সাহিত্যের সাম্প্রত ও চিরায়ত নকশা

সাহিত্যের সাম্প্রত ও চিরায়ত নকশা

পদার্থের তিন অবস্থার কথা আমরা বেবাকেই জানি। লিক্যুইড, স্যলিড এবং বায়বীয়। বঙ্গে এই তিনের আরও অন্তত শতেক স্তরবিন্যাস সহস্রেক ভার্শন তো রয়েছেই সামাজিক-বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে। এর মধ্যে না-লিক্যুইড, না-স্যলিড, না-বায়বীয় — অত্যন্ত এলিমেন্টারি কিছু নজির; যেমন রয়েছে না-প্রেমিক না-বিপ্লবী, না-তাত্ত্বিক না-কবি … ইত্যাদি। কিন্তু তত্বীয় ও ফলিত সায়েন্সে, কেমেস্ট্রি কি ফিজিক্সে, ন্যাশনের স্ট্যাটাসটা আদতে কোথায় দাঁড়ানো? বৈজ্ঞানিকতা আছে ম্যে বি, বিজ্ঞান কই! রিলিজিয়ন? মুখে-মারা বিশ্ব, বৈষ্ণব ও সুফিত্ব; ধর্ম নাই, কিন্তু ধার্মিকতা আছে; এবং উল্টা, ধার্মিকতা পাওয়া গেলে সেথাকার ধর্ম হদ্দ গোঁড়া; ক্যাঁচালপাড়া আছে আস্তিক্যে-নাস্তিক্যে বেহুদা; খালিপেটে ঘুমাইতে যাবার আগে রোজ রাইতে গোটা জাতি দ্বিবিভাজিত হয়ে নেঙ্গুটি কষে বেঁধে একপ্রস্ত ঝগড়াখিস্তি করিয়া লয় আল্লা আছে না আল্লা গ্যেছে হেন থোড়-বড়ি-খাড়া পারলৌকিক প্রতর্কে; এদিকে নেপোয় চিরকাল দই বিলিবণ্টন করিয়া খায় এবং এঁটো করে রাখে হেঁশেল ও গোয়াল। ওইদিকে দ্বিদলীয় তর্কসভা আল্লার পশ্চাদ্ধাবন ছাড়িয়া রাজার দিকপানে একবারটির তরেও নজর নিবদ্ধ করে না। মার্ক্সের মেনিফেস্টোর পয়লা বাক্যটার স্মৃতি মনে রেখেছেন যারা, কার্ল মার্ক্স আদ্যোপান্ত পড়ার ডাহা মিথ্যা দাবিটা করেন না যারা, তারা খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন কোন প্রেতচ্ছায়া তাড়া করছে এই বিতণ্ডাব্যস্তধস্ত দেশকাল। লক্ষ করব যে হেথা সাহিত্য নাই, কিন্তু সাহিত্যিক ও সাহিত্যিকতা আছে ব্যাপক পরিমাণে; সেই হিসাব আমরা বর্তমান নিবন্ধে একটু-একটু — অত্যন্ত আংশিক অবশ্য — লইব। দুনিয়া-কাঁপানো গবেষণাবীণা বাজাইয়া বাংলার তথা বাংলাদেশের সাহিত্যের সুলুকসন্ধান দুঃসাধ্য। অতএব আমরা আখাম্বা — প্রায় তালগাছদীর্ঘ — অভিনব উপায়েই আমাদিগের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিব। তথাস্তু।

হপ্তাসাহিত্য
বাংলাদেশের সাহিত্য এখন, অথবা বেশ বহুদিন ধরিয়া, সাপ্তাহিক আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে কি না ভাবা দরকার। একটু বয়সটয়স হলে লেখকদের তূণে তেমন দশাসই তির থাকবে না, তাই তারা কেবল তিরন্দাজতালিকায় তাহাদের নামলিপি হেরিয়া বিমল পুলকে ভাসিতে চাইবেন, এইটা আদৌ অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যারা কি-না তরুণ, তরুণতর যারা, তারাও যদি গাণ্ডীবে-গা-কাঁপুনি শৃগালজ্বরে কুঁচকে থাকেন, অস্বাভাবিকতার তীব্রতা তখন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে বৈকি। আর্টকালচারের এই হপ্তাহিক আহ্নিকসর্বস্বতা ভয় পাইয়ে দেয় আমাদিগেরে। যে-কথা বলছিলাম, বাংলাদেশের সাম্প্রত সাহিত্যপ্রকাশ ও সমুদয় শিল্পানুশীলন সপ্তাহান্তে বেগুনি কি লাল বা হলুদ এমনকি আসমানী রঙের একগাদা নামে-ভিন্ন-কামে-এক দৈনিকের দেড়-দুই পৃষ্ঠার লিটারারি সাপ্লিমেন্ট বা সাহিত্যসাময়িকী জুড়ে স্রেফ স্কুলশিক্ষার্থীদের রচনালিখন প্রতিযোগ ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের বেশি কিছু নয়। দেখবেন যে, এক বা দেড় বা বড়জোর তিনপাতার ভেতরে আঁটানো দরপত্রবিজ্ঞপ্তির ফাঁকে-ফোকরে ফিলার হিশেবে বেশকিছু বস্তুপিণ্ড হপ্তান্তে ছেপে বেরোচ্ছে, এবং আপনার বাসার পত্রিকাদাতা বাণিজ্যসহায়ক হকার ব্যক্তিটি সেই পাতাটিকে প্রায়শ অদরকারি বিবেচনা করে পত্রিকাবান্ডিলের ভার কমাইতে রাস্তার ধারস্থ পয়ঃনিষ্কাশক নালায় ফেলে আসেন। মনটা দারুণ বিলা হয় আপনার, হকারের ওপর, যদিও বঙ্গসাহিত্যসতিন ঠোঁটকাটা আপনার এক বন্ধুয়া আপনাকে বলে যে হকার প্রকৃত প্রস্তাবে জিগ্রি-দোস্তের কাজটাই করেন। তখন আপনি কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হন বটে। সেসব প্রসঙ্গ পরে বলা যাবে নে। এইসব সাময়িকপাতায় বিষয়বস্তু তথা কন্টেন্ট বা বক্তব্যবস্তুর চেয়ে বক্তব্যপ্রদায়ক ব্যক্তিটির নাম তুলনামূলক বড় হরফে ব্রডকাস্ট হইতে দেখা যায়। যেই জিনিশটা যা-হোক ছাপা হইল পঠনোদ্দেশ্যে, একবার সিপ্ করে দেখুন, অনুসরণ করে যেতে যদি পারেন কিয়দ্দুর, দেখবেন যে, ন্যাক্কারজনকভাবে এইসব মালসামানের উপর হইতে আপনার আগ্রহ উবে যাচ্ছে। এবং আপনি যারপরনাই নিরাশ হেন অনাব্য অবস্থা টের পেয়ে। কেমন শোচনীয় ও সকরুণ হয়ে গেছে খেয়াল করে দেখবেন আমাদের চিন্তারাজ্য ও কল্পনাধাম, খেয়াল করে আপনি ইতোমধ্যেই হয়তো রয়েছেন কিংকর্তব্যভোঁতা হয়ে। যেমন ধরেন, পত্রিকাসাময়িকী রিয়্যাল্ সেন্সে হাতে ধরে রেখে কথা বলতে হবে এমন কোনো বাধকতা নাই যদিও, মনে করেন, ছাপা হয়েছে রেইনি ঋতু তথা বর্ষা বিষয়ে কয়েক লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবির গদ্য। খুব খুঁটিয়ে পড়তে হবে এমনও নয়, ইফ য়্যু জাস্ট গো-থ্রু দিজ্ থিংস্, দেখবেন যে, এগুলো অন্তরাত্মায় একেকটা হাইস্কুলছাত্রের পরীক্ষাপাশের উত্তরপত্র বড়জোর। ছিঁটেফোঁটা কামনাবাসনা-কারুকল্পনার গন্ধও উহাতে নেই। বিকট কিসিম কারবার বস্তুত। নো-ডাউট মালগুলো সব দর্শনীয়। রবীন্দ্রনাথের অজস্র চিঠিপত্রে বাংলাভূগোলের বর্ষাচিত্র অথবা প্রমথ চৌধুরীর সেই বিউটিফ্যুল্ বর্ষাগদ্য-কয়েকটি লিখিত হইবার পরে একজন বাংলালেখকের বর্ষা-উপজীব্য-করে-লেখা গদ্যরচনা কেন একইঞ্চি না-আগায়ে তেরোশত নদীসমুদ্দুর মাইলের পশ্চাতে পড়ে রইবে! এ তো গেল ঘটনাদিকের একটা, আরও কতিপয় মিষ্টি মিষ্টি দিগদিগন্ত রয়েছে এ-প্রসঙ্গে।

ঘণ্টাসাহিত্য
তুমি আমার ঘণ্টা করতে পারবা — এই বাক্যে ঘণ্টা যেমন তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হইতে দেখি, যার আল্টিমেইট মিনিং হইল যে তুমি ইন-ফ্যাক্ট আমার কিচ্ছুটি করতে পারবা না, যাও, হিন্দি চুল ছিঁড়া আঁটি বান্ধো গা — আমরা হামেশা এমন বাক্য বলিয়া থাকি, লিখিয়াও থাকি মাঝেমধ্যে, যেমন এখন এখানে লেখা হইল। ভবিষ্যতে লেখা হইবে এরচেয়ে ব্যাপকতর। বর্তমানে এই হিন্দি-উর্দু চুলের সাহিত্যে সয়লাব হয়ে আছে দেশগাও। তো, আলোচ্য ঘণ্টাসাহিত্য শব্দে ঘণ্টা উপসর্গটি ঠিক ওই অর্থে প্রযুক্ত হয় নাই স্বীকার্য। ঘণ্টাসাহিত্য খুবই ডিগ্নিটিফ্যুল্ হইতে পারে, প্যাডিফিল্ডে একাধটু চোঁচা থাকতেই পারে, অ্যানিওয়ে। এখন ঘণ্টাসাহিত্যের একটা ডেফিনিশন তো সেট করা লাগে। এইটা আদৌ প্রোব্লেমের কিছু না, সংজ্ঞা একটা বানানোই যায়। যেইসব সাহিত্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় পয়দা ও প্রকাশিত হয়, এবং যুগপৎ যা আপনার জীবন আলোকিত ও অন্ধকার করে রাখে, তাহাই ইহা, আই মিন্ ঘণ্টাসাহিত্য। জন্ম দিয়া কারো ও কোনোকিছুর গুণবিচার কাজের কিছু না, ব্যাপারটা খণ্ডিত ও একপেশে হয়ে যেতে পারে তখন। ঘণ্টাসাহিত্যেও উন্নত দ্রব্যাদি বিরলদৃষ্ট নয়, কিন্তু খুব সুলভও বলা যাবে না। কাজেই নিপাত যাক ঘণ্টাসাহিত্য — এমন ম্যুভমেন্টে এই বান্দা নাম রেজিস্টার করতে একদম গররাজি। জিনিশটা খারাপ না তো, ডেফিনিটলি, নেসেসিটি আছে তো ঘণ্টাসাহিত্যের। পড়ুন না-পড়ুন, চোখে-যে পড়ে জিনিশটা, মানে ঘণ্টাসাহিত্য, আর কিছুটা বা কখনো-কখনো অতিমাত্রায় ইরিটেইটিং হলেও ঘণ্টাসাহিত্যে একটা কালার্ফ্যুল্ ব্যাপার রয়েছে। এই জিনিশ লাইফটাকে একটু রম্য করিয়া রাখিতে সহায়ক। প্রশ্ন অথবা অনুসন্ধানীয় ঘটনা বাকি থাকে একটাই, সেইটা হইল, কই গিয়া পাইব উহারে আমি? কোথায় মেলে ঘণ্টাসাহিত্যের খোঁজ? ঘণ্টাসাহিত্যের সূতিকাগার হলো অন্তর্জালের কিছু/অসংখ্য নিউজ-বেইজড ওয়েবপোর্টালের সাহিত্যফোল্ডার। অসম্ভব ও অভাবনীয় দ্রুতগতিতে সেইসব জায়গায় লিট্রেচার পাব্লিশ হয়। লিট্রেচারের স্ট্রেচারে চিৎ শুইয়া আপনি ইহকাল হইতে এক্সিট করিতে পারিবেন অনায়াসেই। জীবনে সাহিত্য করাকরি এখন অনেক সহজতর ও সুগম হয়েছে এই ঘণ্টাসাহিত্যের সুবাদে। এখানে প্রসঙ্গচক্রে উল্লেখ্য যে, বেশকিছু ওয়েবম্যাগাজিন রয়েছে যেইগুলো ব্যক্তি-উদ্যোগে সঞ্চালিত ও পুরোদস্তুর সাহিত্যসমর্পিত, সেইসব লিটারারি ওয়েবম্যাগগুলোতে আলোচ্য ঘণ্টাসাহিত্য জন্মায় না। আবার সোশ্যাল ব্লগ কম্যুনিটিগুলোতে যা আচরিত ও অনুশিলীত হয় তা-ও ঠিক ঘণ্টাসাহিত্য নয়, সেই প্রসঙ্গে একটু পরে এন্টার করা যাবে। অ্যানিওয়ে। হপ্তাসাহিত্য বলেন বা ঘণ্টাসাহিত্য, সবই-যে হিন্দি-উর্দু চুলের বাহার বা সবাই একবাক্যে হিন্দি-উর্দু চুলের বেওসাদার বা বাংলা বালের, এমন দুর্বাক্য বলবার মতন বিপ্লবীপনা আমার ধাতে নাই। মিথ্যা-সত্যি বিচারসালিশেও আমি যাইতে চাই না এ-নিয়া। কারণ অনলাইন অ্যাক্সেস্ যদি থাকে আপনার, এই বিনোদনরূপশালী দিনে, তো দুনিয়াটা আপনার কাছে ডেফিনিটলি মজার বলে প্রতিভাত হইতেছে, এবং মজা সবসময় লুটিবার, কম্পারেটিভলি মাগনা মজা হইলে তো অধিকতর উমদা ব্যাপার। তো, মারি তো মশা, আর লুটি তো ঘণ্টাসাহিত্য, এইটা আজকাল অনেকেরই লাইফের মটো বলতে পারেন।

মুহূর্তসাহিত্য
সহজেই অনুমেয় মুহূর্তসাহিত্য জিনিশটা — তার নাম শুনিয়াই। কিন্তু কর্ণে শোনা আর সম্যক বোঝা আদৌ সমান তো নয়। কাজেই জিনিশটা খানিক খোলাসা করা দরকার। তবে এইটা তো পরিস্কার যে, — মুহূর্তে এর জন্ম, মুহূর্তে স্ফূরণ, মুহূর্তে এর প্রকাশ, চোখের সমুখে একমুহূর্তে এসে ফের পরমুহূর্তেই মিলাইয়া যাওয়া তার কমন্ বৈশিষ্ট্য। অবশ্য মুহূর্তসাহিত্য নট-নেসেসারিলি মুহূর্তস্থায়ী, এর ব্যাপ্তি মুহূর্ত ছাড়িয়ে এমনকি কথিত মহাকালবিস্তারী হওয়াও খুব বিচিত্র কিছু নয়। কে অবশ্য খবর রাখে মহাকালের — এ এক গুরুপ্রশ্ন, উত্তরের অপেক্ষা না-করাই উত্তম। বলা যাবে না তা-বলে যে মুহূর্তসাহিত্যের উৎপত্তি নিছক মুহূর্তেরই চিপাচাপায়, বিস্তার তার মুহূর্তের তরে, এমনও বলা যাবে না যে হর-কিসিমের মুহূর্তসাহিত্য শুধু মুহূর্তেরই পার্পাস সার্ভ করবার নিমিত্তে নির্মিত। মুহূর্তে-গড়ে-ওঠা সাহিত্যের নেপথ্যে একটা আবহমান মন ও মনন যে একেবারেই ক্রিয়াশীল নয়, এমন কথা তো হলফ করে বলা যাবে না। তা না-হয় একপদের মেনে নেয়া গেল। কিন্তু মুহূর্তসাহিত্য বস্তুটার উদাহরণ দুইয়েকটা সামনে এনে দেখাইলে একটু সুবিধা হইত। উদাহরণ হুটহাট প্রদর্শন ও পরিবেশন কিঞ্চিৎ রিস্কি জেনেও ট্রাই করছি। বিস্তর সোশ্যাল ব্লগ কম্যুনিটিগুলোতে যেমনধারা আর্টিক্যল্-কবিতা-গালগল্প-কলাম প্রভৃতি উপর্যুপরি বিজুলিঝিলিকের ন্যায় ছেপে বেরোতে দেখা যায়, এইটা প্রাথমিক বিবেচনায় মুহূর্তসাহিত্য বটে, অ্যাট-লিস্ট প্রকাশমাধ্যম ও উপস্থাপনগত দিক/দিগদারি বিচারে এইটা মুহূর্তসাহিত্য। মুহূর্মুহূসাহিত্যও বলতে পারেন, যদি চান। মুহূর্তসাহিত্য, অথবা মুহূর্মুহূ, যে-নামেই সম্বোধন করি-না কেন, সম্প্রতি এইটা অনেক স্ট্রং ভূমিকা রাখছে লেখালেখিশিল্পাঙ্গনে। এইটা আজই বোঝা না-গেলেও অচিরে এর অবদান ঠাহর করব আমরা। আর মুহূর্তসাহিত্য অসংখ্য আইটেমের, উহার রকমফেরের ইয়ত্তা নাই, ফিরিস্তি না-দিয়ে এক-দুইটা উল্লেখ করা যাইতে পারে বড়জোর। যেমন ধরুন ফেসবুকে যে-সমস্ত স্ট্যাটাস ও কমেন্ট প্রভৃতি করা হয়, এইগুলো মুহূর্তসাহিত্যের আকরিক বলতে পারি আমরা। কালক্রমে এই আকরিক হইতে একজন/একদল খনিবিশারদের মধ্যস্থতায় এসেনশিয়্যাল্ ধাতু নিষ্কাশন অসাধ্য হবে না। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন, অনুরক্ত হচ্ছেন, কখনো কখনো ক্ষুণ্ন রীতিমতো, সবকিছু মিলিয়ে মুহূর্তসাহিত্যের বিশাল দ্বীপরাজ্য গড়ে উঠছে আপনারই বিরক্তি-অনুরক্তির অংশগ্রহণে। এখন ধরেন ফর্ম্যাল্ সাহিত্যে এমন অনেক জিনিশ আছে যেগুলো মুহূর্তসাহিত্য হইলেও লোকে সেগুলোরে মাথায় তুলে রাখে — যেমন ঠাকুরের স্ফুলিঙ্গ ও ক্ষণিকা জাতীয় কাজগুলো — কেন তবে আজকের ডাইভার্সিফায়েড মুহূর্তসাহিত্যকলা দাম পাবে না! পাবে, একদিন, ‘তুমি দেখে নিও দাদাঠাকুর’ — সুনীলের নাদেরআলি হলে এই কথাটা আলবৎ বলত। মুহূর্তসাহিত্য — সত্যিই, ইন্ডিভিজুয়্যাল্ অভিমত এইটা, — হপ্তাসাহিত্য-ঘণ্টাসাহিত্যের চেয়ে ঢের বেশি ইফেক্টিভ। এর ইফিশিয়েন্সি এবং ইম্প্যাক্ট অনেক স্ট্রেংদেন্ড। হুট করে এর গড়-মধ্যক-প্রচুরক বের করা চাট্টেখানি কথা না বিধায় একে গবেষকপ্রিয় করে তোলা যাবে না তা জাজমেন্টবাক্যায়িত বলে দেয়াই যায়। তাই বলে এর গুরুত্ব খর্ব হয়ে যায় না। আরেকটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ফেসবুকে যে-নোটগুলো পয়দা হয়ে চলেছে হররোজ, এইগুলো মুহূর্তসাহিত্যের আওতাভুক্ত কি না। তা, ইজি অ্যান্সার এ-মুহূর্তে নাই। কিন্তু নোটকারদের কথাবার্তা থেকে এর একটা ইশারা আমরা খুঁজে দেখতে পারি। ইট ইজ্ ট্রু যে এইটা জঁর হিশেবে এখনো দাঁড়ায় নাই, এর কোনো টেক্সোনোমি টিল্-ডেইট গড়ে ওঠে নাই, এইটা এখনো ক্লাসিফায়েড না। আজকাল নোটও তো আগের মতো ওইভাবে লেখা হচ্ছে না। তা, যারা নোট লেখেন, তাদিগের আচরণ ও বাচিক বিবৃতি লক্ষ করুন। ধরুন, একজনের নোট পড়ে আপনি ক্রিটিক্যালি নোটের অ্যাপ্রিশিয়েট করতে যেয়ে বলে ফেললেন যে হে বেহেনে অৌর ভাইয়া আপনার নোটটা ভালো লাগলো ও ভাবালো খুব। ওমা! খাপ্পা হয়তো হবেন না তিনি, যেহেতু পজিটিভলি জিনিশটার পরিস্কার প্রশংসাই করেছেন আপনি, কিন্তু কৌশলে ঠিকই মনঃক্ষুণ্নভাব প্রকাশিয়া জানিয়ে দেবেন আপনারে যে এইটা তো নোট না, এইটা পূর্ণাঙ্গ রচনাই। আবার যখন আপনি নোটটাকে লেখা হিশেবে সশব্দ প্রশংসা করছেন, অথবা বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করছেন, তখন তিনি বলছেন এইটা নাকি নিছক নোট একটা, এবং বলছেন যে এই নিয়া বারো সর্গের একটা মাইকেলী মহাকাব্যিক থিসিস্ তিনি দিন-কয়েকের মধ্যেই নামাইতে চলেছেন ধরাধামে। এই-রকম সিচ্যুয়েশন্, অ্যানিওয়ে, কনক্লুশনে ল্যান্ড করবার দরকার নাই। কিন্তু কথাটা হলো, মুহূর্তসাহিত্য তো ফেলনা না মোটেও। ক্ষণিকের জন্য ফোটা ড্যাফোডিলই তো একমাত্র ফুল না, লাইফ-ডিউরেশনের বিবেচনায়, বস্তুত দুনিয়ার সমস্ত পুষ্পই প্র্যাক্টিক্যালি ক্ষণস্থায়ী। ইত্যাদি নিয়া আলাপ অধিক লম্বা না-করে এইখানে এসে নটেগাছটা প্যাকেটে মুড়িয়ে আপাতত পকেটে পোরা যাক।

মহাকালসাহিত্য
জুম্মাবারগুলোতে এদেশে একটা কাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়ে আসেছে সেই তিতপুরানা আদিকাল হইতে, হেমন্ত-বসন্ত-বর্ষাবাদলি মিস্ নাই, একে আমরা আগেই হপ্তাসাহিত্য আখ্যা দিয়াছি। কিন্তু মহাকালসাহিত্য উৎস ও বিকাশের নিরিখে এই হপ্তাসাহিত্যের একটা এক্সটেনশন্ বলা যাইতে পারে। অ্যাট-লিস্ট মহাকালসাহিত্য প্রোজেক্টের পাইলটিং হয়ে থাকে এখানে, এই ফি-হপ্তার গাদাগুচ্ছ পত্রিকাদৈনিকীর রঙচঙে সাময়িকী-ক্রোড়পত্র-কড়চাগুলোতে। লেখকেরা, — যারা এসবের কন্ট্রিবিউটর/প্রদায়ক-পার্টিসিপ্যান্ট, বেনিফিশিয়ারিও তারা, আরেকদিক থেকে স্টেইকহোল্ডার বলতে তেনারা ছাড়া আর কারা, — তা-ই মনে করেন অন্তত। তবে মহাকালসাহিত্যের গ্র্যান্ড-ফিনালে হচ্ছে একেকজন লেখকের একেকটা বই। সিমেন্টজমাট গাব্দাগোব্দা গাগতরের উৎকট বর্ণাঢ্য বই। কিন্তু বই বলতেই-যে মহাকালসাহিত্য সংরূপের অন্তর্ভূত, নট দ্যাট, বইটা আলবৎ হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং হইতে হইবে, পেপারব্যাক্ বাইন্ডিং বইয়ের জন্য মহাকালে কোনো কুলুঙ্গি বরাদ্দ নাই। কিন্তু হপ্তান্তে পত্রিকাসাময়িকী কিসিমের শামিয়ানার তলে সমবেত লেখকমাত্রই মহাকালসাহিত্যের জয়তিলক লভিতে সম্ভাব্য হকদার, এতে কোনো সন্দেহ পোষণ চলে না। আমরাও চাই, — নিতান্ত দুব্বল ও অবলা পাঠক আমরা, — যারা কি-না সাংঘাতিক শক্ত বন্ধনের একেকটা বই বিস্তর স্বপ্ন ও শ্রম লগ্নিপূর্বক অতি ক্লেশে মহাকালের মান্দাসে উঠিয়েছেন, সকলেই তারা যেন মহাকালদোরগোড়ায় যেয়ে একটা অন্তত গ্রুপফোটোসেশন্ করতে পারেন। সকলের মুখে যেন রহে রৌদ্রকুচিকিরণ, ব্রাইট স্মাইল, রহি রহি ঝরে যেন সকলের মুখ ঠিকরে ওম-স্বস্তি ফ্রিস্টাইল মহাকালের মিষ্টি প্রশান্তিনিশানের আলো। মহাকালসাহিত্য সম্পর্কিত গুপ্তবিদ্যা অর্জনের জন্য বহু খড়-কাঠ-কেরোসিন কালেক্ট করতে হয়; লেকিন্ সুদূর চীনদেশে যেয়েও ওই বিদ্যার্জন মুফতে এসে যাবে হাতে — এমনটা আশা বাতুলতা। আমরা খালি এটুকু জানি যে, মহাকালসাহিত্যের মোচ্ছবে কবিরা আগুয়ান কথাশিল্পী-সিনেমানির্মাতা-প্যাকেজনাট্যকারদের তুলনায়, — এই এগোনোটা গায়ের জোরে না অন্য কোনো বাতেনি হিম্মতে, এতদবিষয়ে এই রিপোর্টার পুরা আন্ধাইরে এখনো। তবে কবিদের বিবৃতি যদি গ্রাহ্যে নেয়া যায়, — নিতে একপ্রকার বাধ্যই হতে হয় বেশিভাগে হয়তো, — তখন বলতে হবে যে কবিই স্বয়ং মহাকাল, যদিচ প্রত্যেক কবির ঘোষণা তার তার নিজের, এবং এক কবি তার সমকালীন আরেক কবিরে মহাকালদরিয়াপারের খেয়ামাঝি তথা ঈশ্বরী পাটুনির পদটা দিতেও নারাজ। যা-ই-হোক, মহাকালসাহিত্য চাষবাসের এবং এই সাহিত্যে কামিয়াবি হাসিলের একটা নির্ধারিত সিজন্ তথা ঋতু রয়েছে। সেক্যুলার ঋতুটি ফেব্রুয়ারি, যখন বইমেলা আয়োজিত হয় একটা প্রাচীন বটতলে, ঋতুব্যাপ্তি আঠাশ দিন সর্বসাকুল্যে, যদিও অধিবর্ষে একটি দিন বোনাস্ পাওয়া যায়, এইবার ২০১৯ থেকে মেলা মার্চ পর্যন্ত পাখা বিস্তার করেছে, একদিন বছরভর শুধু বইকিনাবিকি হবে কিন্তু পড়াপড়ি নিপাত যাবে চিরতরে এমন স্বপ্নই দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-গোষ্ঠী। হিন্দুমুসলমানবৌদ্ধখ্রিস্টান নির্বিশেষে এই দেশে একটি ঋতু মহাকালসাহিত্যমহোৎসব হিশেবে সেট করে নিয়েছেন, রোজাঈদের মাস, দৈনিক পত্রিকাগুলো মহাকালসাহিত্যস্বপ্নজীবীদের এই সিজনে নাইলনের রশি দিয়া বান্ধিয়া লাইনে দাঁড় করায় দেখতে পাই, শৃঙ্খলা না-থাকিলে মহাকালমন্দিরের চত্বরে দাঙ্গা বাঁধিয়া যাইত অন্যথায়। এই ঋতুকাল পশ্চিমের দেশে একটু বাঁকানো, রোজাঈদ নয়, উনাদের চাষবাস ও শস্যকর্তন-উত্তোলনের সিজন্ মুখ্যত পূজার সময়টাই। কিন্তু মহাকালসাহিত্য লইয়া আমরা কি করিবাম — এহেন মজাদার সওয়াল তুলিয়াছিলেন কয়েক বছর পূর্বে মহাকালসাহিত্যের এক ম্যাগ্নেট মার্চেন্ট, জিন্দেগিভর মহাকালসাহিত্যের মণ্ডামিঠাই সাবড়ে খেয়ে সেই মার্চেন্ট কেন অমন দুঃখের গান গাহিয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা আজও অজ্ঞাত। যদিও কোনো কোনো মহল ওই মার্চেন্টের উচ্চারণে একটা গোপন মিশন্ অপারেট করার অভিসন্ধি আঁচ করিয়াছিলেন। সত্যি-মিথ্যা জানিনে … জানিনে … দেখেছি নিদারুণ মর্সিয়া মাতম উঠিয়াছিল মার্চেন্টের কাতর ধ্বনি শুনিয়া তাহার অনুসারীদিগের মাঝে। মনে বড় আশা তাদিগেরও তো — (মহোত্তম বদমাশ ও বলাৎকারসাহিত্যিকদের বর্তন-উপচানো রন্ধিত পদটা হচ্ছে এই আশা) — উনারা সব্বাই মিলিয়া যাইবেন মদিনায় … খাইবেন মহাকালের খোর্মা-খেজুর-গুড়-মুড়ি-মোয়া …। আমাদিগের সাহিত্যমার্চেন্ট — (পূর্বোক্ত) — অনতিবিলম্বে কিছু উল্টাসিধা কাশ্যস্বর ঝাড়িয়া খামোশ হইয়া যান। মহাকালসাহিত্যিকেরা তাদিগের হৃত আরাম ফিরিয়া পান, মহাকালের সুখস্বপ্নে বিভোর ডিভানে শুইয়া সাহিত্যরচনা গাজি-গাজি রবে ফের শুরু করিয়া দেন, হপ্তাসাহিত্যের ভেলায় চেপে মহাকালসাহিত্যের মূল নভোযানের দিকে নিশ্চিন্ত চিত্তে ফি-আমানিল্লা আগাইতে থাকেন। হপ্তাসাহিত্যই মহাকালসাহিত্যের ফুলশয্যা, বা বাসরঘর, তা অবশ্য মহাকালসাহিত্যরসিক সকলেই বিলক্ষণ অবগত। পুনশ্চ, দর্শনশাস্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ওই স্টোরিটেলার সম্প্রতি আরেকটা ব্লান্ডার করে ফেব্রুয়ারির প্রকাশ্য পোস্টারে কট খেয়েছেন। জনৈক ব্যাংকার কথাসাহিত্যকারের কিবোর্ডে রচিত বাংলায় বিশ্বসাহিত্য (অভিনব ও বঙ্গে এর নজির দুর্নিরীক্ষ্য বলিয়া জানাচ্ছেন মালদার ব্যাংকার-কথাসাহিত্যকার স্বয়ং) প্রোমোক্যাম্পেইনে মডেলিং করতে যেয়ে সেই করবীগাছের পিতা সাহিত্যসজ্জন বয়স্ক গল্পবালকটি স্বীকার-অস্বীকার-পুনঃস্বীকারের যেই কমেডি চালাইলেন তা বৃহৎ বঙ্গে বিরল নজির স্থাপিয়াছে। এই প্রৌঢ় গল্পবালকের আমলনামায় এহেন সজ্জন-সদাহাস্য অসততার ঘটনা এইবারই পয়লা না বলিয়া জানাচ্ছেন সার্কাসতাঁবুর চারিধার ঘিরিয়া থাকা তামিশকিরেরা। ফাইন্যালি জিনিশটা ধামা দিয়া চাপা দেয়া গেছে অবশ্য। তবে রেইটটা বাড়তি গেছে, ব্যাংকার মালদারের জন্যে সেইটা সমস্যা না বলিয়া জানিয়েছেন তিনি নিজেই। কিন্তু অসৎ গল্পপ্রৌঢ়ের সঙ্গে রেস্লিঙে ব্যাংকার বিশ্বউপন্যাসকার জিতলেও একটা পয়েন্টে উনি সিলি মিস্টেইক করে ফেলেছেন, পয়েন্টটা হচ্ছে যে যদি তিনি নিজেই লাখটাকার পোস্টার ছাপলেন এবং নিজহাতে সেইটা সাঁটলেন রাজধানীর কাঁচাবাজারের দেয়ালে-বাতিস্তম্ভে, হেভিওয়েট প্রকাশনীর সিলছাপ্পা মারলেন কেন পোস্টারনিম্নে? এ থেকে কি প্রতীয়মান হয় না যে এই বিশ্ববইটাও উনি নিজের ক্রেডিট কার্ডে ছেপেছেন অন্য সকল বঙ্গীয় কবিযশকামী ইয়াংদের মতো? অত বড়াই যদি করলেনই পয়সার তাইলে এই লুকাছাপা-ভানভনিতা কেন? অভিজ্ঞরা বলছেন, বলপয়েন্টের যুগ তো অবসিত বহুকাল হয়েছে, এখন লিখতে লেগে লাখ-লাখ স্বর্ণমুদ্রা বিনিয়োগ করতে হয় লেখকদেরে। কে বলেছে যে লিখলেই লেখক হওয়া যায়? লেখক হতে গেলে ব্যাংকার হতে হয় আগে, যেন প্রৌঢ় প্রোফেশন্যাল মডেলের মুখ দিয়া তিরিশহাজার সাইনিং মানির বিনিময়ে দেড়-মিনিটে লেখকনামটা ডাকানো সহজ হয়। ব্যাংকারের কাছে বাংলা সাহিত্যের মৃত ও জীবিত রথী-মহারথীরা কাতার বেঁধে হেরে যেতে লেগেছেন বলিয়া মহাকালের ব্যুলেটিনে নিউজ প্রকাশিত।

পূজাসাহিত্য/ঈদসাহিত্য
বস্তুটার ব্যাপারে এরই মধ্যে বেশ বলা হয়ে গিয়েছে। যেটুকু বলা বাকি তা এ-ই যে, এই সাহিত্যের সেই রমরমা আগের ন্যায় নাই আর। বিভিন্নমুখী মিডিয়ামের চাপে ও উত্তাপে এই সাহিত্যের দশা নাজুক হতে হতে নাশের দ্বারপ্রান্তে। এখনও চলছে এই সাহিত্য, অবশ্য এই চলাচলি বিজ্ঞাপনধান্দা না সাহিত্য তা নিয়া জনমনে বেজায় সন্দেহ রয়েছে। এখন পূজাসাহিত্য বাংলাদেশে তেমন-একটা সার্কুলেইটেড না। আর ঈদসাহিত্যও তথৈবচ। হুমায়ূন আহমেদ দেহ রাখবার পরে ঈদসাহিত্য অত্যন্ত ভগ্নদশায় স্রেফ বিজ্ঞাপনের পয়সা আদায়-উশুল উঠিয়ে একটু অন্নবস্ত্র জুটাইতেছে। এভাবেও খুব বেশিদিন চলবে বলিয়া আশ্বস্ত করা যাচ্ছে না। পাঠক খায় এমন আনাজপাতিরও যোগান ঈদসাহিত্য অফার করতে পারছে না। আর পূজাসাহিত্য তো অনেক আগে থেকেই বিদেশি বিবেচনায় বাংলা সাহিত্য হইতে পরিত্যাজ্য হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে নব্য-নব্য তরুণ প্রকাশকদের ফেব্রুয়ারিডিউরিং নব্য-নব্য প্রকাশনাসাহিত্য। বইসাহিত্য। বইদোকান খুলিয়া বসবার সাহিত্য। মহাকালের রিসোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাইবার এইটাই নির্ভরযোগ্য রোডরাস্তা আপাতত; রোডে নয়া নয়া পাব্লিশার-ড্রাইভারদেরও শনৈ শনৈ বাড়বাড়ন্ত।

উত্তর-মহাকাল/মহাকালোত্তর সাহিত্যসংবাদ
মহাকালের তোয়াক্কা যারা করেন না, তাদের জন্য সন্ধ্যাতারা আরেকটু সুপ্রভ হয়ে আদুরে আলো ছড়ায় প্রতিদিন — বলেন অত্যুৎসাহী কেউ কেউ। সমকালবাদী আমরা বা টু-বি-স্পেসিফিক্ এবং টু-বি-প্রিসাইজড আমি রিডার হিশেবে একটা আলতো কনফেস্ এইখানে করতে চাইব; সংক্ষেপে সেই স্বীকারোক্তি হবে এহেন : তরল-কঠিন-বায়বীয় ও অন্য যে-কোনো মাধ্যমে প্রেরিত আপনার সাহিত্য সোল্লাসে আমরা লুফে নেব, সন্দেহ অল্পই, কিন্তু মহাকালবাদীদের মন ভরাইবেন কেমন করিয়া তাহা হার্ডবাউন্ড রচক-কবিদেরে যেয়ে জিগ্যেশ করে দেখতে পারেন। তবে বাগদেবীর মন ভরাইতে চাইলে এইসব মহাকালখোক্ষসদের ইগ্নোর/ওভার্ল্যুক্ করা জরুর। পত্রবন্ধন তথা হার্ডবাউন্ড কাগুজে বইয়ের জন্য মহাকাল ফস্কাবে না বেরাদরান-এ-সাহিত্যতামাশার। দুশ্চিন্তে সেইটে লিয়ে করিনে বেহেনজি। ইয়া গাফুরুর রহিম! মহাকালের পরে ফের কোন কাল ধেয়ে আসিছে কে জানে! উত্তর-মহাকাল > পোস্ট-ইটার্নিটি! মহাকালসাহিত্যের পরে মহাকালোত্তরসাহিত্য! অথবা মহাকালান্তিকতা! আধুনিকতার পরে যেমন উত্তরাধুনিকতা, অধুনান্তিকতা … ব্লা ব্লা … ইত্যাদি … ঢিসুম ঢিসুম ঠিসুয়া … আপনারা কবিসাহিত্যিকরা পারেনও বটে! এইটা যা-হোক হুমায়ুন আজাদের একটা ব্যাঁকানো উক্তি মনে পড়ায়ে দিলো; বলতেই পারেন আপনি যে, এত হুদা ভাবনাভাবনির কী আছে বাপু? বঙ্গসাহিত্য তো মন্দ চলছে না। তা, আজ্ঞে, আপনে একেবারে ভুলও বলছেন না। সাহিত্যের কপাল … বঙ্গীয় সাহিত্যের নসিবে যা আছে তা-ই হবে, মন্দ হবে না আশা করি … কিন্তু বঙ্গজ এবং বঙ্গীয় সাহিত্য বলিয়া আদৌ কোনো বস্তু যদি ফিউচারে থাকে এবং তখনও যদি দুই-চাইরজন লোকে সাহিত্যের মন্দ-ভালো নিয়া ভাবে তাহলে বেঙ্গলি লিট্রেচারের অদৃষ্টে উজ্জ্বল জ্যোতিশ্চক্র রয়েছে বলা যায়; — শেষের কথাটা আজাদ বলেছিলেন। ডক্টর আজাদ অবশ্য কথাটা বলেছেন বাঙালির ভবিষ্যৎ কি, হেন প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে; বলেছেন, বাঙালির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল; অবশ্য বাঙালির যদি ভবিষ্যৎ বলে কিছু ধরাধামে থাকে, তেলাপোকারও তো ভবিষ্যৎ একটা থাকে, এই কথাটাও যোগ করতে ভোলেন নাই আজাদ।

পূর্ণসংহার
ভুল দেখেন নাই, শীর্ষস্থ প্যারাগ্র্যাফহিন্ট, রিয়্যালিই তা-ই। উপসংহার নয়, অ্যাট-লিস্ট এই রম্য কথিকায়, এইটা আলবৎ পূর্ণসংহার। পুরোপুরি দি ইন্ড তথা খতম করা হবে একে এইখানেই। কিন্তু তার আগে, জেনাব, যে-কথাটা আপনেদেরে সাফ সাফ জানায়ে যেতে চাই তা হচ্ছে এ-ই যে, এইধারা সাহিত্য লইয়া আমরা গাঙ পার হমু কেম্বা করে এই ভীষণ বুদ্ধু ভবের? দেশসুদ্ধা ব্যাংকার হওয়া বাস্তবে কতটা প্যসিবল? ধরেন যে ব্যাংকার হয়ে গেলেন লেখক-হতে-লোলুপ গোটা জাতি, কিন্তু অত প্রৌঢ় প্রোফেশন্যাল মডেল পাইবেন কই? লেখকদের পোস্টারেই তো গঞ্জের সমস্ত দেয়াল আন্ধাইর হয়া যাবে, বেচারা সমকালীন মঘা-ইউনানি চিকিৎসা আর অর্শ-গেজ-ভগন্দরওয়ালাদের ব্যবসাটা লাটে উঠবে যে!

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

 

 

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you