি হচ্ছে আট আনা, আট আনা মানে পঞ্চাশ পয়সা। পাঁঠার মালিকনী সেবুলকে সাবধান করে দেয়, —
‘বেশিক্ষণ থাকবা না। আরও ছাগী আসবে।’
সকাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচটা রতিকামী ছাগল এসে গেছে। সেবুল হিসাব করে দেখে মালিকনী আড়াই টাকা পেয়ে গেছে। এভাবেই জামান দুরন্ত জীবনের আস্বাদন লাভ করে সেবুলের মাধ্যমে। হতভম্বও হয় সেবুলের কর্মকাণ্ডে। ইমাদ উদ্দিন অরো একটু অগ্রসর হন, এটুকু বলে নেওয়া দরকার এজন্য যে এতে উপন্যাসটিতে বাস্তবজীবনের অনুপুঙ্খ কীভাবে এসেছে তা বোঝা যাবে। বুনোপাঁঠা যখন রতিকামী ছাগলটাকে নিয়ে মেতে ওঠে তখন জামান অনুভব করে ‘তার সমস্ত শরীরেও একটা অনুভূতি বারবার শিহরণ দিচ্ছে। একটা অস্থিরতা ক্রমেই তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এ ধরনের শিহরণ জামান ইতিপূর্বে আর কোনোদিন অনুভব করেনি।’ এরকম পরিস্থিতিতে সেবুল ক্রমশ তার নিকট অচেনা ও জংলী হয়ে ওঠে এবং জামানকে জাপটে ধরে। সেদিন জামান কৈশোরকালীন এক ধরনের যৌনতার সঙ্গে পরিচিত হয়।
আসামের কাছাড় জেলার বদরপুরের রেল জংশনটি ব্রিটিশ-ভারতের একটি বিখ্যাত রেলজংশন। সেটিকে ঘিরে যে কলোনি গড়ে ওঠে তাতে প্রচুরসংখ্যক বাঙালি মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারী সপরিবারে বাস করতেন। এরা ছিলেন মূলত নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ। দেশভাগ কিংবা রায়টিং-এর সময় তারা পাকিস্তানে চলে আসেন। আসাম অঞ্চলের অনেক অধিবাসীও পাকিস্তানে চলে আসেন। আবার বাংলাদেশ হতে অনেক হিন্দু পাড়ি জমান ভারতে। রায়টিং বা দেশভাগ শিশু জামানের মনে এক হতাশা ও ঘৃণার জন্ম দেয়। জামান তার মায়ের একটি আপ্তবাক্য প্রায়ই মনে করে, ‘আল্লার গজব সয়, বান্দার বাত সয় না।’ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে যে-মানুষ, মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে যে-মানুষ, তার প্রতি এক অজানা ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম হয় তার মনে।
‘সুরমা নদীর চোখে জল’ আবহমান বাংলা লোকসংস্কৃতিকে লালন করেই বিকশিত হয়েছে। শিলচরে বরাক নদীর কূল ঘেঁষে বসত বারুণি মেলা, এপারের লোকজনই নানারকম পসরা নিয়ে যেতেন সবচেয়ে বেশি। বসত বাউলগান-মালজোড়া গানের আসর — সে-মেলাতেই ‘খ্রিষ্টিয় সুসমাচার স্টল’ দিয়ে বসত ফিরিঙ্গি সাহেব-মেমরা, থাকত মসজিদ-মন্দিরে যার যার প্রার্থনার ব্যবস্থা। হিন্দু-মুসলিম সকলেই সংসারের সারাবছরের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি মেলা থেকেই কিনতেন, মেয়ে-বোনদের বাড়িতে পাঠাতেন মেলার খই-খেজুর। কালের গর্ভে সবই হারালো। এই হারিয়ে যাওয়া লোকোৎসব ও লোকভাষার প্রত্ন-উপাদান ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ উপন্যাসে ধরে রেখেছেন বুলবুল।
সাজিদ মিয়াদের বাড়ি সীমান্তবর্তী গ্রাম হরিনগরে। সীমান্তের এপার-ওপার — দু’পারের জীবনই তার চোখের সামনে বাস্তব। জল কমে যাওয়া সুরমা নদী অথবা জলভরা সুরমাপারের জীবনে এপার-ওপারের মানুষের সঙ্গে মানুষের নাড়ির সম্মন্ধ, জন্ম-মৃত্যু-ঝড়-তুফানেও। কিন্তু উদ্বাস্তু অথবা সমঝোতার মাধ্যমে বাসস্থান পরিবর্তন করা মানুষ, যাদের পিঠে হয়তো আছড়ে পড়েছে ভাই-বোন বা মা-বাবা অথবা অন্য কোনো আত্মীয়পরিজনের ছলছল চোখ, সেসব মানুষের স্রোত দেখতে দেখতে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। বলেছেন —
‘যে রাস্তা ধরে সিলেট, ঢাকা, বিক্রমপুরের মানুষ হৈহৈ রৈরৈ করে এক সময় বারুণী মেলায় আসত, সেই রাস্তা ধরেই আজ আতঙ্কিত মানুষের মিছিল। ক্ষুধার্ত অভুক্ত হতাশাগ্রস্ত।
মানুষ ছুটছে। কেবল ছুটছে। এপার থেকে ওপারে। মানুষ কেবল ছুটছে মহাকালের পথে। নতুন ঠিকানার সন্ধানে আপাত এ মানুষগুলো সত্যি ঠিকানাবিহীন।’
দেশভাগের ফলে সাজিদ মিয়ার দুবোন কুলসুমা ও সকিনা বিবির বাড়ি পড়ে বাংলাদেশে, তার একমাত্র মেয়ে সুলুকজান বিবির বাড়িও বাংলাদেশে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাতিকে তাই সুরমা নদীর গল্প বলতে গিয়ে ভেঙে পড়েন সাজিদ মিয়া, বলেন, —
‘নদীর দিকে চাইলে এখন আর আমি পানি দেখি না, দেখি চোখের জল। নদীর একপার পাকিস্তান, অন্যপার ভারত। দু’পারে যেখানে ছিল গুনটানা মাঝির দরাজ গলার গান, সেসব জায়গায় এখন মিলিটারির বুটের আওয়াজ আর উদ্ধত বন্দুক। জামান ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদাজি, ইবায় হিন্দুস্তানি ফৌজ, হিবায় পাকিস্তানি ফৌজ, মাঝখানো সুরমা নদী। ইতা অলা সব দিন আছিলনি?’
