সাম্প্রতিক রিলিজ-হওয়া সোনার বাংলার সার্কাস ব্যান্ডের হায়েনা এক্সপ্রেস অ্যালবাম শ্রোতামহলে বেশ সাড়া জাগিয়ে সাদরেই গৃহীত হওয়া একটি অ্যালবাম। হায়েনা এক্সপ্রেস মূলত একটা কন্সেপ্চুয়াল অ্যালবাম যার ভেতর দিয়ে আমাদের মানবসভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকল বিষয়াদি খুব গুছিয়ে গীতিকার বর্ণনা করে গেছেন। এই অ্যালবামেরই একটি গান ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ নিয়ে এখন আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব, আশা করি সাথেই থাকবেন। তো, শুরু করা যাক —
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
কথায়, ইচ্ছায়, সাধনায় আর কারখানায়
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
মৃত্যু-উৎপাদন জন্মদানের চেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। আধুনিক এই বিংশ শতাব্দীর যুগে আমরা বেঁচে আছি — এ-ই তো বেশ। কর্পোরেট এই সময়ে মৃত্যুর খবর জানাতেই ফোন করে বেঁচে থাকাকালীন খবর নিতে নয়। হতেও পারে আপনার হাতের সেলফোনে পরবর্তী ফোনকল জন্ম নয় বরং কারো মৃত্যুর খবর শুনতেই তৈরি। কথার বাণে কথা দিয়ে অন্তরমৃত দার্শনিক আমরা, আবার স্বীয় সমৃদ্ধির দম্ভের ভারে ইচ্ছের রেখাপাতে করাঘাত করি। আসলে আমরা দৈহিক, মানসিক উভয়ভাবে মৃত। আর এই মৃত্যুই আমাদের আধুনিক সভ্যতা।
মহামারী শিশুদের প্রিয় খেলনা
যুবকরা ভালোবাসে মরে বেঁচে থাকতে,
অকালমৃত্যু প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের প্রিয় উপহার
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
এই বিতৃষ্ণ ভুবনে মহামারী শুধু রোগবালাইয়ের জন্যে হয় না, প্রতি মিনিটে উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারার মোড়কে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাস্তব সত্যে মানুষ নানাভাবে তাসের ঘরের মতোই পড়ছে, মরছে; হতে পারে তা কোনো সড়কদুর্ঘটনার কবলে কিংবা প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।
প্রতিটা যুবকের রক্তে দেশের মৃত্তিকা যেন কর্পূরের সম্মোহনী ঘ্রাণ যা তাকে দেশের দুর্যোগকালীন পাহাড়সম সাহসের সাথে পথে নামায়। অথচ সেই প্রেমিক-প্রেমিকার নিকট প্রিয়-উপহারসম মৃত্যু। যে-যুবা প্রেমের টানে দেশের জন্য লড়ে তাকেই নির্বিচারে রাষ্ট্রযন্ত্র হত্যা করে উভয়ত দৈহিক ও মানসিক। পরিশেষে যে-মৃত্যু হয় প্রেমিকার কাছে প্রিয় উপহার।
সেই বুলেটটা কোথায়?
যার গায়ে আমাদের মৃত্যুর নাম লিখে রাখা
তার জন্য পাঁজরের ভেতর পেতে রেখেছি সিংহাসন
আর তাই ধুয়েমুছে ফুঁ দিয়ে দিন কাটাই,
জীবনকে সময়ের ছুটকাছাটকা পরিহাস জেনে
বহুপুরুষ ধরে আমরা পেশায় কসাই,
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
কিছু অচিন্তনীয় বস্তু আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় যা কখনো আমরা কল্পনার ভল্টে ভুলের মাশুল হিসেবেও জমতে দেইনি। এখানে সেই বস্তুকেই বুলেটের সাথে তুলনা করা হয় যার গায়ে আমাদের মৃত্যুর নাম লেখা আছে; আর আমরা তার জন্যই বুকের ভিতর রাজসিংহাসন পেতে রাখি সযত্নে।
জন্মদিবসের মানেই যদি হয় মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করা তবে মৃত্যুর মধ্যেই আমাদের মুক্তি নিহিত কিংবা দেয়ালে ওপাশের সাপেক্ষে এই ভূমে আমরা মৃত জীবন কাটাচ্ছি। কে জানে আমরা এখনো মাতৃগর্ভে আছি কি না এই মৃত্যুর অপার জন্মসাপেক্ষে, যে-মৃত্যুর বুলেট বুকপকেটে নিয়ে ঘুরি অজানা উৎস থেকে। কারণ আমরা একই জিনিস প্রজন্ম থেকে বয়ে আসছি, যার জন্য কবি বলেন — ‘বহু পুরুষ ধরে পেশায় কসাই’।
মৃত সৈনিকের ফসিল দিয়ে গড়েছি ঘরের দেয়াল
রক্তের সেচে ফসল ফলে ফসল ফলে দেদার
সূর্যকে দেখে মনে হয়
ফেরেশতাদের তাক-করে-রাখা কামানের গোলা
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
বিংশ শতাব্দীর মানবসভ্যতা বড়ই অকৃতজ্ঞ, ধূর্ত। আজকের এই আধুনিক সভ্যতা রাতারাতি আজকের পর্যায়ে আসেনি; ইতিহাস বলে, যার পেছনে লাখো সৈনিক নীরবে কাজ করে গেছে আকাতরে। তাদেরই কবরের মাটি পুড়িয়েই হয়তো আপনার ঘরে দৃশ্যত চারদেয়াল, বস্তুত এই দেয়ালের নীরবতাই যেন সে-সকল মানুষের কথা বলে যারা আপনার-আমার জীবনমানকে আনন্দঘন করতে অকাতর পরিশ্রমের মাঝেই বিলীন হয়েছে। আমরা কী তাদের মনে রাখি? রাখি না। কারণ, আমরা অকৃতজ্ঞ। তাহলে মৃত সৈনিকের ফসিল আপনার দেয়ালেই অন্তর্নিহিত ঘ্রাণ নিয়ে দেখেন অনুভব করতে পারেন কি না? নাকের ডগায় মৃত্যু নিয়ে ঘুরি বিধায় আমাদের ঘ্রাণশক্তিও আজ ভোঁতা।
রক্তের সেচে ফসল ফলে মূলত সকল কর্মের শেষকে বোঝায়। প্রতিটা কাজের একটা ফলাফল থাকে যার পেছনে কারো-না-কারো শ্রম নিযুক্ত। এই যেমন আজকে আপনার গৃহীত খাদ্যের পিছে কোনো কৃষকের রক্ত-পানি-করা হাড়ভাঙা পরিশ্রম ছিল, এই জিনিস উপলব্ধি হয় আমাদের? তেমনভাবে আপনার পায়ের জুতো থেকে গায়ের জামা সবকিছুতেই কারো শ্রম রয়েছে, যে দেদার শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিক পায় ভৎসনা; তারপরেও সে দেদারসে শ্রম বিকিয়ে যায় এই সভ্যতার চাকা ঘুরানোর জন্য। যখন সভ্যতার চাকা ঘুরাতে সেসব সৈনিকরা আধুনিক সেনাপতির স্বৈরাচারী আদেশ পালন করতে থাকে তখন সূর্যের কামান থেকে ছুটে আসা প্রখর কিরণই মনে হয় ফেরেশতাদের গোলাবর্ষণ।
প্রতিটি মৃত্যুর সাথে
প্রতিটি লাশের সাথে
বিনামূল্যে দিয়েছি একটি করে গোলাপ
পরিহাসের বিষয় হলো
সেই গোলাপের রঙটিও লাল!
তোমার শিশুর হাসির মতো লাল!
তোমার প্রেমিকার কপালের টিপের মতো লাল!
তোমার শরীরে বয়ে চলা রক্তের মতো লাল!
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
ভালোবাসা প্রকাশের চিরচেনা মাধ্যম গোলাপ; এই গোলাপ একটি প্রতীকী চিহ্ন মাত্র। আমরা মানুষ আদিযুগ থেকেই স্বজাতিদের হত্যার উৎসবে মেতে উঠি। যেদিন সৃষ্টির সেরা তাদের আদি নিবাস ছেড়ে বেরিয়ে এল সভ্যতার অভ্যন্তরে সেদিন থেকে স্বাভাবিক জন্ম ও মৃত্যু উভয়ে হয়ে গেল কারখানায় উৎপাদিত মোড়কজাত পণ্য। প্রতিটি পণ্যের যেমন বাহারি মোড়ক থাকে তেমনি প্রতিটি জন্মের শুভেচ্ছা ও মৃতের শোক প্রকাশে থাকে বাহারি ফুলের তোড়া যেখানে গোলাপ একটি ধ্রুব মান।
ধ্বংস যেহেতু মানবচেতনার সেরা ফসল
তাই নিজের মেরুদণ্ড হাতে দাঁড়িয়েছি
নিজের মাংসপিণ্ডের সামনে
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
আমাদের তৈরি পাপের প্রাচীরে ধ্বংসাবশেষ অদ্যাবধি পাঁচিলের গায়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ধরা দেয় চেতনাভ্রষ্ট ফসলরূপে। অবক্ষয়ে জর্জরিত কায়া মেরুদণ্ডহীন সত্তার মাংসপিণ্ড। আর আমরা নিজের মেরুদণ্ড খুলে নিজের সামনে ধরা দিই মেরদণ্ডহীন হয়ে। এই হচ্ছে নিজেদের প্রতি নিজেদের বিবেকচ্যুত মস্তিষ্কের উপহাসের অট্টহাসি কিন্তু আমরা যার সম্পর্কে জ্ঞাত নই।
এ-ই ছিল গানের পঙক্তি ধরে আমার দৃষ্টিতে ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ বিশ্লেষণের বৃথা চেষ্টা। কেননা সোনার বাংলা সার্কাস-এর সমৃদ্ধ গানের কথা ব্যাখ্যা করার জন্য পরিণত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চোখ আমার তৈরি হয়ে ওঠেনি এখনও। মূলত এই গানের সম্পূর্ণ প্রতিপাদ্য অথবা বার্তাটি দাঁড়াচ্ছে —
আমরা মানবজাতির ইতিহাসের আয়নায় পেছনের প্রতিবিম্বে তাকালে দেখতে পাই সৃষ্টির সেরা হয়ে আমরা সে-সকল কাজ করে আসছি যেসব কাজ আমাদের করা উচিত নয়। বনের পশু বাঘ ও সিংহ কিন্তু স্বজাতিকে হত্যার উল্লাসে মেতে ওঠে না। আমরা আপন ভাইয়ের রক্তে হোলি খেলতেই জীবনের সার্থকতা মনে করি। আমরা শুধু দৈহিকভাবেই মানুষকে হত্যা করছি না, মানসিক হত্যায়ও এগিয়ে আছি। আজ পর্যন্ত কোনো প্রাণী ক্ষুধা নিবারণের বাইরে বনের দ্বিতীয় প্রাণীকে হত্যার নজির নেই; কিন্তু মানবসভ্যতায় সামান্য মতের অমিল হলেই হত্যার দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। এই স্বাধীন ভূলোক আমাদের কথায় ইচ্ছায় আর সাধনায় একটি বধ্যভূমি অর্থাৎ মৃত্যু উৎপাদন কারখানা । তাই আমরা গর্বিত আমরা সৃষ্টির সেরা।
আমার দৃষ্টিপট থেকে মৃত্যু উৎপাদন কারখানার সম্পর্কে মতামত তুলে ধরলাম। ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।
নওরিন ফারিহা (Nowrin Fariha)। গানশ্রোতা ও সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের সংগীতসমুজদার
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS