যে গদ্যের শেষ নেই কিংবা আধুনিক বাঙলা ডায়রি

যে গদ্যের শেষ নেই কিংবা আধুনিক বাঙলা ডায়রি

কালান্তরের বাংলা গদ্যের বিবিধ নমুনা যারা নানাভাবে দেখে এসেছেন, নজর করেছেন সম্যক পথচলতি মিটারপিলারগুলো গদ্যবঙ্গের, মোটামুটি দ্বিশত বছর ধরে এর হাতে-থাকা আধুনিক তাসগুলোও উনারা দেখিয়া সারা। তারা আলবৎ জানেন বাংলা গদ্যের নোটন নোটন পায়রা আর ঝোটন-বাঁধা আদ্দিকালিক জগদ্দলতা আছেটা কোথায়। নিশ্চয় তারা এইটুকু বোঝেন যে সিন্ট্যাক্স অর্ডার তথা বাক্যসংগঠনে গদ্য থাকে না; থাকে চিন্তায়, চিন্তনপ্রক্রিয়ায়, কিংবা থাকে সেসবের বাইরে অন্যত্র তবু বাক্যিক প্যাটার্নে নয় কদাপি। ঠিক এইখানে একটা অ্যাট লিস্ট একশ বছরের স্থিতাবস্থা বিরাজিতেছিল বাংলায়। ইন্দিরা চৌধুরানীর পতিদেব প্রমথ চৌধুরীর প্রোজেক্ট লঞ্চ হবার পরে একসেঞ্চুরি প্রায় হতে চলল মনে হয়। ঋষিকথা ধারণের যোগ্যতা বাংলা গদ্যের ভালো থাকলেও অন্যান্য খোক্ষসরাক্ষসকথা ধারণের সামর্থ্য অনেকটাই নিল্ ছিল বলা যায়। দেবেশ রায় কিংবা আনিসুজ্জামান ও গোলাম মুরশিদ প্রমুখ প্রুডেন্টদিগের বইপত্র পড়া না-থাকলে এই কথাটা মানতে আপত্তি খুব কম লোকেরই হবে যে একটা পাশ-ফেরানোর নেসেসিটি অনুভূত হচ্ছিল গড়িয়ে গড়িয়ে বেশ অনেক বছর ধরে। এবং সেই নেসেসিটির জায়গা থেকে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে বেশ সরগরম কামকর্ম শুরুও হয়ে গেছে বৈকি। বিগত দুই/তিন দশক ধরে বাংলাদেশে ‘আবহমান’ গদ্যপ্রথার বাইরে একটা আনকোরা ধাঁচের প্রোজট্রেন্ড চালু হয়েছে। এই ট্রেন্ড অবশ্য প্রতিষ্ঠানমান্য হয় নাই এখনো; মানে আখবারওয়ালারা, মানে দৈনিক খবরের কাগজওয়ালারা, ব্যাপারটা তাদের রোজকার রঙঢঙে নেয় নাই। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে কি? এই আলাপ আমরা আরও ভবিষ্যতে যেয়ে করি? ঠিক তখনই নিরখিব যে কেমন করে এই নতুন গদ্যভঙ্গিমা থেকে ডেইলি নিউজপত্রিকা হাতভরে নিতেছে, দেখব রোজকার সম্প্রচার দিয়া ইলেক্ট্রোনিক ভিশুয়্যাল মিডিয়া বাংলা সাধারণ্যে এই নতুন প্রোজের মোজ্যাইক কেমন করে ছড়াতেছে, এফএম বেতারচ্যানেলগুলো ও রাষ্ট্রীয় রেডিয়োস্টেশন কীভাবে এই গদ্যে বেগবান হচ্ছে এসব নোশন ধরে একটা আলাদা আলাপ ডিউ রইল। ভবিষ্যৎ তফাতে রেখে বর্তমানের সংলগ্ন রই।

বিদ্যায়তনিক নিয়মানুশাসিত গলা নয় অথচ কনকনে বরফ থেকে গনগনে আগুন পর্যন্ত গ্রাস করে নিতে পারে এমন গদ্য তবে নেই বাংলায়? আছে, খুব বেশি না-হলেও। যেমন ‘দাস ক্যাপিটাল’, কার্ল মার্ক্স নয়, এবাদুর রহমানের। এক-কথায় যদি এই ‘দাস ক্যাপিটাল’ বর্ণনা করতে হয়, তো বলা যায় : এইটা একটা প্রতিদিন-নোট-নেয়া ডায়রি বৈ অন্য কিছু নয়। এইটে একজন অপ্রথাগত প্রতিভাবান এবাদের নিশিদিনলিপি। পণ্যায়নে পর্যুদস্ত পৃথিবীর পোলিটিক্স ও প্রোপাগান্ডাগুলোর নির্বিকার ন্যারেটিভ এই বই; এখানে মেলে একইসঙ্গে আবেগ ও নিরাবেগ, আপোস আর অনাপোসের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ইন্ডিভিজ্যুয়াল ইন্টারপ্রিটেশন; এর ইন্টারপ্রেটার কোনো তপোবনবাসী হ্যার্মিট বা কোনো প্রেরিত পুরুষ নন, তিনি এই কমোডিটিনিসর্গের ভুবনগোল্লায় রসেবশে মেতে থাকা দুর্দান্ত ফ্লেশ-অ্যান্ড-ব্লাড এক; একটি বইয়ের ভেতরে বর্ণনা করে চলেছেন তিনি তার নিজের যাপন, কাজটি করে চলেছেন দুর্ধর্ষ ভাষা ও ভঙ্গিমায়; ‘যাপন’/লিভিং এই বইয়ের পাঠোন্মোচনে একটা চাবিশব্দ, যা তিনি রিফ্রেইনের মতো উচ্চারণ করে গেছেন বইয়ের ভেতর বহুভাবে বহু জায়গায়; মানে এইটা আক্ষরিক-অনাক্ষরিক সর্বতোভাবে খাস অর্থে বর্ণনাকারীর যাপনচিত্র, এটি দিনলিপি নিছক এবাদুর রহমানের; এবং দিনলিপি বলেই অত উপভোগ্য, জীবন্ত। যদিও এটি দিনলিপি-অর্থে দিনলিপি নয়; যে ভাষাভূখণ্ডে পরাবাস্তববাদী বলে খ্যাত বাহাত্তুর-থুত্থুরে এক প্রৌঢ় কবি-গবেষক নিজের পঞ্চাশবছর লেখালেখিজীবনের বাজারফর্দ-আত্মশংসাগাথা আর ভীমরতিকিচ্ছাগুলো ‘জর্নাল’ নামে ঢাউস খণ্ডে বাজারে ছেড়ে ভেসে বেড়ান পয়সাওয়ালাদের প্রাইভেট য়্যুনিভার্সিটিতে রেসিডেনশিয়্যাল্ স্কলার হয়ে, সেখানে এবাদের ‘দাস ক্যাপিটাল’ দিনলিপি বলে রিভিয়্যুড হলে আমাদের মস্তিষ্কবৈকল্য অচিকিৎস্য বলে ধরে নিতে হবে।

এবং আসলে দিনলিপিও এটি নয়; এর প্রণেতা একে ‘উপন্যাস’ বলে সশ্লেষ ঘোষণা করছেন শুরুতে এবং বইয়ের অন্যত্রও কয়েকবার, অনেকবার, অসংখ্যবার, কিন্তু এত উপন্যাস এত গল্প এত পদ্য এত প্রবন্ধ পড়তে-পড়তে পড়তে-পড়তে আমাদের ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে এসেছে এতদিনে; এইটা, ‘দাস ক্যাপিটাল’, পাঠোত্তর যে-কোনো অগ্রসর পাঠকের রিফ্লেক্স-অ্যাকশনই বলে দেবে যে পরিচিত বস্তার আখ্যান/উপন্যাসও এ নয়। এ অন্য কিছু, সামথিং এল্স্, সামথিং ডিফ্রেন্ট। এটি এই সময়ের এক ব্যক্তিমানুষের যাপন/লিভিং, ইন ট্রু সেন্স। এখানে এবাদ যা করেছেন, সমস্তকিছুতে নিজেকে যুক্ত রেখে নিজের ভাষায় নিজের বয়ানে নিজের কায়দায় নিজেকে প্রকাশ। নিজেকে মানে নিজের সময়কে, নিজের পরিপার্শ্ব, নিজের চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রদের মুখ-দেহ-মন-মুখোশ খুলে দেখিয়েছেন তিনি একের-পর-এক ধারাবাহিক। আসলে কোনো ধারাফারার ধার এবাদ ধারেন নাই এখানে, কোনো নর্ম-ফর্ম ইত্যাদির ইশ্কুল তিনি গ্রাহ্যে নেন নাই, ধারাপ্রবাহবিহীন বয়ানে তিনি বয়ন করে গেছেন তার ক্যাপিটালের গাত্রপ্রদাহী ক্যারিকেচার। তবে বেফায়দা ফাইজলামি নয় এই জিনিশ, যে-ফাইজলামি দিয়া বাংলাদেশের গদ্য-পদ্য তলিয়ে যেতে লেগেছিল বা যাচ্ছে, এবাদ পরিমিত অহং এবং ‘শৈল্পিক’ ক্ষুধা আর ক্রোধ লগ্নি করে লেখাশৈলী নিয়ে গেছেন এমন এক জায়গায় যে কৌতূহলী রিডারদেরে একবার এবং মতান্তরে একাধিকবার ফিরিয়া তাকাইতে হয়। ‘ন্যান গোল্ডিন’ রচনাটার কথা ভাবা যাক। বর্তমান নিবন্ধকারের স্মৃতিতে এইটাই নিও-প্রোজেইক বাংলায় সাম্প্রতিককালে-একচ্ছত্র-কাল্ট-হিশেবে-ব্যবহৃত গদ্যের প্রথম নমুনা যেখানে মেহসুস হয়েছিল যে এই গদ্যে কথিত ‘সিরিয়াস’ রচনাদিও সম্ভব হতে পারে। এর আগে এই জিনিশ প্রধানত ফাইজলামি আর ফন্টেনন্টেগিরির বাহন বলিয়াই ইউজাররা ব্যবহার করছিলেন। ‘ন্যান গোল্ডিন’ প্রথম ছাপা হয় এক ফোটোগ্র্যাফিপত্রিকায় এবং তখনই স্বীকার করেছিলেন সাধারণ ‘অলেখক পাঠকবর্গ’, অন্তত যারা পড়েছিলেন তারা সকলেই, নতুন প্রবর্তিত গদ্যটার সত্যিকারের প্রয়োগ এখনো শুরুই হয় নাই। কিন্তু অচিরে একই লিখনশৈলী দিয়ে ফস্টিনষ্টির বাইরেও অনেক লেখক সত্যিকারের অন্তর্তাগিদ প্রকাশের বাহন করে তুলেছেন গদ্যটাকে। ‘ন্যান গোল্ডিন’ এখনও শৈলী এবং শৌর্যের দিক থেকে আনবিটেব্যল রয়েছে। এই বইয়ের আওতায় গদ্যটা আঁটানো হয়েছে। এছাড়া আরও বহুকিছুই।

ক্রীতদাসানুদাসদের রাজধানীর সে-এক সাংঘাতিক আলেখ্য ওই ‘দাস ক্যাপিটাল’। আর সেখানে ব্যবহৃত তার ভাষা, বানানো কিন্তু  ‘জীবন্ত’ ভীষণ! প্রচুর পরিমাণে পেপারক্লিপিংস্, জর্নাল, ডায়েরি, চিঠিপত্র, ফোটোগ্রাফ, পোস্টার প্রভৃতি কখনো মূল টেক্সট কখনো সাবটেক্সট হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ এমন এক ম্যাজিকব্যুক, যে-কোনো জায়গা থেকে যে-কোনো পৃষ্ঠা থেকে এই বই পড়া শুরু করা যায় এবং যখন-তখন পেজমার্ক না-রেখেই রিডিং থেকে গাত্রোত্থান করা যায় একইসঙ্গে ডেলাইটফ্যুল এবং এনলাইটেন্ড আক্রোশ ও প্রশান্তি চিত্তে বহন করে। এখানে এন্ট্রি এবং ডিপার্চার ইত্যাদির জন্য কোনো ফোলানো-গণ্ড পণ্ডিতম্মণ্য হওয়া লাগে না। ডায়রি বিষয়টা এই বইয়ের এন্তার টেক্নিকের মধ্যে একটা টেক্নিক মাত্র। মোটেও প্রধান কিংবা একমাত্র টেক্নিক নয়। এবং উত্তরোত্তর ডায়রি টেক্নিক নতুনদিনের বাংলা গদ্যভাগে কেমন পাওয়ারফ্যুল হয়ে উঠছে ক্রমশ এইদিকেও নজর রাখতে হবে আমাদেরকে। সেই সাজানোগোছানো সম্পাদ্য-উপপাদ্য দিয়া আজকের জাউয়াবাজারি রিয়্যালিটির জ্যামিতি ধরা না-মুমকিন মনে হয়। এই বিষয়টা নিয়া আলাপ করা যাবে একদিন ফের কখনো। ‘বহিখানা জীবন্ত’, বারংবার ইয়াদ করিয়ে দিয়েছেন এবাদ। ওয়ার্নিং অ্যাগেইন্-অ্যান্ড-অ্যাগেইন্। বানানো যদি ভাষা, তো জীবন্ত কীভাবে হয়! ভাইসাব, লিখে-ফেলা সাহিত্য মাত্রই বানানো ভাষায় বিবৃত পৃথিবী এক। সে-এক অপর বাস্তব, অন্য দুনিয়া। এবাদ এই অপর-বাস্তব, এই অন্যদুনিয়ার সফল ও সর্বসাম্প্রত অধীশ্বর এক; এবাদুর রহমান, লেটেস্ট লেজেন্ড অফ নতুন দিনরাইতের বেঙ্গলি প্রোজ্।

ফ্যুটনোট : বইরিভিয়্যু হিশেবে এই নিবন্ধ নোটকারের হস্তলিপিত ২০০৬ ডায়রি থেকে হুবহু কম্পোজ করা হয়েছে। এবাদুর রহমান প্রণীত আরও বইপত্তর পরে বেরিয়েছে। যেমন ‘গুলমোহর রিপাবলিক’, ‘ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র’ প্রভৃতি। ‘দাস ক্যাপিটাল’ বেরোনোর আগে এডিটেড একটি কিতাব বেরিয়েছিল ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা’ নামে। এবং ২০১৬ অব্দে বেরিয়েছে ‘এক ব্যাগ শিল্প’; — অদ্যাবধি যা আলোচনালাঞ্চিত/বন্দিত হতে হেরি নাই। কিন্তু সবমিলিয়ে এই নিবন্ধ এবাদগদ্যের তুল্যমূল্য নয়, অ্যাড/বিজ্ঞাপন/প্রোমো বড়জোর। এবং ‘দাস ক্যাপিটাল’ বইয়ের পাঠোত্তর ২০০৬ সালে এন্ট্রিকৃত বর্তমান নোটকারের তাৎক্ষণিক রিভিয়্যু অথবা রিডিং রেস্পোন্স মূলত। পরে-বেরোনো প্রকাশনাগুলোর তথ্যনিচয় নিবন্ধ প্রণয়নকালে প্যারাগ্র্যাফফোকরে পাঞ্চ করে দেয়া হয়েছে শুধু। তখনও অনলাইনের ঝনঝন শুরু হয় নাই, ছিল খাতাযুগ তখনও, ফেসবুক শুরু হব-হব করছে; এহেন অনালোকিত অন্ধকারাচ্ছন্ন সভ্যতার ডায়রি থেকে এন্ট্রিটা প্রায় আনকাট এইখানে গৃহীত হলো। বলা বাহুল্য, বইটি রিলিজ হয়েছিল ২০০৬ ফেব্রুয়ারিতেই, ঢাকা থেকে, ‘বাঙলায়ন’ নামে এক প্রকাশনীর ব্যানারে। এখনও পয়লা ছাপা বাজারে আছে মনে হয়। দ্বিতীয় কোনো ছাপা বার হয়েছে মর্মে হাতে এখন পর্যন্ত খবর নাই।

লেখা / জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you