চন্দ্রাবতী বর্মণ। ডাকনাম চন্দ্রা। হাওরাঞ্চল হিসেবে খ্যাত তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলাধীন জগন্নাথপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ (১৯৩২খ্রি.) ২৬ ফাল্গুন রোজ সোমবার ভোরবেলা তিনি মহাদেব বর্মণ ও মুক্তা রাণী বর্মণ দম্পতির প্রথম সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ট হন। চন্দ্রাবতী যখন গাঁয়ের পাঠশালা পেরিয়ে সুনামগঞ্জ সতীশচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত তখন তাঁর বিয়ের সানাই বাজে। ১৩ই অগ্রহায়ণ ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (১৯৪৪ খ্রি.) ভারতচন্দ্র রায় বর্মণের সাথে জগন্নাথপুরের নিজ বাড়িতে তাঁর ‘দানে বিয়ে’ সম্পন্ন হয়। তিনি পাঁচ সন্তানের জননী। প্রথম ছেলে ভবতোষ রায় বর্মণ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দ্বিতীয় ছেলে আশুতোষ রায় বর্মণ একজন সরকারি প্রকৌশলী। তৃতীয় ছেলে পরিতোষ রায় বর্মণ এইচএসসি পাস করে একজন ব্যবসায়ী। চতুর্থ ছেলে শংকর রায় বর্মণ এসএসসি পাস করে একজন ব্যবসায়ী। মেয়ে অনুপমা রায় বর্মণ এসএসসি পাস করে একজন গৃহিণী।
চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ লোকগানের দরদী শিল্পী ছিলেন। তাদের বাড়িতেও তখনকার সময়ে গ্রামীণ ঘরানায় গানের চর্চা ও অনুশীলন হতো। গাঁয়ের সব বিয়ে পূজাপার্বনে গান গাইতেন তিনি। এ হিসেবে তাঁর গান গাওয়াটা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। শুয়ে-বসে, চলতে-ফিরতে গুনগুন সুরে চেষ্টা চালিয়ে আয়ত্ত করে নিতেন তিনি প্রকৃত সুর। তিনি নিজে-নিজেই সংগীত চর্চা করতেন। গুরুর হাত ধরে হারমোনিয়ামের সাথে সারেগামায় কণ্ঠ মিলিয়ে রেওয়াজ করা কখনও হয়নি তাঁর। ছিল না তাঁর গানের খাতা। মনের খাতায় লিখে রাখতেন সকল গান। তিনি ছিলেন নিজের প্রতি আশাবাদী ও নির্ভরশীল। অর্থাৎ নিজেই গুরু নিজেই শিষ্য। তবে পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে দিদিমা রাজেশ্বরী তাঁর প্রথম গুরু। তাছাড়া মা-খুড়িদের তাগিদ। আর প্রকৃতি তো আছেই। সুযোগ পেলেই বান্ধবীদের সঙ্গৎ, তারপর গান ও সুরের তালিম। নিরলে বসে সুর টেনে একে অন্যকে শিখানোর চেষ্টা। যেখানে তারাই গুরু তারাই শিষ্য।
তিনি পদ্মপুরাণ, মনসামঙ্গল, কীর্তন, সূর্যব্রত সংগীত, ধামাইল গান ও পল্লিগীতি সহ নানান চলমান গান গাইতেন। তবে ধামাইল গান ছিল তাঁর অতি প্রিয়।
চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ। সবার প্রিয় মাসিমা। একদিন মাসিমার জন্মদিন পালনের উপলক্ষে আমরা ক-জন চলে গেলাম তার বাসায়। বড় ছেলে ভবতোষ রায় বর্মণ দরজা খুলে আমাদের ড্রইংরুমে বসতে দিলেন। খবর পেয়ে ভেতরের রুম থেকে মাসিমা এলেন। আমরা সকলেই তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি আমাদের সামনাসামনি বসলেন। এক পলকে সবাইকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন—
বাবারা কেমন আছ?
—ভালো আছি মাসিমা।
সবার পক্ষ থেকে আমি মাসিমাকে জিজ্ঞেস করলাম—
আপনি কেমন আছেন?
—ভালো, বাবা!
আমরা আর কেউ কিছু না বলে মাসিমার কথা শোনার অপেক্ষায়। তিনি বুঝতে পেরে নিজের কথা নিজেই বললেন—
সুনামগঞ্জ গেছিলাম। বেশ কয়দিন ছিলাম। বিয়ে ছিল। বেশ গানবাজনা অইল।
—কি গান মাসিমা?
—কি আর, বিয়ের গান, ধামাইল।
—আপনিও কি গাইছিলেন?
—গাইছি, বেশ ভালোই লাগছে। কয়ডা মেয়ে বেশ ভালোই গাইছে। আরেকটু দরদ দিয়া গাইলে ভালো অইত।
—দরদ কি মাসিমা?
হাসলেন, মেরুদণ্ড সোজা করে, দীর্ঘশ্বাস টেনে, আমাদের আনাড়িসুলভ প্রশ্নের বিষয়টা ভিতরে লুকিয়ে নিয়ে বললেন—
আত্মনিষ্ঠ হয়ে গাওয়া। যে সুর শুনলে মনে ব্যাকুলতা আসে, আকুলতা আসে, নীরবতা আসে, এইডাই দরদী সুর।
—অ…।
—সংগৎ আর তালিম পাইলে মেয়েডি ভালা গাইত।
—এ দায়িত্ব কে নেবে?
হাসলেন—
বড় কঠিন প্রশ্ন। আমাদের সময় সমাজেই এই ব্যবস্থা ছিল। এখন এই পরিবেশ কম।
তিনি গুরুসান্নিধ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন—
পরিবর্তনের হাওয়া অস্বীকার করার উপায় নাই। তাই সকলেই সহজ পথে গুরু খোঁজে। ভালো। চলছে তো।
—আপনার গুরু কে মাসিমা?
—সবাই…। প্রকৃতি…সমাজ…পরিবার…। আমার দিদিমা ভালো ধামাইল গান গাইতেন। নাচতেনও খুব সুন্দর। তাঁর কাছ থেকেই আমি প্রথম গান শিখি।
—গানের সুর কিভাবে আয়ত্ত করতেন?
হাসলেন—
একের সাথে অন্যে সুর মিলাইতাম। কেউ তাল কাটলে আবার মিলাইতাম। মা-খুড়ির সাহায্য নিতাম। গ্রামোফোনের সাহায্য নিতাম। এই তো।
অতীতের অনেক সুখদুঃখ নিয়ে স্মৃতিচারণ হলো। হাওরাঞ্চলের হারিয়ে-যাওয়া ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কথা হলো। এবার যাওয়ার পালা। ভবতোষদার হাতেও সময় নেই। তাই ভনিতা না করে মাসিমাকে জিজ্ঞেস করলাম—
মাসিমা, আপনার জন্মতারিখটা বলবেন?
প্রশ্নটা মাসিমার কাছে অসংগতিপূর্ণ মনে হলো। তাই তিনি একটু ভাবনায় পড়লেন এবং সহজ করে বললেন—
আমার জন্মতারিখ ২৬ ফাল্গুন, ১৩৩৮ বাংলা।
—মাসিমা, আমরা আপনার জন্মদিন পালন করতে চাই।
কথাটা শুনে মাসিমা হতভম্ভ হয়ে গেলেন। বললেন—
না রে বাবা না, এই কর্মের কোনো দরকার নাই।
অনেক কথা বলেও মাসিমাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। তাই শেষ পর্যন্ত সুর ধরে টান দিলাম। যাকে বলে দুর্বল জায়গায় আঘাত বা ঝোপ বুঝে কোপ মারা। মাসিমা সুরের ভাবনায় হারিয়ে গেলেন। তিনি রাজি হলেন। শর্ত, আড়ম্ভর নয়। কোনো প্রকার খরচ করা যাবে না। শুধু গান হবে, সংগৎ হবে, সান্নিধ্য হবে, আনন্দ হবে। জন্মদিন বড় কথা নয়।
আমরা সকল শর্ত মেনে নিলাম। তবুও মাসিমার শঙ্কা গেল না। তাই পানের বাটা খুলে পান খেলেন। ইতোমধ্যে আমাদেরও চা-নাস্তা হয়ে গেল। মাসিমা নিজ হাতেই তা পরিবেশন করলেন। কার্য সিদ্ধ হয়ে গেল। এবার যাওয়ার পালা। মাসিমা জানালেন তাঁর আরেকটি সিদ্ধান্তের কথা। জন্মদিন হবে, তবে তার বাসায়। উদ্দেশ্য, আমাদের খরচ বাঁচানো। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! যেমনটি চাইছি তাতে বাসায় সম্ভব নয়। তাই আমরা আমাদের মনের বাসনা খুলে বললাম। বিনা পয়সায় হলরুম সহ অতি অল্প খরচে জন্মদিন পালনের বাজেটটা তাঁকে জানালাম। এবার তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। হাসলেন, বললেন—
বাবারা, তোমরা মানুষকে এত সম্মান করতে জানো! যা-ই হোক, সবার প্রতি যেন তোমাদের এই ভাবনা থাকে। আশীর্বাদ করি।
আমরা তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে যথারীতি ফিরে এলাম।
*
১২ আগস্ট সিলেট রেডিওতে শাপলা-শালুক অনুষ্ঠানে ছোটদের সাথে অংশগ্রহণ শেষে বাসায় এসে তাঁর দিব্যি সময় যাচ্ছিল। সুস্থ সবল স্বাভাবিকভাবে নাতিপুতিদের নিয়ে দিন কাটলো তাঁর। রাত ১২টার পর তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন। রাত পোহালে সকাল ৯টায় তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ঠেকছিল না। তাই ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো তাঁর পরিবার।
১৩ আগস্ট ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ১১টায় ৮৪ বছর বয়সে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সিলেট রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি হন। খবর পেয়ে স্বজনরা হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান। আমিও যাই। হাসপাতালে কারো সঙ্গে কোনো কথা বা দৃষ্টি বিনিময় হয়নি তাঁর। কারণ তখন তিনি সম্পূর্ণভাবে অচেতন। এক পর্যায়ে একটু সুস্থতা আসলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে তাঁকে ১৫ আগস্ট সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে চিকিৎসক বিপদমুক্তির আশ্বাস দেন। হাসপাতালে স্বজনদের সাথে তাঁর দৃষ্টি ও ভাববিনিময় হয়। স্বজন সহ পরিবারের সবাই খুশি। বলতে গেলে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয়ের হিসাবনিকাশ তিনি ছেলেদের নিকট থেকে জানতে চাইলেন এবং বললেন বাসায় গিয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে আরাম করে ঘুমাতে ও শুঁটকি দিয়ে মজা করে সবাইকে নিয়ে বাসায় ভাত খেতে। সার্বক্ষণিক নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মায়ের শয্যাপাশে বসে থাকা ছোট ছেলেকে তিনি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার নির্দেশ দিলেন।
তিনি সবসময়েই চাইতেন তিনি যেন কাউকে কষ্ট না দেন। সুস্থ দেহে গানে গানে তাঁর যেন মরণ হয়। মায়ের নির্দেশ শংকর রায় বর্মণ কিছুতেই মানলেন না। মাকে নিয়েই বাসায় ফেরার সংকল্প করলেন। মায়ের অবস্থার উন্নতি দেখে বড় ছেলে ভবতোষ রায় বর্মণ আশায় বুক বাঁধেন। শুধু তা-ই নয়, মনে মনে সংকল্প করেন মা সুস্থ হয়ে ফিরে গেলে তাকে একটি বড় চিতল মাছ খাওয়াবেন। নিয়তি রড়ই নির্দয়। তা আর হলো না। হৃদয়ের বাসনা হৃদয়েই রয়ে গেল। তিনি ২৭ আগস্ট ভোর ৬টায় দেহ ত্যাগ করেন। মায়ের শয্যাপাশে বসে থাকা বড় ছেলেকে তিনি মনের খেয়ালে বলেছিলেন, ‘বাবা, চিন্তা কইরো না, আমি রাইত মরতাম না। আমার মরণ সকালেই অইব, যাও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও। সকালে আইও।’ মায়ের খেয়ালি কথাটা শংকর রায় বর্মণ এবং ভবতোষ রায় বর্মণ সহজে মেনে নিলেন না। তারা শিয়রে বসেই রাত কাটালেন এবং সকালে জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন মায়ের স্বর্গে যাওয়ার রথ দেখলেন। চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেন সেই পথ। আশা নিয়ে বাসায় ফিরে যাওয়া মানুষদের ভিড় জমলো হাসপাতালে। সবাই শেষ দেখা দেখলেন। সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সিলেটের চালিবন্দর শ্মশানঘাটে তাঁকে দাহ করা হলো।
যা-ই হোক, চন্দ্রাবতী রায় বর্মণের দেহ ত্যাগ মানে প্রস্থান নয়, নয় বন্ধন-ছিন্ন-করা আর্ত রজনী। তার অনেক কিছু রয়ে গেছে এই না-থাকা জুড়ে।
গানের পাখি চন্দ্রাবতী
চন্দ্র কথা কয় না,
সুরের গলা নিথর করে
চলে গেল ময়না।
সজলকান্তি সরকার রচনারাশি
গানপারে চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ
- ছাপ্পা বানাউরা বেডা || সজলকান্তি সরকার - September 11, 2025
- আমার গল্পগুরুগণ || সজলকান্তি সরকার - September 2, 2025
- চন্দ্রাবতী মাসিমার জন্মদিন ও জীবনাবসান || সজলকান্তি সরকার - August 28, 2025
COMMENTS