এ প্রশ্ন যেন মহাকালের। ভাঙা-গড়ার চিহ্ন তো নদীর দুইপারের মতোই চলছে, কালে-কালান্তরে। ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ সেই কাহিনিই ধারণ করে আছে।
এতদসত্বেও বলতে হয় এ-উপন্যাসের কাহিনি খুবই শ্লথ, অবিন্যস্ত — অজস্র ঘটনাবলিকে স্থান দিতে গিয়ে লেখক বিষয়নির্বাচনে নির্দয়ভাবে অগ্রসর হননি, করেননি গ্রহণ বা বর্জন; ফলে উপন্যাসের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে — দেশভাগের মতো মহাকাব্যিক পটভূমির মধ্যে তার পাত্রপাত্রীরা ক্লাইমেক্সে উপনীত হয়নি। ঘটনার ফ্লাশব্যাক রীতিতে লেখক অগ্রসর হয়েছেন, উপন্যাসের প্রথমার্ধের নায়ক সাজিদ মিয়া এবং দ্বিতীয়ার্ধের নায়ক বালক জামান শুধু কাহিনিই বলে গিয়েছে, জীবনের রূঢ়তার মধ্যে আবর্তিত বা পীড়িত হয়নি অথবা রূঢ়তাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। এই অর্থে এ উপন্যাসে লোকজীবনের সরল নকশা অংকিত হয়েছে কিন্তু গভীর ও বৃহত্তম ক্যানভাসের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ঘটনার আবর্তের ভেতর থেকে নায়ক বিকশিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে এ উপন্যাসে লেখকের মূল উপজীব্য হারিয়ে যায়নি, বরং সুখপাঠ্য হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটের ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকজীবন স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শাহজালালপ্রচারিত সুফিজীবনধারা ও শ্রীচৈতন্যপ্রবর্তিত বৈষ্ণবীয় প্রেমধারায় সিক্ত সিলেটের লোকজীবন। ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ প্রধানত সুরমা-বরাক উপত্যকার মুসলিম জনজীবনের কাহিনি হলেও এতে সুফিজীবনধারা ও বৈষ্ণবীয় প্রেমধারায় বিকশিত জীবনচিত্র লক্ষযোগ্য। এখানে ‘জল’ ও ‘পানি’-র বিরোধ মিটেছে সহৃদয়তায়। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল তাঁর উপন্যাসে ‘জল’ ও ‘পানি’-কে একাকার করে দিতে পেরেছেন, তাঁর সার্থকতার ক্ষেত্রে এটিও বিবেচ্য।
…
ইমাদ উদ্দিন বুলবুল ভারতের আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার কাটগিড়া গ্রামে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সন্ধ্যা সাতটার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল একাধারে আইনজীবী, কথাসাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ এবং সমাজসবেী ছিলেন। তিনি আমরণ নিজের সমাজ-সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সমাজ-সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং ইতিহাসচর্চা ও আইনব্যবসায় সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের যে পরিচয় দিয়েছেন তা মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘সুরমা নদীর চোখে জল’ এবং ‘বরাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ সহ তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে যাতে আসাম অঞ্চলের রেফারেন্ডাম ও দেশভাগ, আসামে বাংলা ভাষার সংগ্রাম, বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিশেষ করে সিলেটি ভাষা-সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিষয়াবলি চিত্রিত হয়েছে। বরাক-উপত্যকার বাঙালি সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘বঙ্গভবন’-এর বহুমাত্রিক কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মোহাম্মদ বিলাল। কবি ও প্রাবন্ধিক, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট।
COMMENTS