বেতারদিনের তরঙ্গ || সত্যজিৎ সিংহ

বেতারদিনের তরঙ্গ || সত্যজিৎ সিংহ

সন্ধ্যা ৭. ০৫-এ দিত খেলাধুলার সংবাদ। মাত্র ৫ মিনিটের খবরের জন্য আধাঘণ্টা সৈনিকভাইদের গানের অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’ শুনতে হতো। খেলার খবরে প্রথম জানতে পারি শচিন নামে এক বিস্ময়কর বালকের নাম। যে কিনা শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা ৩ শতক হাঁকিয়ে ভারতকে কাপ জিতিয়েছে। রাত আটটায় অল ইন্ডিয়া শিলং। ইংলিশ গানের অনুরোধের আসর। ডন উইলিয়ামস, বিটলস, ম্যাডোনা। রাত নয়টায় শিলং থেকে কৈলাশর। এফএম চ্যানেল। পাঁচমিশালি গানের অনুষ্ঠান। দেবব্রত বিশ্বাস, পূর্বা দাম, প্রতিমা পান্ডে। ‘আকাশভরা সূর্যতারা’, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’, ‘তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু রে’। প্রতিমা পান্ডের কী যাদুকরি গলা!—মনে হতো, বাড়ির পাশের পাহাড়ের উঁচু থেকে খাদের দিকে নেমে আসছে অপার্থিব সুর। রাত দশটায় সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে শুক্রবারের নাটক। মা-বাবা আর আমি — তিনজন স্তব্ধ হয়ে আছি। কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা  নাটক। কেউ কারো দিকে তাকাই না। একেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় — কিচিরমিচির শব্দে কানে তালা লাগা অবস্থা। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম কীভাবে, এটাই আচানক মানতে হবে। সমস্ত রেডিওস্টেশন তখন চায়নাদের দখলে চলে গেছে। যেন ফিলিপিনের জঙ্গলে আটকে যাওয়া এক বিপন্ন বালক, জাহাজে একা। সকাল সাড়ে ছয়টায় বিবিসি বাংলা। সাতটায় বিবিধ ভারতী। মুহম্মদ রফি সাব, সুমন কল্যানপুর, শামসাদ বেগম। গান লিখছেন মজরুহ সুলতানপুরি, আনন্দ বক্সি। সুর দিচ্ছেন সলিল চৌধুরী, নৌশাদ সাব, মদনমোহন। তারপরে দুপুরবেলা আবার কৈলাশর এফএম। বাড়ির কাছের ইস্টিশন। এত ঝকঝকে আওয়াজ, যেন কুয়োতলা থেকে আমার ভাই আমার নাম ধরে ডাকছে, আর আমি কান পেতে রেখেছি কুয়োর পাড়ে। বিকাল চারটায় কৈলাশর থেকে সম্প্রচার করা বিবিধ ভারতী। ভারতকা সবসে লোকপ্রিয় রেডিওচ্যানেল। রেনু বনশালের সেই কিন্নর কণ্ঠ। নাটক হিন্দিতে, ‘চরণদাস চোর’, রচয়িতা হাবীব তানভীর। দিনের আঠারো ঘণ্টাই রেডিও নিয়ে পড়ে থাকতাম। হাতে না ছিল একটা বই, না শাসন করবার মতন কেউ। এইভাবে অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে পেয়ে আমি উচ্ছন্নে চলে গেলাম। আমার ক্লাশমেটরা মেডিকেল কোচিং, বুয়েট কোচিং, ভার্সিটি কোচিং। আমি দ্বিতীয়বারের মতন ইন্টারমিডিয়েট ফেইল!


সত্যজিৎ সিংহ রচনারাশি
বেতার সংগীত বিভাগ :: আরিফ সোহেল

COMMENTS

error: