চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৭ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৭ || শেখ লুৎফর

ভালোবাসার রঙ্গমঞ্চ


বোধকরি বিড়ির তিরাশটা ভুলে থাকার জন্য মালেক বসে বসে মশা মারছে। নিঃশব্দে ডলে ডলে শুধু মশা মারছে আর নিজের রক্তে নিজেরই হাতদুইটা লাল করে তুলছে! যে-গাছটা হেলান দিয়ে সে বসে আছে তার বিশ-ত্রিশ হাত দূরেই হাইল বিল। আঘুন মাসের ঠাণ্ডা চাঁদটা বিলের থমথমা পানি আর ছিঁড়া ছিঁড়া কুয়াশার তলে আত্মগোপনের তালে সন্ধ্যা থেকে টালবাহানা করছে। তবু লুকানো রোশনির আভায় লাল হয়ে ওঠা বিলের পানির দিক থেকে মালেক তিলেকের জন্যও চোখ ফেরাতে পারে না। এর মধ্যেই আবার মাঝবিলে একটা বোয়াল মাছ বিরাট শব্দে ঘাই মারে। ঘুপ করে ওঠা শব্দটায় মালেক বোয়ালটার শক্তি ও শরীরের একটা চিত্রকল্প মনে মনে আন্দাজ করে। বড়শি দিয়ে মাছশিকার করা মানুষ তো, তাই মাছের ঘাই শুনলেই মতলববাজের মতো মালেকের রক্তে শিকারের ধান্ধা জেগে ওঠে।

গাব গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকা মালেকের উত্তরে বিরাট একটা জংলা। মস্ত জংলাটার নাকের ডগার ওপর আমজাদ ঢালীর বাড়ি। রগচটা ঢালীরও একটা ঘাটুদল আছে। এবং সে বেটিমানুষকে গাই বলে ডাকে। লম্বা-ঢেঙা চেহারার বাবরি চুলের ঢালীর তিন নম্বর বউয়ের অপেক্ষায় ঘণ্টাখানেক ধরে মালেক গাব গাছের নিচে ঝিম-ধরে বসে আছে। গফুর বাদশা পালার কুখাবনগরের রাক্ষসের মতো একেকটা মশা তার নাক-মুখ মানছে না। এতে অবশ্য মালেক খুব একটা বিরক্ত হয় না। পিরিতির মানুষটার দেখা পেতে হলে তো তাকে সাপ, বিচ্ছু, ভিমরুল, মশামাছির দেখাটাও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মেনে নিতে হবে।

ঘন গাছগাছালিভরা বিশাল জংলাটায় পথ হারিয়ে ফেলা চাঁদের আলো চারপাশের আবছা অন্ধকারে কইমাছের মতো কানকু ঠেলে ঠেলে ঘুরছে। শুধু ঘুরছে। গফুর বাদশা গানে বানেছা পরীর দেশ চেমননগরের মতো এই নিবু নিবু রোশনি, কলিজা কাঁপানো নির্জনতা আর বাঁ দিকে জলভরা হাইল বিলের উদাম বুক তাকে একটুও ভাবায় না। বরঞ্চ চতুর আমিনের আদলে সে দাগ-খতিয়ানের ইঞ্চি ইঞ্চি হিসাব করে মাছশিকারের ধান্দায় সময় কাটায়। ঘুমের মাঝেও তার মনটা মাছের তক্কে থাকে। বাংলা ভাষার জন্য গুলি খেয়ে ছাত্ররা মারা যাওয়ার তিন মাস পরে তার বাপও ঠাঠায় মরে গেছিল। তাবাদে তার মায়ের সংসারের মুখে তাকেই তো দানাপানি জোগাড় করে তুলে দিতে হয়েছে অনেক বছর। এবং গত সাত-আট বছর ধরে-না সে একটু আরামে আছে।

ঠাঠা পড়ে বাপ মরেছে তাকে সতেরো বছর বয়সে রেখে। সামনের জষ্টিমাসে তার বয়স হবে কমছে-কম চৌত্রিশ কি পাঁইত্রিশ। তার বয়স ছত্রিশ কিংবা আটত্রিশ বললেও মালেক নীরবে মেনে নেয়।

কালাই পাথারে মালেকের বাপ আগে আগে ট্যাঁটা নিয়ে ছুটছে, পেছনে সে। বৈশাখমাসা রাতের শেষ পহর। বাতাস শো শো ছুটছে। আসমানে গুড়ম গুড়ুম ঠাঠার সাথে যখন ফাৎ করে বিজলি মারে তখন মস্ত মস্ত বোয়ালমাছ বিলের ডহর থেকে নালা বেয়ে উজানে ছোটে। মাছের গতর ভরতি ল্যারের মতো পিছলা পিছলা বিজল, পেট ভরতি ডিম। শাঁ শাঁ বৃষ্টির তোড়ে শুকনা পাথারের ঘাসে ঘাসে ছপছপা পানি। কই, মাগুর, শিং, গুইন্যা মাছে কেউ তখন থুতুও দেয় না। সবাই ট্যাঁটা উঁচিয়ে ছোটে ডিমওয়ালা বোয়ালের দিকে। সেদিন তার বাজানও পনেরো-বিশ সের ওজনের একটা বোয়ালের পিছে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ে ঠাঠার মুখে। মানুষের মরবার কোনো টাইম লেখা নাই। মালেকের বিবেচনায় থাকা উচিত।

দুধদাঁত পড়ার আগেই সেও তার বাপের সাথে উজাই মাছ মারতে ছুটত। সেই বয়সেই মালেক মাছশিকার আর খেজুরগাছের রস তোলার সব ফন্দিফিকির রপ্ত করে ফেলেছিল। বাজ পড়ে বাপ মরে যাওয়ার সাপ্তাখানেকের মাঝেই সে পেটের ক্ষিধায় মরা বাপের শোক কাটিয়ে ওঠে। মা খালি তার গলায় ধরে সকাল-বিকাল কাঁদে। তাদের সংসারে সেই শুধু একটু ডাঙ্গর। বাকি সব কয়টাই তো অবুঝ। ছোট ছোট পাঁচ-ছয়টা ভাইবোন বিলাইয়ের মতো তার আর মায়ের চৌপাশে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এইসব আচান্নক আচান্নক জিনিস পদে পদে দেখতে দেখতে, শিখতে শিখতে কয়েকদিনেই বুঝি মালেকের বয়স বিশ বছর বেড়ে গিয়েছিল।

বাপ মরার ছদিনের মাথায় সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মালেক হাতে তুলে লয় বাপের ছিপ-বড়শি। তাই দেখে মা ঘরের বারিন্দার আড় থেকে খলুইটাও এনে তার হাতে দেয়। সেদিন মালেক না-বুঝেই নিজের ঘাড়ে আস্তা সংসারটা তুলে নিয়েছিল। দুই-তিন গ্রামের বিশ-বাইশটা বিল আর শেখপাড়ার তিরিশটা খেজুর গাছ দোস্তের মতো তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

তিন-চার বছর আগে একদিন ঠিক দুপুরে হাইল বিলের এই গোপে মালেক এসেছিল বড়শি নিয়ে। এই গোপটা ছোট হলে কী হবে, খুব গহিন। তার জানা ছিল এই গোপে কাঙলা আর চিতল মাছের বড় বড় আতাইল আছে। এরা খুব সাবধানি মাছ। নিপিত্তি জায়গা ছাড়া বসত করে না। পেছনেই কুখাবনগরের দানবের মতো জাফড়ি বাঁধা বিরাট একটা গাব গাছ। তারপর বিরাট বড় একটা জংলা। তাই এইদিকে মানুষের কোনো চলাচল নাই।

মালেকের সাথে ছিল লাল করে ভাজা চিংড়ির টোপ। জাগামতো বসে, টোপটা গিঁথে, বড়শিটা ফেলতে না ফেলতেই ফাতনাতে টুনটুন কয়খান টান পড়ে। সে এই টানের মাহিত্ম্য বাপের কাছ থেকে চিনে রেখেছে। তাই টোপে ভিড়া মাছটা যে কাঙলা এই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। সে জানে মেয়েলোকের মতো এরা বড় সাবধানী আর চিক্কন বুদ্ধির মাছ। খাবারের সময় কোনো তাড়াহুড়া করে না। তাই সে বড়শির ফাতনায় তিরতিরা টানের অপেক্ষা করে। মাছশিকারে এটাই আসল ক্যারদানি। মালেকও ঝিম ধরে।

টাইম মতো মালেকের ছিপ বাতাসে ফাৎ করে ডাক দেয়। ছলবল করতে করতে উঠে আসে একহাত লম্বা, জোড়হাতের তালুর মতো চ্যাপ্টা একটা কাঙলা। সেদিন শেষবিকালের আগেই মালেকের মস্ত বড় খলুইটা উপচে উঠেছিল। মালেকও উঠি উঠি করে উঠতে পারছিল না লোভে। ঠিক এই সময় জংলা থেকে উড়ে এসে তার ছিপের ডগায় একটা ঢিল পড়ে। মালেকের বুকটা ছাৎ করে ওঠে; এই বুঝি গাব গাছের ভূতটা তার ঘাড়ে আছড়ে পড়ল! ভয়ে ভয়ে সে ফিরে তাকায়। গাব গাছের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে আছে আমজদ ঢালীর ছোট বউ ফালানি! তার চোখ-মুখ আর সারা গতরে জটিল একটা হাসি!

অনেক বছর আগেই মালেক মেয়েলোকের এই হাসিটা মুখস্ত করে ফেলেছে। তাই সে নিমেষেই রোগের লক্ষণ ধরে ফ্যালে। কামের গমগমা আগুন দু-চোখে জ্বালিয়ে আমজদ ঢালীর ছোটবউ এখন কবিরাজের তালাশে বড় নাজুক অবস্থায় আছে। সে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ছোবল মারার আগে সাপের শরীরটা যেমন তৃষ্ণায় টানটান হয়ে ওঠে, তেমনি মালেকও টানটান হয়। একবার তার ইচ্ছা হয় রাতের মঞ্চের আদলে গেয়ে ওঠে :

কাননপথে এসো গো সখি, পায়ে দলে ফুল
তুমি বিহনে যৌবন আমার হয় যে বিফল।

ভূতপেত্নী, সাপ-বিচ্ছু কিংবা আমজদের বল্লমের ঘা কোনোকিছুই মালেককে দমাতে পারে না। গাছের গোড়ায় সে টাল মেরে বসে থাকে। প্রথম প্রথম ভয়ে বুক ধপাস ধপাস করত। এখন তার কাছে সব পানিভাত। বরং এক ধরনের আমোদে-বীরত্বে নেশা নেশা লাগে। গ্রামের ছোট-বড় সবাই যে-গাছটার ভয়ে দশ বাতর ঘুরে অন্য পথে যায়, সেই গাবগাছটার নিচে সে এখন সপ্তাহে দুই-তিন দিন এসে প্রায় একই ভঙ্গিতে বসে থাকে। ভাবে। সেই ভাবনা মেঘবাদলাভাসা বেকার দিনের মতো। ডর-ভয়-বিকারহীন একটা নির্ভার আমুদে শিকারের কথা ভাবতে কার না ভালো লাগে?

অনেকদিনের রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিজ্ঞতায় মালেকের কাছে এখন মাছ কিংবা নারী দুটাই সমানে সমান। তাবাদে মালেক আজ-কাল করতে করতে শেষতক বিয়েটাও করল না। মনের দুনামুনা কিছুতেই কাটে না। তার ছোট ছোট ভাইবোনদের বিয়ে দেওয়া-করানো শেষ করেছে সেই কবে। এখন যার যার সংসার। ছোটরা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মালেকের এখনও দিব্যি মনে আছে, যে-বছর ছাত্ররা ‘ছয়দফা ছয়দফা’ চিৎকার করে করে হাটবাজার সব গরম করে রাখত সেই বছর তাদের বাড়িভিটার ভাগ নিয়ে তার ছোট তিনটা ভাই তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তাকে খুব পিটিয়েছিল। সেই ঘেন্নায় বাপের ভিটা ছেড়ে দিয়ে সে বিলের কান্দায় একটা খুপরি তুলে নিয়েছিল। সেই থেকে সে একবেলা রাঁধে তো তিনবেলা খায়। এক হিসাবে তারচে দুঃখী কিংবা সুখী পৃথিবীতে আর কে?

মালেক জানে, ঘাটুছেরা যারা রাখে আর যারা মাছের শিকারি প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের বউয়েরা নাঙ রাখে। এই তার মনের আসল বিঘ্নি। সবসময় তার বিবেচনা কয়, গরম গতরের আস্তা একটা মানুষ বিছানায় রেখে, ছিপ-ট্যাঁটা হাতে খালে-বিলে রাতের পর রাত ঘুরলে বউ তো নাঙ রাখবেই। সতেরো বছর বয়সে সেও প্রথম নাঙ হয়েছিল। নাঙ হওয়া এক জিনিস আর নিজের বউকে নাঙ রাখার সুযোগ করে দেওয়া আরেক জিনিস।

বিলের পুবপারে আমজাদ ঢালীর ঢোল আর হারমোনির তালে মালেক কান খাড়া করে। পুবপাড়ার সেই ঠেক থেকে ভেসে আসছে আমজাদ ঢালীর ঘাটুছেরা আছমতের গলা। গাবতলা থেকেই মালেকের মালুম হয় : গানের তালে তালে আমজাদ বুঝি ঘাড় সমেত বাবরিটা জোরে জোরে দুলাচ্ছে। এখন তার আর ঢালীর মাঝে আস্তা একটা বিল। এবার ঢালী পালা বেঁধেছে ‘আলোমতি-প্রেমকুমার’। আসরে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। ডৌল-গড়ন আর গলার সুর-খাতে আছমত মাঝারি গোছের ঘাটুছেরা। আলোমতির পাঠ কৈয়া সে দর্শকরে মজাইব ক্যামনে?

ঘাটুগানের জগতে যোগ্য ছেরা যোগাড় করা সাতজনমের পুন্নি।

অপেক্ষার আজাব ভুলে থাকার জন্য গতর ছেড়ে বসে থাকা মালেক ডান হাঁটুতে নাচন তুলে শরীরে একটা তাল ধরে রেখেছে। সেই তালে তালে সে ভাবে : আঘুন মাসের ধান কাটা শেষ। এখন গ্রামে গ্রামে মঞ্চ হবে। আজ প্রসাদপুর বাজারে, তো কাল উজানপাড়ার আখড়ায় বায়না পড়বে। তাই এশার পরেই ঢালী পুবপাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলে রিহার্সাল বসিয়েছে। ফিরবে রাত এগারোটা কী বারোটায়। তার ঘাটুছেরা আছমতকে বুকে নিয়ে বাইরবাড়িতে ঘুমাবে। বেটিমানুষ তো তার কাছে গাই ছাড়া কিচ্ছু না। বছর বছর খালি বাছুর বিয়ায়।

গাব গাছের ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে একটা ছায়া মালেকের পাশে এসে নিঃশব্দে বসে। মানুষটার গতরের মিঠা গন্ধে মালেকের হৃদয়টা টনটন করে। আমজাদের ছোটবউ ফালানি আন্ধকারেই একগাল হাসে। তার মনে কয়, মালেককে জড়িয়ে ধরে গত তিনদিন না-দেখার ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়। আর ঠিক তখনি ফালানি আলগোছে মালেকের গলা জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে গানে টান দেয় :

আমার মন মজিল সখি আসি কাননে,
আসি কাননেগো সখি আসি কাননে।

ফালানি এই গানটা মালেকের কাছ থেকেই শিখেছে। অবশ্য মালেক তাতে এখন একটুও সাড়া দেয় না। কোনো কোনো দিন ফালানি অত দেরিং করে যে তার কামের তিরাশটাই মরে যায়। নাঙের খোমার দেখে ফালানিও হাসে। সেই হাসিতে শব্দ না হলেও সাদা সাদা দাঁত ঝিলিক দেয়। চোখের মণিদুইটাও চকচক করে। ফালানির গতরের ওম আর মিঠা ঘ্রাণটা এতেই আরো তীব্র হয়ে ওঠে। মালেক জোরে জোরে হাঁটু নাচায়। একফাঁকে বিলের দক্ষিণ ডহরে চাঁদটা খোঁজে। বিলের বুকে চাঁদের বেজার বেজার মুখ। তার মনে কয়, জীবন একটা ভূতের বোঝা ছাড়া কিচ্ছু না।

ফালানি মালেকের ডান উরুতে একটা হাত রাখে। হাতটা মোমের আগুনের মতো মিঠা, — মনে কয় অনেকক্ষণ ধইরা বইয়া রইছস?
মালেক হাসে। তার মন বলে, পুরুষের কাছে মেয়েলোক বিড়ি-তামাকের মতো একটা নেশা ছাড়া খুব বেশি কিছু না। তাই সে আস্তে আস্তে কয়, — তরে পাইতে অইলে ত বইতেই অইব।
ফালানি ফিসফিস করে মনের দুক্ ঝাড়ে, — সতীনগুলান খালি চৌখ্যে চৌখ্যে রাহে। একটু গন্ধ পাইলে শকুনের লাহান ঠুকরাইয়া ঠুকরাইয়া ছিঁড়ব।
মালেক হাটুর তাল বন্ধ করে বলে, — তরে-না সবটি ডরায়?
ফালানি ফের হাসে, — আমারে না, হেরা ডরায় আমার সাহসরে। আর সাহস আইয়ে কৈত্তে, যুদিন তর গতরে কোনো গুয়ের গন্ধ না থাহে।

ফালানির নিজের জন্য মায়া হয়। কিছুটা ঘেন্নাও হয়। এর বদলে একটা কামলার সাথে বিয়ে হলেও সে সুখী হতো। অন্তত এই গাবতলে এসে রোজ রোজ তলের কাপড় তুলতে হতো না। কিন্তু উপায় কী। ঢালীর মতো গাইদরের মুখে থুতু ছিটানোর জন্য এরচে সহজ পথ আর তার জানা নাই।

ফালানির কথা মালেক হৃদয় দিয়ে ভাবে। বালিশের নিচে রামদা নিয়ে ফালানি বড়ঘরের বারান্দার খুপরিতে একলা একলা ঘুমায়। আরস্তিগিরস্তি, আণ্ডাবাচ্চা, কায়কামলা আর তিনটা বউ নিয়ে ঢালীর বিরাট সংসারটা বলতে গেলে ফালানি একলাই সামাল দেয়। বড়বউ তো সান্তানাদি আর সতীনের সাথে চুল ছিঁড়াছিঁড়ি নিয়েই ব্যস্ত। ফালানিকে সে সত্যি ভালোবাসে না ঠেকা কাম চালায়? এই বিষয়ে মালেক একবারও নিজেকে তলিয়ে দেখে না। দরকারও নাই। মালেকদের ঘাটুদলের আর-দশজনের মতো সেও জীবন থেকে অনেককিছুর তাঁবেদারি ছেঁটে ফেলেছে।

ফালানি মালেকের গতরে আলতো করে হাত বুলায়। নিজের মনের মায়া মানুষটার গতরে নীরবে মেখে দেয়। ম্যালাক্ষণ বসে বসে অপেক্ষার জন্য এইভাবে সে তার পিরিতির মানুষটাকে সান্ত্বনা দেয়। মালেক দিব্যি টের পায়, ফালানির এই নিবেদন গফুর বাদশাকে হারিয়ে প্রেমিকা বানেছা পরীর দীর্ঘশ্বাসের মতো। এতদিনে সে জেনে গেছে, ফালানি যতই দাহাঁবাজ হোক তার মধ্যে সত্যিকারের প্রেমিকার একটা মন আছে। ঢালীর অনাদর, বিকৃতি আর সতীনদের তাচ্ছিল্য তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ফালানি হাতড়ে হাতড়ে মালেকের মুখ, হাত-পা দেখে। মশার কামড়ে যেখানেই ফুলে গুটি হয়ে গেছে সেখানেই সে একটা করে চুমা দেয়।

হ্যাংলা-পাতলা গতরের ছোটখাট মালেক মুখ ভর্তি বিচ্ছিরি দাঁতগুলা যতনে আড়াল করে রাখে। ফাঁকে ফাঁকে নজরের ত্যাজে যতটুকু পারা যায় তাতেই মন দিয়ে ফালানিকে দেখে। তার মনের বেদন বুঝতে চায়। ঢালী যে তার ছোটবউটাকে কিচ্ছু দিলো না বারবার খালি সেই কথাই তার মনে আঘাত করে। তারপর সামনে বসা তার প্রিয়তমার দিকে তাকিয়ে মালেক মনে মনে ভাবে, — আমি একটা ছাল-বাল ছাড়া মানুষ; গফুর বাদশা পালাগানের এই বানেছাপরীকে আমি হৃদয় ছাড়া আর কী দিবার পারি?

মালেক বড় করে শ্বাস ছাড়ে। ফালানি তার কোলে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে আছে। চাঁদটা এখন আরো মলিন। গাব গাছের মাথা থেকে চুঁয়ে চুঁয়ে শীত ও অন্ধকার নিচের দিকে নামছে। গতর ভরতি অন্ধকার নিয়ে মানুষ দুইটাও মোটা মোটা শিকড় ছেড়ে নিচে নামে। ফালানি গতরের খেতাটা গাছতলের শুকনা পাতার উপর বিছায়। তাবাদে মালেকের কোলে মাথা রেখে সে বাসর রচনা করে। মালেক ফালানির একটা বুকে আলতো করে চাপ দেয়। ফালানি মালেকের হাতটা টেনে নিয়ে তার গালে চেপে ধরে, — এমুন মানুষ গানের আসরে অত ইতরামি করে ক্যামনে?

মালেক বলে, — আমি যুদ্ধরে যুজ্জু কৈ হের জন্য গানের মাস্টার আমারে পাঠ দেয় না। বাবু কয় কি, আমি নাকি যুজ্জু কৈয়া পালা মাটি কৈরা দ্যায়াম। তাবাদে একটাকিছু না করলে ক্যার ঘাডুগান করি। হেলিগ্যা পালার পতি অঙ্কে অঙ্কে আমি জোকারি করি। মানুষ হাসাই। এইডা আসল না রে…খৈল-তামশার মতন অভিনয়। কিন্তু জানস, আমার খালি পরানডা কয় অভিনয়ডাই আসল। মানুষ খুব বদ প্রাণী। হে সময়-সময় নিজের লগেও অভিনয় করে।

মালেকের কথায় ফালানির মনটাও ভার হয়ে আসে। মালেকের যুক্তিকে তার শতভাগ খাঁটি লাগে। তাই মালেককে জড়িয়ে ধরে কানে কানে কয়, — এই দ্যাখ আমরা অহন গাবতলের রঙ্গমঞ্চে স্বামী-ইস্তিরির অভিনয় করতাছি। আমি তর বুকের ভাষা বুঝি, তুই আমার মনের হাচা কথাডা জানস। এই যে জানাজানি এইডাই আসল কথা। মনের লগে মনের জানাজানি, হিয়ার লগে হিয়ার…এইডাই পিরিতি।
বেতের জাঙ্গির মতো লকলকা ফালানিকে নিজের কোলে শুয়ে দিয়ে মুখটা ওর মুখের কাছে নিয়ে মালেক বলে, — আমি যুদিন একটা বিয়া করি?
এই কথা শুনে ফালানির মুখ দপ্ করে অন্ধকারে মিশে যায়। মালেক কালো-হয়ে-ওঠা সেই মুখ দেখতে না পেলেও বুক দিয়ে বুঝে, ফালানির বুকটা এখন বড়শির ন্যাতান্যাতা টোপের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে মিশে যাচ্ছে রাতের নিকষ পানিতে।

ফালানি অনেকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারে না। জগতে উক্কিলা মানুষের মতো দুঃক্কী কে? একলা একলা একটা জীবন কোনো মানুষের জীবন না। এরচে ভাজা কড়াই অনেক ভালো। হয়তো এই বেদন থেকেই সে মালেকের কাছে ধরা দিয়েছিল। কোনো প্রকার পিছুটানহীন মালেককে তার মনে হয় দুইহাত ভরা একটা লাল রুই মাছের মতো। খালবিল আর গাঙের ডহরে ডহরে ঘুরতে ঘুরতে রোদে পুড়ে পুড়ে মালেকের মাথার চুলগুলা লাল ফিরিঙ্গি হয়ে গেছে। মাছের গন্ধমাখা শরীরের মালেক সারাদিন খালি ফালানির মনের মধ্যে কুড়া কুটে। তাই শত চেষ্টাতেও সে এখন মালেকের কথাটা সহজভাবে নিতে পারে না। তাবাদে একসময় সে বুকভাঙা রোদনের মতো করে বলে, — আইজ না করস বিয়া ত একদিন করবেই। নাইলে ত পুরুষের কলঙ্ক।

মালেক অন্ধকারে হাসে। ফালানির মনটা সে নতুন পানির নিচে দেখা ডিমওয়ালা চিতল মাছের মতো পস্ট দেখতে পায়। মানুষটাকে বড় আপন লাগে। এই ভেবে আমুদে বুকটা ভরে ওঠে, সংসারে তারও একটা নিজের মানুষ আছে। পিরিতির মানুষ! কিচ্ছার ‘আলমাছ কুমার’র মতো সেও রাতিবিলি অভিসার গমনে যায়।

মালেক চেয়ে দেখে থকথকে অন্ধকারে ফালানির চোখ দুইটা বিষাদে জ্বলছে। সে ফালানির কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া কুঁকড়া চুলগুলা নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ লয়। দলকলসের ফুলের মতন হালকা একটা সুবাস। মালেক নিশ্চিত করে বুঝে, ফালানির যৌবন আরো অনেকদিন টিকবে। তারপর যৌবন শেষে সে শুধুই একজন মানুষ, মাত্র একটা বেটিমানুষ। মালেকের এও মনে হয়, অনুশোচনা ভরা সেইটাই মানুষের আসল জীবন।

কাত হয়ে বসে থাকা নারীর মুখ একপাশ থেকে দেখতে দেখতে মালেক বলে, — বিয়া কল্লে আমি কিন্তুক তর কাছে আর আইতাম না।
ফালানি একটুও অবাক না হয়ে বলে, — জানি।
মালেক ফালানির একরত্তি জবাব পেয়ে খুব আচান্নক হয়। কিন্তু একই স্বরে বলে, — যদি আই তহন আর এইডা পিরিতি থাকত না। লুচ্চামি অইব। লুচ্চাগরে খালি খোদা না মাইনশেও ঘিন্না করে।

এই কথায় ফালানি খুশি হয়ে মালেককে জড়িয়ে ধরে। একটু পরেই সে টের পায়, ফালানি অঝর ধারায় কাঁদছে। যে নারী স্বামীসঙ্গ ও সুখবঞ্চিতা, যে কাকবৎসা নারী মৃত সন্তানের মুখ মনে করে রাতের নিঃসঙ্গ প্রহরগুলা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ভোরের স্বপ্ন দেখে তার কান্না ছাড়া জগতে আর কী আছে?

হঠাৎ কিছু পাওয়ার মতো মালেক চমকে ওঠে। গত ঈদের মাঠে ইমামসাব ওয়াজ-নসিহতের মাঝে বলেছিল, হাশরের ময়দানে শিকলে হাত-পা বাঁধা একটা বুড়িকে দুনিয়ার সকল মানুষের সামনে হাজির করে আল্লা ঘোষণা করবে, এই দ্যাহো আমার বান্দারা, দুনিয়া একটা বুড়ি বেটিমানুষ। তোমরা আমার দেওয়া অমূল্য জীবনটা এই বুড়ির পিছে বিনা ওজরে খরচ করছ।

মালেকের মন কয়, বউ হইল সেই বেটির যৌবনকাল। সে খালি পুরুষ মানুষকে কুখাবনগরের কানাগলিতে ঘোরায়া মারে।

লাল সুতা দিয়ে জবাফুল-তোলা খেতাটার দিকে ফালানি চেয়ে থাকে। অন্ধকারে লাল জবাফুলটা দেখতে বদখত লাগছে। অত বড় বাপের মেয়ে হয়ে সে এখন আমজাদ ঢালীর তিন নম্বর বউ। বছরে তিন দিনও বুকে নিয়ে ঘুমায় না। কত ঈদ-পরব যায় জীবনে একদিনও জিজ্ঞেস করল না, তার কিছু লাগব নি?
কাছে বসায়া একবার হাসি মুখে দুইডা কতা কৈল না! তাইলে তার কাছে জীবনটা পালাগানের রঙ্গমঞ্চের চে কম কী?

মালেক পাশ থেকে ফালানির থুতনির দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখের লম্বাটে ডৌলটা খুব মনকাড়া। তার ইচ্ছা হয় ফালানির কানে কানে কথাটা বলে ফেলতে। কিন্তু বলে না। এইসব ভাবলে তার কেমন অবশ অবশ লাগে। সতেরো বছর বয়স থেকে গফুর বাদশার ঘোড়ার মতো দুনিয়া নামের একটা আড়ং জংলায় ছুটতে ছুটতে মালেকের কাছে এখন জীবনের সবকিছু কিচ্ছা কিচ্ছা লাগে।

চাঁদটা এখন ভাটির টানে অন্ধকার আকাশ হাতড়ে হাতড়ে একটা খোড়ল খুঁজছে। বিলের পুবপাড়ের ঠেকে আমজাদ ঢালীর আলোমতি এখন বিচ্ছেদ গাইছে। ফালানি বুকের আঁচল দিয়ে মালেকের তৃপ্ত, ক্লান্ত ও ঘামে ভেজা মুখটা মুছিয়ে দেয়। বাচ্চা ছেলেকে মা যেমন করে চুল আঁচড়ে দেয় তেমনি সে হাতের আঙুল দিয়ে মানুষটার এলোমেলো বাবরিটা ব্যাকব্রাশ করে দেয়। তাবাদে মালেক উঠে গিয়ে গাব গাছের শিকড়ে বসে। ফালানি মাটি থেকে খেতাটা তুলে আস্তে আস্তে কয়টা ঝাড়া দিয়ে ফের গতরে জড়ায়। পাশেই পিতলের বদনাটা। হঠাৎ বাড়ির কেউ তাকে খুঁজলে সে প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়েছিল এইমতো ছলনায় বদনাটা হাতে নিয়ে ধীরেসুস্থে ফিরে যাবে।

মালেক দিশ ধরে ফালানিকে দেখে। তার ইচ্ছা হয় মানুষটাকে আবার জড়িয়ে ধরতে। আচানক এক নারী। কম করে হলেও বয়সে তারচে দুই-তিন বছরের বড় হবে। লম্বায় তারচে বেশি ছাড়া কম না। ছিপছিপা গতরটায় একটা তাগড়া জোয়ানের শক্তি রাখে। পনপন করে হাঁটে। কম ঠেলায় ঢালীর মতো ইতরও তাকে সমঝে চলে!

ফালানি উঠে দাঁড়ায়। সে ফিরে যাবে আমজাদ ঢালীর বারান্দার অন্ধকার কুঠুরিতে। রাতভর একলা একটা বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে নিয়তির দরজায় কড়া নাড়বে। এইসব ভাবতে ভাবতে বহু বছর আগে একজন বুড়া ফকিরের গাওয়া গানের দুইটা লাইন ফালানির হৃদয়ে ঢেউ মারে। হঠাৎ সে মালেকের গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে সুর ভাঁজে :

বিধি তুমি জীবনের লগে দুঃখ দিছ বাঁধি
তাই আমি আশার দুতারায় সেই সুর সাধি।

মালেকের মনটাও আজ ভালো না। বুকের মাঝে কী একটা জিনিস খালি খপাত খপাত করছে। সে হঠাৎ ফালানির হাত দুইটা চেপে ধরে। একবার ইচ্ছা করে গফুর বাদশার মতো বানেছাপরীকে একটা ডায়ালগ দিয়ে তার মনের কথাটা জানিয়ে দেয়। কিন্তু তা না করে সে বলে, — খোদার কসম আমার কতায় কষ্ট পাইছ না। একবার চায়া দ্যাখ, আমার জীবনের রঙ্গমঞ্চে তুই ছাড়া আর ক্যাডা আছে?

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: