রাইসুর রাজ্য ও নৈরাজ্য || আহমদ মিনহাজ

রাইসুর রাজ্য ও নৈরাজ্য || আহমদ মিনহাজ

নব্বইয়ের কাব্যে স্বকীয়তা অর্জনের ঘটনা পরের দশ বছরে ঘটতে শুরু করে। সূচনা-দশকে সময়ের গতিবিধি যেসব লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছিল সেখান থেকে কবিরা জীবনবোধের মাপ অনুযায়ী পছন্দেরটি বেছে নিয়েছিলেন, অতঃপর পরবর্তী দুই দশক এর ওপর দাঁড়িয়ে কাব্যভাষার বনেদ তাঁরা গড়েপিটে নিয়েছেন। কামরুজ্জামান কামু, ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবীর, আহমেদ নকীব প্রমুখরা আশির মধ্যভাগে ট্রেন্ডে পরিণত মকারি ও স্যাটায়ারকে ভিন্ন চেহারা দান করছিলেন। নব্বই ও পরবর্তী দুই দশকে বাঙালির শ্রেণিগত স্ববিরোধী আচরণের বয়ান ব্রাত্য রাইসুর নগরজীবী মধ্যবিত্ত কালচারের চরিত্রহানি ঘটানোর মধ্য দিয়ে পৃথক চরিত্র লাভ করেছিল :—

এই দেশে মহাকাল অত দীর্ঘ নয়
আমাদের মহাকাল — ব্যক্তিগত, নিজের ব্যাপার।
তাতে সময়চেতনা, কোনো ইতিহাস
অধ্যাপনা নেই, তাতে অর্থনীতির ছাত্রী বসে আছে
এ কা কি নী
জীবনের অর্থ খুঁজিতেছে
তাকে অর্থ দাও, কীর্তি দাও, সচ্ছলতা দাও
তাকে বিপন্ন বিস্ময় দাও, একদিন জোর করে
বৃষ্টিতে ভেজাও। বলো,
মহাকালে এইরূপ বৃষ্টি হয়ে থাকে।
[এই দেশে বৃষ্টি হয়]

ট্রেনের জানলায় — দেখা যাচ্ছে
মধ্যবিত্ত — জর্জরিত মধ্যবিত্ত
চিপস খাচ্ছে — চিপস খাচ্ছে — চিপস খাচ্ছে — আর
দেখে নিচ্ছে গ্রামবাংলা — আজিও বর্ষার।
[এই যদি গ্রামবাংলা]

কুকুর ও ঠাকুর আসছে একটি একটি করে
লেজটি বাঁকা করে হাতে গীতবিতান ধরে
ওরে আমার ভাঙা ঘরে।

আমার ছোট ঘরে
কত বড় বড় হাতিদের বড় বড় পারা
তাই আমি আত্মহারা…তাই আমি নাই আমি নাই…
[কে কে আসছে ঘরে]

নগরজীবী মধ্যবিত্ত ভাবালুতা ও বুদ্ধিজীবিতার ধরন নিয়ে আশির অন্ত থেকে শূন্য দশকের অন্ত অবধি রাইসুকৃত মশকরা প্রয়োজনীয় ছিল বলেই মনে হয়। কোথাও এই বোধির অনুপ্রবেশ ঘটানো দরকারি ছিল নগরজীবী সংস্কৃতি ও তার প্রতি অঙ্গে প্রকট কলাচার যেসব ট্যাবু বহন করে থাকে সেগুলোকে ধাক্কা দিতে না পারলে নতুন ভাষা তৈরির পথে হাঁটা কঠিন হয়। মিথ্যে তো নয় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রগতিচেতনায় অতিপ্রাকৃত বাড়াবাড়ি সকল যুগে কমবেশি সুলভ ছিল। নিজেকে পরিশীলিত করার ধারায় তার দেশপ্রেম, সাম্প্রদায়িক অভিমান, জাতীয়তাবোধ, ধর্মবিশ্বাস, রুচিবোধ, নাগরিক আচার উৎসব পালনের ধরন, তার খাদ্যাভ্যাস থেকে সেক্সাভ্যাস… অর্থাৎ নগরজীবনে জায়মান অগুন্তি ফুটনোটে মধ্যবিত্তসমাজের সম্পৃক্তি যেসব ট্যাবুর জন্ম দিয়েছে তার বৃহদাংশ পুনরাবৃত্তিবহুল টেক্সটের খাঁচায় নিজেকে বন্দি করা ছাড়া অন্য সুখ উৎপাদনে ব্যর্থ বলা চলে। এহেন খাঁচায় বসে নগরজীবী মধ্যবিত্ত যখন জীবন ও প্রকৃতির শতেক অনুষঙ্গে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে তখন এইসব অনুষঙ্গের ওপর বানোয়াট মূল্য আরোপণের খাসলত তাকে ভোগায়। রাইসুর মশকরাঘন পঙক্তিমালা এখানে সেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যার মূল্য সাময়িক হলেও নিছক নগণ্য নয়। তাঁর কবিতাকে এ-রকম জায়গা থেকে পাঠের প্রয়োজনীয়তা হয়তো রয়েছে।

প্রাকৃত জীবনবেদের পরিধিতে ঢুকে নাগরিক যাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও সেখানে গোলমাল পাকানোর ঘটনা কমবেশি প্রতি দশকে নৈরাজ্যের জন্ম দিয়ে গেলেও একদা মধ্যবিত্ত সমাজে অঙ্গীভূত নৈরাজ্যের এই ধারাটি একপ্রকার মরহুম বলা চলে। নব্বইয়ের যুগবিশ্বে পা রাখার পর থেকে ওপরতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা কালচারে মধ্যবিত্ত সমাজের অভিন্ন হওয়ার মনোবাসনা শ্রেণিটিকে ধোঁয়াটে ও হাস্যস্পদ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিবিধ সংকটজালে জড়ানো নগরজীবী বুদ্ধিজীবিতার অবভাস বা মিথ্যাজ্ঞান প্রীতির বৃত্তে ঢুকে পড়ার কার্যকারণ ও মর্মবেদনা অবশ্য রাইসুর কবিতায় সচরাচর চোখে পড়ে না। মধ্যবিত্ত তাঁর কাছে সমবেদনার প্রতীক হওয়ার যোগ্যতা রাখে বলেও মনে হয় না। শ্রেণিটির প্রতি কবির সংবেদনহীন মনোভাব বাহ্যিকভাবে নিজেকে রেনিগেড হিসেবে উপস্থাপন কিংবা অহংতৃপ্তির অস্ত্রে শান দেওয়ার অস্ত্র মনে হলেও অন্তর্গতভাবে এটি তাঁর জন্য ফাঁদ হয়ে ওঠে। নগরজীবী বুদ্ধিজীবিতার ছক থেকে রেহাই পেতে রাইসুর অহং যেখানে নিজের নির্ণয় খুঁজে মরে সেটি ওপরতলার এলিটবৃত্তে তাঁকে প্রবেশ করানোর ক্ষমতা রাখে না; আবার নিচুতলার ঘামে-ভেজা মানুষগুলোর সঙ্গে সন্ধি পাতিয়ে প্রাকৃত জীবনে গমনের হিম্মত রাখে কি না সন্দেহ! না-ঘরকা না-ঘাটকা অবস্থানে সক্রিয় কবিত্ব হলো রাইসুর নিজস্বতা। অন্যভাবে দেখলে এই নিজস্বতা নব্বইয়ের যুগবিশ্বে প্রবল হতে থাকা পরস্পরবিরোধী প্রবণতার সঙ্গে বেশ মানিয়েও যায়!

পরস্পরবিরোধী প্রবণতায় যাপনের কৌশল এক নতুন নৈরাজ্য এবং রাইসুর কবিতাকে বৃদ্ধিবৃত্তিক সেই নৈরাজ্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তে খারাপ লাগে না। এটি একদিক দিয়ে নব্বই সহ পরবর্তী দুই দশকে বিকশিত ভাবধারার প্রভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রথাগত বুদ্ধিজীবিতায় ভাঙন ও নয়া সড়ক ধরে গমনের কার্যকারণ বুঝতে পাঠককে সাহায্য করে। রাইসুকে যদি বাঙালি বুদ্ধিজীবিতার প্রথানুগ ধারায় ভাঙন সৃষ্টির উদাহরণ গণ্য করি তাহলে বলতে হয় বুদ্ধিজীবিতায় ফাটল ধরানোর লক্ষ্যে তাঁর নিজের সেখানে বিরাজিত থাকার ঘটনা ভানের অতিরিক্ত আবেদন বহন করে না। বুদ্ধিজীবী জিনিসখানা স্বয়ং ট্যাবু এবং ট্যাবুগ্রাসী রাইসুর পক্ষে বুদ্ধিজীবিতায় বিরাজ করা অসম্মানজনক বটে! বুদ্ধিজীবী তাঁর নিজের ভাষায় ‘দুইশত তেরো মাথা’ ধারণের মতো এলাহি ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। সুতরাং বাংলার প্রথানুগ বুদ্ধিজীবিতায় বিরাজিত মধ্যবিত্তপনাকে একহাত নেওয়ার পর নিজ বুদ্ধিজীবিতার ভার তিনি কীভাবে খারিজ করবেন সেই সমস্যাটি সামনে চলে আসে। প্রথানুগের বিকল্প বুদ্ধিজীবিতা জাতিকে উপহার দেওয়ার পর সেটিকে যদি খারিজ করা না যায় তাহলে ‘দুইশত তেরো মাথা’ কাটার পরে যে-মাথাটি বেঁচেবর্তে রয়েছে সে-বেচারা এখন কী দিয়ে বা কাকে দিয়ে নিজের মাথা কাটাবে এই প্যারাডক্স বড়ো বেদনাঘন কৌতুক বহায় মনে! যারপরনাই কবিতায় ও নেটিজেনদের সঙ্গে বাদবিবাদের ক্ষণে রাইসুকে অবিরত নিজের অবস্থান নিয়ে গোল পাকাতে হয়। প্রথানুগ বুদ্ধিজীবিতার শত্রু কবিবর তাঁর নিজের হাতে বোনা বুদ্ধিজীবিতার মিত্র নন;— এহেন বিবৃতির সত্যতা প্রমাণের ঠেকা অগত্যা তাঁকেই নিতে হয়! অন্যের ফাঁদ কাটতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র তিনি ব্যবহার করেন এখন সেগুলোর সাহায্যে স্বরচিত ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসার ভাবনা মশকরার ছলে লেখা রাইসুর কবিতাকে বুদ্ধিজীবীশূন্যতায় গমনের সবক দিয়ে যায়।

নব্বইয়ের যুগবিশ্বে চারিয়ে-ওঠা নাগরিক সমাজ ও তার বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ধারা বিবেচনায় নিলে এটি হলো স্ট্যান্স। এর ওপর দাঁড়িয়ে নাগরিক সমাজে রকমারি চিহ্নের উপাসনায় মজে থাকা ব্যক্তি, শ্রেণি, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিধিতে রাইসু নিজেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সচল রাখেন অথবা নিষ্ক্রিয় করেন। প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের প্রিয় মেটাফোর যেমন দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে পরিহাসবিদ্ধ করার পর অবশিষ্টরূপে যা পড়ে থাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ হলো গৎবাঁধা মেটাফোরে ভাঙন ধরানোর জন্য রাইসু যে-বিকল্পের জন্ম দিলেন কাল নয়তো পরশু তারা ট্যাবু হয়ে কবির ঘাড়ে চড়ে নাচতেও পারে। নিজ হাতে সৃষ্ট বিকল্পকে ডিনাই করার ঝামেলা ঘাড় থেকে সরাতে কবি অগত্যা সেখান থেকে কেটে পড়েন। রবিবাবুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত ফ্যাসিনেশনে তাঁর তিলেক সম্মতি নেই কিন্তু একে প্রত্যাখ্যানের পর রাইসুসৃষ্ট ফ্যাসিনেশনকে প্রত্যাখ্যান করা স্বয়ং তাঁর নিজের জন্য মুশকিল-কি-বাত হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত রবিকে নিয়ে তৈরি ট্যাবু ধ্বংসের পর রাইসুকৃত ট্যাবুর ফাঁদে যারা মাথা ঢুকালেন তারা এখন কীভাবে সেখান থেকে বের হবেন, তির্যক এই প্রশ্নটি তীব্রভাবেই ওঠে। যে-কারণে কবিতায় ও বাগযুদ্ধে রবিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত রাইসুক্যাঁচাল তর্কবিতর্কের সাময়িক উত্তেজনা সরবরাহ করলেও রবিসাহিত্যের পুনর্পাঠ বা সেখানে বিদ্যমান শূন্যস্থানগুলো পূরণে পাঠককে সহায়তা করে বলে মনে হয় না।

রাইসুর কবিজীবনে মোক্সার জনক রোদ্দুর রায়ের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় রবিকে নিয়ে তিনি ঠিক কোথায় যেতে চাইছেন তার নিশানা পাঠকের কাছে অস্পষ্ট থেকে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, রবিদাদুর মামলায় ট্যাবু ভাঙা ও তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ রোদ্দুর রায়ের বেলায় উন্মুক্ত থাকলেও রাইসুর জন্য কোনো পথ সেখানে খোলা থাকে না। মধ্যবিত্তের জান রবিকে ধোলাই দেওয়ার পর অবশিষ্ট রবিকে কোথায় রাখবেন এই ভাবনা কবির মাথা ধরায়। তিনি রোদ্দুর রায় নন যে মোক্সার বিদঘুটে মশকরা দিয়ে রবি সম্পর্কে বাঙালির চালিয়াতি ফাঁস করে দেবেন। রোদ্দুরের মোক্সায় যেসব ডিরেক্ট পাঞ্চিং থাকে সেগুলো রাইসুর পক্ষে হজম করা মুশকিল। আফটার অল তাঁর খিস্তি রুচির পরিসীমা মেনে চলে, যেটি আবার মধ্যবিত্ত-স্বীকৃত রুচি থেকে খুব বেশি দূরের নয়। রুচি একটি ট্যাবু এবং রুচিবোধের প্রশ্নে নিজেকে রোদ্দুরের জায়গায় নামিয়ে দেওয়া রাইসুর জন্য কঠিন শুধু নয়, অবান্তরও বটে। মধ্যবিত্তের রবিকেন্দ্রিক রুচিবোধের গোয়া মারলেও ওপর ও নিচুতলায় সক্রিয় রুচিবোধের জগতে জায়গা করে নিতে অক্ষম রাইসুর রুচিবোধ হায় দিনের শেষে মধ্যবিত্ত ভাবালুতায় নিজের কিনারা খোঁজে!

জটিল এই ফেরকার খপ্পরে পড়ায় রবি তাঁর লগ ছাড়ে না! অবিরত ছাটাইয়ের পরেও সে তাঁর পিছু পিছু হাঁটে এবং জলজ্যান্ত একখান ট্যাবু হয়ে ট্যাবুগ্রাসী রাইসুর ভিতরে গুমরে মরে। ব্রাত্য রাইসুর কবিজীবনে রবিসমস্যা প্রধান সমস্যা এবং এই সমস্যাটি ছাড়া তাঁর স্বকীয়তা বুঝে নেওয়া কঠিন বৈকি! প্রতিমাভগ্নের মিশনে কোনো কেন্দ্রে জারি থাকা বৈধ নয় এবং এই শর্তটি নিজের ভাবনাকে কেন্দ্রে পরিণত করা বা তাকে প্রতিষ্ঠা দানে খেটে মরা রাইসুর জন্যও প্রযোজ্য হতে বাধ্য। ‘কেন্দ্র’ শব্দটি দণ্ডেমুণ্ডে ট্যাবুর প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। একে ডিনাই করতে গিয়ে রাইসু যে-ভাবকেন্দ্র প্রসব করে বসেন সেটি নিজে কেন্দ্র হওয়ার বৈধতা হারায়। হেফাজতি মুমিনদের রাষ্ট্র কর্তৃক নিপীড়িত ‘সর্বহারা’ রূপে মহিমা প্রদানের ঘটনা রাইসুর কবিজীবনে চমকপ্রদ নৈরাজ্য নিয়ে এলেও তাঁর পক্ষে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি! ‘সর্বহারা’ শব্দের অর্থস্তর কালের ফেরে বিচিত্র কেন্দ্রে গমনের কারণে ট্যাবুর মহিমা লাভ করেছে এবং কেন্দ্রের বিনাশ ঘটানোয় তৎপর রাইসুর সেখানে অটল থাকার সুযোগ নেই। কার্ল মার্কস নিজে সর্বহারা ছিলেন না তবে শব্দটিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র ও মহত্ত্ব প্রদানে তাঁর ভূমিকা চিরস্মরণীয়। হাল-জামানায় নিম্নবর্গের (subaltern) প্রবক্তারা কস্মিনকালে সর্বহারার দুর্ভোগ সহ্য করেছেন বলে মনে হয় না, কিন্তু মোটা-মোটা অভিসন্দর্ভ ফেঁদে সর্বহারাকে নতুন কেন্দ্র পাইয়ে দিতে তাঁরা অক্লান্ত খেটে মরছেন! তো এভাবে ভাবলে মহামহিম কার্ল মার্কস থেকে ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান হয়ে ব্রাত্য রাইসু অবধি কেন্দ্রবিরোধিতার লম্বা লিস্টি তৈরি হয়, যেখানে উনারা সকলে কোনো-না-কোনো ট্রেনের জানালা দিয়ে চিপস খেতে খেতে গ্রামবাংলা ও সর্বহারার নিরীক্ষণে ব্যস্ত রয়েছেন!

বিদ্রুপ ও মশকরাপটু ব্রাত্য রাইসু প্রতিমাভগ্নের কান্ডারি হুমায়ুন আজাদের মিত্র না হলেও অনেকটা তাঁর মতোই প্রতিমা ভাঙার মিশনে বিবিধ কেন্দ্রে হানা দেন ও সেখান থেকে নিজের প্রস্থানবিন্দুর খোঁজে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের কালচারে হুমায়ুন আজাদ যেসব চিহ্নকে প্রতিক্রিয়াশীল দাগানোর পক্ষে ছিলেন রাইসুকে সেখানে এসবের প্রতিপক্ষ রূপে ভাবা যায়। উক্ত তফাৎ বাদ দিলে কেন্দ্র ভাঙার মিশন খতম হওয়ার পর কেন্দ্রাতিগ নামক ঘটনাকে তাঁরা ধাওয়া করে ফেরেন, অতঃপর ধাওয়া শেষ হলে নিজে যে-কেন্দ্র এতক্ষণে জন্ম দিয়ে ফেলেছেন সেখানে ঢুকে পড়া ছাড়া দুজনের উপায় থাকে না! অর্থাৎ কেন্দ্র ভাঙার মিশন কেন্দ্রাতিগ নামের ট্যাবুর মোহজালে দুজনকে বন্দি রাখে। কেন্দ্রাতিগ হচ্ছে মনোরম এক ট্যাবু, যার অস্তিত্ব মাটির দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া ভার! অসীম নিরাকারে বস্তুর সমাধি ব্যতীত কেন্দ্রাতিগ নামে কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রের কারাগারে বন্দি বস্তুজীবনের কেন্দ্রবিচ্যুত হওয়ার বাসনা নির্মম রসিকতা কি না কে জানে! এই রসিকতা হয়তো কবিচিত্তে যুগ-যুগে পরিহাস, মশকরা ও নৈরাজ্যের জন্ম দিয়েছে। তবে কথা হলো, মশকরা দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির খেলা কবির জন্য উত্তম খাদ্য হলেও এই ছকে নিরন্তর লিখে যাওয়া কঠিন! পুনরাবৃত্তির অব্যাহত চাপে কিছুদিন পরে সেগুলো কেন যেন আবেদন হারায়! রাইসুর কামিয়াবি ‘কালিদাসের লগে মেগ দেখতাছি’র সময়ে ঘটে গিয়েছিল এবং বাদবাকি যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোকে কালিদাসের পুনরাবৃত্তি বললে ভুল হয় না।

একুশ শতকের যুগপরিধিতে দাঁড়ানো ব্রাত্য রাইসুকে এখন ক্লান্ত প্রাণ দেখায়! নিজের ভাবনাকেন্দ্রকে প্রতিষ্ঠা দানের জন্য কবি লম্বা সময় বঙ্গদেশের নেটিজেনদের সঙ্গে লড়াই করেছেন। পঞ্চাশ-উত্তীর্ণ বয়সে পৌঁছানোর পর সেই দমে বোধহয় জং ধরতে শুরু করেছে। অর্থকে অর্থ দিয়ে ডিনাই করার খেলায় তিন দশক জারি থাকার কারণে হবে হয়তো তাঁর কবিতায় মাঝেমধ্যে ক্লান্তির ছোঁয়া এসে লাগে! জন্ম-মৃত্যু ও যাপনকে ঘিরে জীবনের নিরর্থক চংক্রমণের কথা ভেবে কবিমন আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই ঘরানার কবিতারা নগরবৃত্তে সক্রিয় রাইসুর চেহারাকে অচেনা করে তোলে। নব্বইয়ের ধাঁচে কথা বলতে ইচ্ছুক কবিতা তিনি বিশেষ লেখেন না। এদিক থেকে নিজেকে আশির কবি দাবি করাটা অযৌক্তিক নয়, কারণ তাঁর ভাষাঅঙ্গ ওই দশকের মধ্যভাগে সক্রিয় কবিবৃত্তে মানিয়ে যায়। তবু বঙ্গদেশের নেটিজনদের সঙ্গে তর্কে ‘হারতে নারাজ’ রাইসু মাঝেমধ্যে সত্য ভাষণ ডেলিভারি দিয়ে বসেন। ক্লান্তপ্রাণ কবি জানিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন না, তাঁর এই রাইসুযাপনকে ঘিরে যেসব অর্থ কবিতায় ও গদ্যে জন্ম নিয়েছে সেগুলো অস্তিত্বের অন্তিম কেন্দ্রের কথা ভাবলে অর্থহীন শব্দখেলার নামান্তর মাত্র! অর্থ আরোপের চাপ যত বাড়ে অর্থগুলো অধিকতর অর্থহীন ও হাস্যকর পুনরাবৃত্তিতে পর্যবসিত হয় :— ‘বৃষ্টি হলে কাঁঠাল তলায় / এরা দুইজন কাঁঠালের ঝরা পাতা / পা মাড়িয়ে যায় / আর / ভিজা মাটি আবার শুকায়।’ (দ্রষ্টব্য : এরা দুইজন)।

আপাত সহজ পঙক্তিতে মুদ্রিত জীবনবেদ রাইসুর প্রকৃত সত্তাকে চিনিয়ে যায়। এই রাইসু জানেন উত্তেজনার খোরাক সরবরাহ ছাড়া নগরজীবী সত্তার পক্ষে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন! সমাজে বেঁচে থাকতে হলে উত্তেজনার পারদ তৈরি করা লাগে এবং নিজের কবিতা ও জীবনযাপনের ধারায় সেটি তিনি বহমান রাখেন। পক্ষান্তরে বহমান থাকার এই ভানকে মকারি দিয়ে খেলো করা ছাড়া আত্মিকভাবে বেঁচে থাকা তাঁর জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। রাইসুর আত্মযাত্রা যে-কারণে ক্রমশ বদ্রিলারের বচনে নির্গমন নিতে যাচ্ছে কি না সে-প্রশ্নটি তাঁকে এইবেলা পড়তে বসে ওঠে। বদ্রিলার ক্লিয়ার করে গিয়েছিলেন অর্থকে ঘিরে যত বেশি অর্থ উৎপাদন হয় জীবন সেই অনুপাতে সিনথেটিক বা কৃত্রিম হয়ে পড়ে, অর্থ উৎপাদনের খেলায় মৌলিকত্ব নিজের আবেদন হারায় আর আত্মা নির্বাসিত হয় ভানসর্বস্ব বায়বীয় প্রতিরূপতায়। সমস্যা হলো অর্থ উৎপাদন না করে মানুষের উপায় নেই। ভাষা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশের জৈবিক ক্ষমতা অর্জন করায় রকমারি অর্থ সৃষ্টির নামে অনর্থক গোল পাকানো মানবপ্রজাতির খাসলত। মানুষ অভিশপ্ত এক আশীর্বাদের নাম! অর্থ উৎপাদনের খেলায় সত্তাকে কেন্দ্রীভূত ও ট্যাবু করে তোলাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: