সন্ধের পর শহর হয়ে ফেরার পথে, পথিমধ্যে, একটা বইবিজনেসের দোকানে ঢুঁ দেয়া ছিল নৈমিত্তিক নিত্যঘটনা। গা-ঘিনঘিনে একধরনের কর্দমাক্ত অনুভূতি নিয়ে ফিরতে হতো রোজ, সন্ধ্যা উজিয়ে, নদীতীরস্থ কুটিরে। ফেরার সময় সারা রাস্তা মুখবিবর উপচায়ে থেকে-থেকে উঠে আসত থুতু। অবশ্য বাড়ি ফিরেও যদি নিস্তার মিলত, তো কথা ছিল না। প্রায় তিনঘণ্টা স্থায়ী হতো ওই ঘিনঘিনে অনুভূতি। নিজেকে বারবার ধিক্কার দেয়া ছাড়া কার্যত করার কিছুই থাকত না। তা, করবার কিছুই থাকেও না আসলে, এসব ক্ষেত্রে, আর ঘটনাও তো সত্যি তেমন সিরিয়াস কিছুও না। গালগপ্পোগসিপের রঙ কড়া আর কটকটে তো হবেই, ইহবঙ্গে, পরবঙ্গে, অন্তর্বঙ্গে, বহির্বঙ্গেও। অন্য কারোর কোনো বিকার তো হতো না, তৎকালীন বঙ্গে, বরঞ্চ ভোগ করত সবাই দিব্যি ওইসব গাড্ডামার্কা গুলতানি। তোমার বাপু হগলতাতেই মিছা বাড়াবাড়ি, বলেন ভ্রুকুঞ্চিত মম বান্ধবী। কী জানি, হবে হয়তো। যেসব ঘটনাবলি ঘিনঘিনে মনে করছি আমি, অন্য সবার কানে সেটা মামুলি ঠেকবে হয়তো। বইদোকানের দোকানদার ও তদীয় গং বসে বসে বদখত সব মন্তব্য করতে থাকেন, সোজা বাংলায় যারে বলে পরচর্চা, সমস্ত সন্ধ্যা সঞ্চালিত হয় ওই বদমায়েশির আসরে অনুপস্থিত কতিপয়েরে কেন্দ্র করে, যারা আসরের সমস্ত কথাকাদার টার্গেট। তবু যদি হতো কথানুষ্ঠান ওই ব্যক্তিবর্গের বিশেষ কোনো চরিত্রবৈশিষ্ট্য নিয়ে, অ্যাবাউট দ্যায়ার ফ্যলিস্ অ্যান্ড্ ভাইসেস্, মোটামুটি মেনে নেয়া যেত। কিন্তু না, আড্ডা উৎসর্গিত থাকে সেই অনুপস্থিত ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের দারাপুত্রপরিবারস্বজন নিয়ে কুৎসা রটাবার কাজে। এরা, এইসব দোকানদার ও দোকানদারঘেঁষা কাব্যবাজপাখিরা, তাদের চেয়ে তেরোশ গুণ স্ট্রং লিখনশৈলী ও শক্তিমত্তার লেখকদের রোজ সন্ধ্যায় চায়ের কাপের সমুদ্দুরে সক্রোধ চুবিয়ে মারে, ভাসিয়ে দেয়, সিগ্রেটের ধোঁয়ায় রিং বানিয়ে বায়ুমণ্ডলে উড়িয়ে দেয়। এরা, হাড্ডিমূর্খ এইসব পুত্তুলিরা, আসন্ধ্যা হিংসা আর ঈর্ষার হৈদরি হাঁক হেঁকে বেড়ায়। কেবল শপকিপার নয়, এই বিজনেসম্যান একইসঙ্গে শপকিপার কাম এডিটার। লিটল বা লেঠেল যে-নামেই ডাকি একধরনের ম্যাগাজিনের মাধ্যমে এই দোকানি নিজের কবিমূর্তি দেশব্যাপী প্রচার করে ফিরেছে, এর সঙ্গে ওর হিংসা হানাহানি রিরংসা লাঠালাঠি ইত্যাদি রিপুর লালন ও বিকাশে মদত জুগিয়ে এসেছে, এবং তরুণতর কবিবোকাদেরে এই বইদোকানিরা ম্যাগাজিনের বিক্রয়লব্ধ অর্থ ফিরায়া না দিয়া দিনের পর দিন তাদের দোকানের ধুন্দুমার আড্ডায় নিরতিশয় স্তাবক বানায়ে রেখেছে। এইসব বইদোকানের আড্ডাগুলো খুব ইন্ট্রেস্টিং, লক্ষ করে দেখবেন। বাংলাদেশের যত জায়গায় যত আড্ডা হয়, সেসব আড্ডার ভেতর বইয়ের দোকানকেন্দ্রিক আড্ডাগুলো নিয়া আমার গোপন আগ্রহ দীর্ঘদিনের। আমি গবেষকটবেশক হলে এই থিমের ওপর একটা দীর্ঘমেয়াদী রিসার্চপ্রোজেক্ট ডিজাইন করতাম। লক্ষ করে দেখবেন, আমাদের দেশের বুড়া-জোয়ান নির্বিশেষে লেখকেরা আড্ডা দেন প্রধানত বইদোকানগুলোতে। এবং এইসব আড্ডা ওভারহিয়ার করেছি দীর্ঘদিন, ফলে আমার ভেতরে এসব বদখত গুলতানি সম্পর্কে একটা অনপনেয় বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে যা শত কসরতেও ইরেজ করতে পারলাম না এ-যাত্রা। আরেকটা ব্যাপার আমি দেখেছি যে, এইসব আড্ডায় একটা স্থায়ী হিংসার ফোয়ারা ও ঈর্ষার ইলেক্ট্রিক চুল্লি বসানো। বইয়ের দোকান ছাড়া অন্য কোনো আড্ডাস্থলে এমনধারা আমি দেখি নাই। বিশেষত কবি-লেখকেরাই এসব আড্ডায় গুলজার করেন দুর্গম কান্তার মরু ও নরকের গিরি। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে এ-দেশের সাহিত্যে যারা অল্পকিছু ভালো কাজ করেছেন, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, পরচর্চাপ্রোমোটিং বইদোকানের আড্ডায় তাদের বিচরণ খুব কম। এইটা খুব সিগ্নিফিক্যান্ট একটা ব্যাপার। কিন্তু এইটাও ঠিক, এ-রকম সরলীকৃত অব্জার্ভেশন প্রকাশ করে আমি নিজেও সেই বইবিক্রেতা বাম্বুবিদের খাসলত প্রদর্শন করছি। তাছাড়া এদেরকে, এই সাংস্কৃতিক হাড়গিলেদেরকে, এত গুরুত্ব সহকারে আমলে নেবার কোনো দরকার আদতে নেই। এরা এ-রকমই, পুষ্কুরিনির পানাশ্যাওলা, স্রেফ উপরতলাকার বুদবুদ। চারপাশ ও জগৎসংসার নিয়ে স্যুইপিং কমেন্ট করে-করেই এদের সংস্কৃতিচর্চা চলে। এ-ই তো দেখে আসছি এতাবধি। কিন্তু ভাবুন তো একবার, এ-দেশের লেখকসম্প্রদায়ের তথা সো-কল্ড সৃষ্টিশীল মানুষদের আড্ডা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-রেস্তোরাঁকেন্দ্রিক না-হয়ে কেন বইদোকান ঘিরে আবর্তিত হয়ে আসছে? এই লাইনে ভেবে দেখুন, মজার একটা লেখা আপনি নিজেই তৈরি করতে পারবেন, এবং উপকৃত হব আমরা বইদোকানের লেখকাড্ডার বাইরেকার সাধারণ পাব্লিক। তবে তার আগে আমি বিদায় নিয়া নেই। বিদায় নেবার আগে বলি, এই দেখাগুলো মূলত দু-তিনটে স্যাম্পলিঙের ভিত্তিতে, রেন্ডোম, এবং দেড়দুই দশক আগের অভিজ্ঞতা তথা ভোগান্তিস্মৃতি। রিসার্চের জিয়োগ্র্যাফিক্যাল এরিয়াকাভারেজ হিশেবে একটা অত্যন্ত প্রত্যন্ত ও পতিত মফস্বল শহরকে বেছে নেয়া হয়েছে। লেকিন বাকি দুনিয়ার খোঁজখবর সুপণ্ডিত এই গবেষকের নখদর্পণে তো নাই-ই, অন্য কোনো অঙ্গদর্পণেও নাই। সীমাহীন লিমিটেশন, বটে, ধর্তব্য ভুল অনেক আছে। সেহেতু রচনাখানা না-হইল থিয়োরিটিক্যাল, না এম্পিরিক্যাল। অবশ্য দম ধরে লিখে যেতে পারলে এম্পিরিক্যাল একটাকিছু হয়তো দাঁড়িয়ে যেত। সম্ভব হলো না, যা-হোক। সবশেষে লেখকের পরিচয় পেশ। কে এই পিৎলা ঘুঘু? রমাকান্তকামার নাম তার, মানে শ্যাওড়াগাছের ভূত, মানে নোবডি। পিরিয়ড অফ দি কাহানি? উনিশ শতকের রেনেসাঁসোত্তর অথবা আঠারো শতকের গোড়া? তা, আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন, রচনাটা ওপেনেন্ডেড কি না … লাফিং আউট … লাউড … আউচ …
লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS