“আকাশে সূর্য ওঠে / পুকুরে পদ্ম ফোটে / হৃদয়ে কুটনো কুটে”… না, বাকিটুকু মনে পড়ে না, বাকিটুকু সেন্সর্ড, মাইরি বলচি ঠাকুরপো, বাকিটুকু ইয়াদ হয় না। বরং এইটুকু মনে পড়ে : “সকালে ভাত খাবো না / রাতেরা আমায় খাবে” … ইত্যাদি। কিন্তু গানটা, কার না মনে আছে, আমাদেরে অসংখ্য দুপুর জারুলতলায় বা পামগাছে ঘেরা সেই দিঘিটির তীরে বা সেই অডিটোরিয়ামের পেছনকোণের বেঁটেখাটো অপরিসর কোনাকুনি সিঁড়িতে সঙ্গ দিয়েছে একটানা একটি জীবনব্যাপী! এই গানের জন্ম আর আমাদের উন্মেষপর্ব একসূত্রগ্রথিত। আমরাই তো আনিলাম ধরণীতে এই গানটারে।
অ্যানিওয়ে। এখন তো “দিন যায় সন্ধে ঢলে / গরুতে হাম্বা বলে” … এই গানটার একটা মিনিং আমরা তখন করতাম, মনে পড়বে নিশ্চয়, পলিটিক্যাল সিগ্নিফিক্যান্সমার্কা মিনিং। খোল-করতাল-হার্মোনিয়্যম সহযোগে এমন একটা কাওয়ালিঝুমতাল তৈরি করত গানটা আমাদিগের পেটরোগা-প্রেমাসক্ত তখনকার মরমে যে এর একটা আর্থসংগঠনগত বৈভববিত্ত বের করতে না-পারলে যেন চলছিল না আমাদের। এমনটা চালু ছিল তখন যে সবকিছুর সঙ্গে একটু সমাজবিপ্লব ব্যাপারটা পাঞ্চ করতে না-পারলে মানহানির ঘটনাই ঘটত বড়-রকমের। অচিরে এই গানটারে একটা বিপ্লবভূমি দিতে আমরা সক্ষম হয়েও উঠি বটে। এর লিরিক্সটেক্সট থেকে একটা সাহায্য-সহযোগিতা আসে ‘মাধবী’ শব্দের মারফতে। এমন লাইন রিফ্রেইনের ন্যায় ফিরিয়া-ফিরিয়া বাজতে থাকে — “বলি কি হে মাধবী / তুমি কী আমার হবে”… “বলি কি ও মাধবী / তুমি আর আসবে কবে” … ইত্যাদি।
দিনেশ দাসের কবিতা পড়ে, কিংবা আরও অনেকের, যেমন সুভাষ মুখুজ্জের, আমরা তখন ‘চাঁদ’ বেচারার সঙ্গে মামা-ভাগ্নে সম্পর্কসুতো ছিন্ন করছি কিংবা পাকাপাকি ছিন্ন করেই ফেলেছি তদ্দিনে, চাঁদ ও কাস্তে দুই বিপ্লবী চিনছি ধীরেক্রমে, ‘এ-যুগের চাঁদ হলো কাস্তে’ ইত্যাদি রিসাইট করছি উঠতে-বসতে ধুমায়ে। সেই-সময় মাধবীকে পেয়ে বিপ্লব না-ভাবাই ছিল অস্বাভাবিক বরং। কবে আসবে তুমি, বিপ্লব, তুমি মম শ্যামের সমান ইত্যাদি, স্তিমিত হয়ে গেলেও অন্তিমের একটা ট্রেন্ডি উইন্ড আমরা পেয়েছিনু তখন। এই তুমিটারে সহপাঠিনী নিঠুর মধুহৃদি/স্যুইটহার্ট কল্পনা করলে রিডিকিউল করা হতো তখন, এখনও হয় দেখতে পাই। বিদ্রুপ, শ্লেষ, ব্যঙ্গ, ব্যজস্তুতির ছলে বড়-বড় কথাগুলিরে ন্যানো তরিকায় ছেঁটে ফেলানো, মকারি করা, সিরিয়াস মকারি — ইত্যাকার টেক্নিক তো চন্দ্রবিন্দুর ট্রাম্পকার্ড;— অনেক পরে যেয়ে এই নিষ্পত্তি-মীমাংসাগুলো পরিষ্কার করেছি। ভাগ্যিস, নইলে এখনও ওই ‘নোঙ্গর তোলো তোলো / সময়-যে হলো হলো’ অথবা ‘পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল’ বা ‘কারার ওই লৌহকপাট / ভেঙে ফ্যাল কর্ রে লোপাট’ প্রভৃতি জাগৃতিমূলক গানের বাইরে তেমন শোনা হতো না কিচ্ছু।
তো, চন্দ্রবিন্দুর ওই গানটা আমরা গানের বৈপ্লবিকতা মান্য করেই শুনতে ব্যগ্র হই নিজেদের বারোটা বাজানোর আগে। এমনিতে এই গানটা ফোক টিউনের টেমপ্লেইটে বসানো হলেও এর লিরিক্যাল ল্যাবিরিন্থ দারুণ সুন্দর। চন্দ্রবিন্দুর অন্য সমস্ত গানে এই ল্যাবিরিন্থ লভ্য যেমন, সহুজে স্বরের লিরিক্যাল ইন্টেন্সিটি, পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিক রেফ্রেন্সেস প্রভূত পরিমাণে চন্দ্রবিন্দুসংগীতে বিদ্যমান। এবং প্রেমানুভূতির গান সৃজনে এদের পৃথক সাউন্ডস্কেইপ রয়েছে, খুবই সফ্ট টোন্যাল এফেক্ট, কন্টেম্পোরারি চিহ্নাবলির প্রেজেন্স, নার্সারি রাইমের রিদম ও মেট্রিক্যাল মেজারমেন্ট বজায় রেখে গান লেখা … ব্লা ব্লা … চন্দ্রবিন্দুর হলমার্ক উল্লেখ করতে বলা হলে এগুলোই বলতে হবে। এইগুলো তো অনবগত নয় আজ আর কারোরই।
কিন্তু বিপ্লব বলতে যে-একটা ভাতকাপড়ের বন্দোবস্ত টাইপের দুনিয়া-উল্টানো কাজকর্ম, সেইদিকে চন্দ্র্রবিন্দু খুব খেটেছে বলে মনে হয় না। আসলে আমরাই তখন সমস্তকিছুতে একটা হালফ্যাশনচিহ্ন জুড়ে দিতে চাইতাম। অর্থারোপ করতে চাইতাম ‘জলের মতন ঘুরে ঘুরে’ কওয়া কথাগুলোর উপরেও। দরকার নাই, কিংবা আসলে একদমই ঠিক নয় এমন কাণ্ড, বুঝেছি কিছু বছর অতিক্রান্ত হলে পরে। এইসব নিয়া আমাদের ভাবার বেইল ছিল না তখনকার দিনে, চর্কির মতো চক্কর দিয়ে ফিরছিলাম আমরা জীবনের চারিপাশে, এখন বোধহয় বেইল হয়েছে ভাবার, যদ্যপি বার্ধক্যজনিত কারণে ভাবনাচিন্তনে অনীহা আসছে দ্রুতবেগে।
অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন। আলোচ্য গানটার মজাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এতে ব্যবহৃত সম্বোধনপদ, ‘রিকশাওয়ালা’ এর ন্যারেটর, কিন্তু কোথাও একবারও রিকশাওয়ালা শব্দটা স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণে রেন্ডার না-করে এর যে অপনিহিতি, সেইটা মারাত্মক। আমি যে রিস্কাওলা … আমি যে রিস্কাকবি … আমি যে রিস্কাসোনা … ইত্যাদি। বিপ্লব তো যস্মিন দেশে যদাচার হওয়াই ঈপ্সিত। গানের জগতে বিপ্লব করতে যেয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া গানের কথায়-সুরে বক্তিমা বাজাইলেন, হু কেয়ার্স। কিন্তু এই একটা অপনিহিতি কীভাবে উৎকর্ণ করেছে একটা টাইমের শ্রোতাকে, এইটার সাক্ষি তো আমরাই, তাই না?
যাউক, বলি যে এই গানের এই লাইনগুলো দুর্ধর্ষ লাগে আজও : “জলে যায় জলের পোকা / স্কুলে যায় কোলের খোকা / বসে রয় হদ্দ বোকা / দু-চোখে তোমার ছবি” … কিংবা ধরো, ওই যে, “বরাবর পাগলা ভোলা / নিশিদিন ফুল কুড়াবে” — সেইটাই, না? আমরা তো তা-ই করছি, নিশিদিন ফুলই তো কুড়ায়ে চলেছি, তুমি হয়তো মরুগরমের দেশে অ্যারাবীয় জলপাইফুল, আমি বাংলার বরইপুষ্পসৌরভ। চলুক। ফুলফুটানি ফুলকুড়ানির দিন। অনাদি, অন্তহীন।
‘ত্বকের যত্ন নিন’ অ্যালবামে, সেকেন্ড/থার্ড চন্দ্রবিন্দুতে, এই গানটা পাওয়া যায়। কিন্তু সেজন্যে নয়, আমি ভাবতে বসেছিলাম এই গানটা ‘রিসকাওলা’ না ‘রিকসাওলা’ স্পেলিঙে অ্যালবামের খাপের ফ্ল্যাপে লেখা ছিল। কনফিউজড। ক আগে না স আগে, কে জানে, ক্যাসেটখাপগুলা থাকলে দেখে পরে বলা যেত। উইকিপিডিয়ায় যা দেখাবার দেখাক, শ্রোতার কানের স্মৃতি দিয়া গানের নির্ণয় হোক। অ্যালবামে এগারোটা গান সুকুমার সেনের মতো আদি, অকৃত্রিম, অপূর্ব ও অনবদ্য।
—জাহেদ আহমদ জানুয়ারি ২০১৫
- মাধবী, বিপ্লব ও অন্যান্য মদন প্রসঙ্গ - January 24, 2025
- জানালাবায়োস্কোপ - January 23, 2025
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
COMMENTS