ঢাক ও দুর্গাপূজা

ঢাক ও দুর্গাপূজা

ঢাক শব্দটা কানে এলেই যে-একটা বাদ্যিবাজনা আমাদের মনে উদয় হয়, কানেই উদয় হয় ম্যে বি কিংবা কান হয়ে মনে যেভাবেই হোক হয়, একটি বিশেষ ফর্ম্যাটের বাদ্যি, সেইটাই শুনছিলাম ২০১৬ দুর্গাপূজার নবমী দিনভর থেকে-থেকে। এই বাজনা ছাড়া ঢাকীরা কি ভিন্ন কোনো বাজনা জানেন না? আমি ঠিক এর আগে সেভাবে খেয়াল করি নাই। কিন্তু বিয়াবাড়ির বাদ্যিতেও তো ঢাকের ব্যবহার আছে। সেইটার চলনও কি একই?

কিংবা আরেকটা ব্যাপার, বিসর্জন সামনে রেখে যে-ঢাকের আওয়াজ আর দেবীবোধনের আওয়াজ অভিন্ন হবার তো কথা না। লক্ষ্মীপূজাতেও তো এই একই চলন, না? ভালো করে খেয়াল নাই। কিন্তু একই মনে হয়। বিয়াশাদিতে অবশ্য পপ্যুলার গানের মুখড়া ধরে বাজনা চালানো হয়। কিন্তু, যা-ই-হোক, ঢাকের বাদ্য মানেই হলো দুর্গাপুজোর বাজনা। আর আমি তো বাজনাটা শুনছি ইন-ওয়ান-সেন্স আউটসাইডার হিশেবে। এই ধরো বছরান্তিক শীতমরশুমে শহরের কোনো গলিমুখের টাইল্সমোড়ানো আশ্রমে হরিনামসংকীর্তনের অনুষ্ঠান চলার আওয়াজ শুনে এবং হ্যাজাকঝলমলা আলো দেখে ফ্যুটপাথছাপড়ার কিনার ঘেঁষে একশপঁচিশ-সিসি দ্বিচাক্কাযান সাইড করিয়ে রেখে চুরট ফুঁকতে ফুঁকতে, চৈত্রের বান্নিমেলায় একটু অদূরস্থ উপজেলায় ঢাক-খোল-করতাল শোনার একটা ব্যবস্থা আজও বহাল আছে বৈকি, কিংবা ধরো বছরে এক-দুইটা পূজা আর এক-দুইটা শাদিমুবারকের বাইরে ঢাকীর বাজনা শুনবার সুযোগ তো নাই। বিয়াশাদিতেও তো লোকে নেমন্তন্ন করে না আজকাল, বুডঢা বিধায় লোকেরে ব্লেইম্ দেই না, আমারে অ্যাভোয়েডই তো করে বলব।

পূজাআচ্চায় নেমন্তন্ন করে নাই কেউ কোনোকালেই। নিজের ইচ্ছেয় ভেসে ভেসে অচিনা পাড়ার মণ্ডপগুলো ঘুরে দেখার একটা সময় ছিল, লিভিং ডিভাস্ দেখে বেড়াবার বয়স, তা-ও তো গত হয়েছে ঢের ধূসর বছর হয়ে গেছে। গেল দুর্গাপূজায় কাছারিবাড়ির জানালায় এসে ঢাকের আওয়াজ ঘষা খাচ্ছিল থেকে-থেকে, হিন্দি ফিল্মি গানার ফাঁকে ফাঁকে দুর্গাপূজার প্রোমোফিলার হিশেবে, সেই ঢাকপুকার শুনতে শুনতে সাতপাঁচ মনে পড়ছে। ব্যাপারগুলো বিশদে জানতে হবে। এইসব ভাবছিলাম, আর দেবীর হিম্মত/‘পাওয়ার’ স্বীকার করছিলাম মনে মনে।

যে বিকট ও বিদঘুটে দাবদাহ গিয়েছে এর-আগের কয়দিন, পুজো শুরু হতে-না-হতে দেখি শীতনামানো জলপতনের ধারা সারাদিন! ঢাকির বাদ্য শুধু নয়, পূজার সময় বৃষ্টিও একটা কমন্ আইটেম। কয়েকজন জিগ্যেশ করছিলেন, দেবী এইবার কিসে এলেন এবং কিসে যাবেন; উত্তর দিতে পারি নাই। ইনফোর্মেশন নাই হাতে। এককালে তথা আগে এই ইনফোগুলো ইশকুলের ডেস্কেবেঞ্চে জানা হয়ে যেত, এখন সেই ডেস্কেবেঞ্চে বেড়ে-ওঠা মানুষগুলো কেউ ব্যাঙ্কার কেউ সরকার কেউ বেসরকার, সকলেরই ডেস্কবেঞ্চের সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়েছে। কেউই দেখি এই কর্নেলরে পুঁছে না আজকাল। পুঁছবে কি, ইনবক্সটাও করে না চান্দে-ঈদে … হায়!

এরশাদের আমলে পুঁছত বটে! বেহায়া হিশেবে খ্যাত হুমো স্বৈরাচারের শাসনামলে আমরা ছিলাম যৌবনের দূত। অবশ্য তৎকালীন আমাদের যৌবনবয়স নিয়া কারো-কারো অব্জেকশনও উঠতে পারে। কেননা নাইন্টিন-নাইন্টিতে এরশাদেরে টেনেহিঁচড়ে চেয়ার থেকে উৎখাত করবার বছরে আমাদের অনেকেরই ছিল ক্লাস্ সেভেনের যৌবন। অথবা কারো পঞ্চম বা বড়জোর ষষ্ট। ওই সময়ে ডেস্কে-বেঞ্চে বসে থেকে একে-অন্যেরে ইনভাইট করে ফেলতে পারতাম। কোনো ফর্ম্যাল্ দাওয়াতপত্র দরকার হতো না। ঢাকবাদ্য শুনতাম বন্ধুবাড়িনিকটস্থ মণ্ডপে যেয়ে। এখন আর ওই দিন নাই, হায়! কিন্তু দুঃখ করি না, বাঁচি বরং। বৌবাচ্চা নিয়া বাল্যবন্ধুদের মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরাঘুরি দেখি আর বিরস বদনে দিলের ভিতর থেকে তাদিগেরে আশীর্বাদ করি। গাহি শারদীয় শুভেচ্ছার গানখানি, কাঠি হাতে নিয়া ঢাকের পিঠে দুইটা বাড়িও বসাই মনে মনে। একেলা নিরজনে, বসিয়া বিজনে, বিরস বদনে বাট দোয়াভরা মনে।

অ্যানিওয়ে। এইবার ঢাক/ঢাকবাদ্য সম্পর্কে একটু ওরিয়েন্টেশন দরকার আমার। একটু অবহিত হওয়া দরকার। এইটুকু শুধু পূর্বজ্ঞান রয়েছে যে ঢাক আদৌ ঢোল নয়। ঢাকের যেমন প্রকারভেদ রয়েছে, তেমনি ঢোলেরও রকমফের অনেক। ঢোল মোটামুটি সর্বসাধারণ্যে পরিচিত বাদ্যযন্ত্র। বলা যায় বাঁশির পরেই ঢোলের ব্যবহার এবং প্রয়োগ-পরিচিতি বাংলায় ব্যাপক। এই দুইয়ের বাইরেকার যেসব বাংলা বাদ্যযন্ত্র রয়েছে, একতারা বা দোতারা বা বাংলাঢোল বা কাঁসর বা ঝাঁঝর বা খঞ্জনি, সেগুলো প্রয়োগের যথাযোগ্য ক্ষেত্র এবং সেগুলো বাজাবার হিম্মতওয়ালা বাদক ক্রমহ্রাসমান। বললেই হয় যে নাই। কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কারণ, আছে; ক্ষয়িষ্ণু হলেও উবে যায়নি এখনও।

তবে অ্যাক্যুস্টিক ইন্সট্রুমেন্টের যে-রবরবা ফ্যাশনের বাজার দেখি ইউটিউবে কোক/ফোক প্রভৃতি বিস্তর ঝলোমলো পয়সাভাসানো স্টুডিয়োগুলোতে, সেসব জায়গায় বাংলা বাঁশের/লাউখোলের তৈয়ারি বাদ্যযন্ত্রের বদলে আখাম্বা প্ল্যাস্টিকের জার কিংবা কাঠবাকশো পিটাইতেই মিউজিশিয়্যানদিগেরে উৎসুক দেখা যায় বেশি। ট্রেন্ডি কারবার। দেখনদারিতে একটু গ্লোব্যাল্ হওয়া লাগে বোধ’য় মিউজিকপিয়্যপ্যলদেরে। এবং প্ল্যাস্টিকের পানিজার না-পিটাইলে সেইটা হওয়া যায় না বলিয়াই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। সেইটা যা লাগে লাগুক, যা মনে হয় হোক। আমরা ঢাকের খবর লই।

সিলেটে মেলা হয়েছিল অর্ধযুগ আগে একটা। বাংলা ১৪১৬ সালে তথা আংরেজি ২০১০ সনে। লোকবাদ্যযন্ত্র মেলা। হাল্কাপাৎলা নাগরিক বড়াইয়ের বুড়বুড়িকাটা ফ্যাশনফেয়ার না, ভালোই ছিল লোকবাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী, বাদ্যযন্ত্রী শিল্পীদের উপস্থিতি, তিনদিনজোড়া গানাবাজানা আর আলোচনা। আয়োজন করেছিল ‘মেঠোসুর’ নামে একটা ফোরাম, সম্ভবত অলাভজনক উদ্যোগ, সহযোগিতায় নাম দেখা যাচ্ছে দুইটা : ‘হাছন রাজা ফাউন্ডেশন’ এবং ‘বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতি’। বিমান তালুকদার সম্পাদিত উৎসবস্মারক বেরিয়েছিল একটা, চাইর ফর্মার, ‘ডাক দিয়ে যায় তরাসে’ শিরোনামে একটা লেখায় বাংলা বাদ্যযন্ত্রের একটা ক্যাটালগ পাওয়া যাচ্ছে বেশ বিস্তারিত এবং পাওয়া যাচ্ছে গোটা-চল্লিশেক বাদ্যযন্ত্রের ডেস্ক্রিপ্টিভ ওভার্ভিয়্যু। মোটামুটি কাজের জিনিশ হয়েছে ফেস্ট-মেমেন্টোটা। বানানবিভ্রাটের বিশাল যন্ত্রণা আর পোকাঠাসা টাইপিং সহ্য করে গেলে ব্যাপারটা কালেক্টর্স শেল্ফে মজুত রাখার মতো। উৎসবস্মারক ওই পুস্তিকার প্রাগুক্ত রচনা থেকে ঢাকবিষয়ক ভুক্তির একাংশ নিম্নোৎকলিত :

… একটি বৃহদাকার কাঠের খোল দু-পাশে চামড়ার ছাউনি দিয়ে ঢেকে ঢাক তৈরি করা হয়। এর দুদিকে দুটো মুখ থাকে। এর একটি মুখের ব্যাস দেড়হাত-পরিমাণ। বাঁ-দিকের মুখটি পুরো চামড়া ও অন্য মুখ অপেক্ষাকৃত পাতলা চামড়া দিয়ে ছাওয়া থাকে। পুরো চামড়ায় ছাওয়া মুখটিতে বাঁশের চটি বা কাঠি দিয়ে ঢাক বাজাতে হয়। ঢাকে সাধারণত তালে তালে ঘা দিতে হয়। … ঢাক, জয়ঢাক, বীরঢাক বা বীরকালী প্রভৃতি নানারকম বাদ্য বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে বহুল প্রচলিত। ঢাকের অনুগামী যন্ত্র হিসেবে ঢোল, কাঁসির ব্যবহার যুক্ত। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, চড়ক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে ঢোল-কাঁসির সঙ্গে ঢাক বাজানো হয়। এই বাদ্যটিকে পুরাকালে ডঙ্কা বলা হতো। … বস্তুত ডঙ্কা মাটির-হাঁড়ি দ্বারা নির্মিত। ঢাকের অতি বৃহৎ সংস্করণকে জয়ঢাক বা জয়ডঙ্কা বলা হয়। … একপাশে দুটো কাঠি দিয়ে জয়ঢাক বাজানো বহুল প্রচলিত। ঢাকজাতীয় বাদ্য অনেক সময় হাত দিয়েও বাজানো হয়ে থাকে। ঢাকের ‘বেলা’  অত্যন্ত জটিল কিন্তু তা প্রাণস্পর্শী ও উত্তেজক। … ঢাকের তাল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঢাকে বিশেষত ‘ত্রিস্ত্র’ ও ‘চতুস্ত্র’ জাতি তালের বাজনা বাজে। পুজোয় বিশেষভাবে ঢাক ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে যুদ্ধমাত্রেই ঢাক ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বরানুগমনে, চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের সময় ও অন্যান্য উৎসব-অনুষ্ঠানে ঢাক ব্যবহৃত হয়। …

এইভাবে যেতে যেতে, দূর-হতে-ভেসে-আসা ঢাকশব্দ শুনতে শুনতে এবং বইতাকিয়া থেকে টেনে ঢাকপ্যারাগ্র্যাফ পড়তে পড়তে, একটা বাংলা বাগধারা ইয়াদ হলো। বহুল উচ্চারিত বাংলা এক্সপ্রেশন একটা। ‘ঢাকগুড়গুড়’। বলি আমরা এইভাবে যে, “বলতে চাও যা ঝটাপট বলে ফ্যালো, হুদা ঢাকগুড়গুড় কোরো না মিয়াঁ!” বা, গানেও আছে, যেমন মৌসুমী ভৌমিকের একটা গানে, “ঝিকঝিক ঝিকঝিক ট্রেন চলে / গুড়গুড় গুড়গুড় ঢাক বাজে” … লক্ষ্মীপূজার সময় ট্রেনে শহর থেকে গাঁয়ে ফেরার অভিজ্ঞতা নিয়া গানটা, যেখানে এক লক্ষ্মীবিগ্রহবিক্রেতা দেহাতি মানুষের দেখা আমরা পাই যার বিবাহযোগ্যা মেয়েরা বাড়িতে বাপের অপেক্ষায়, বাপ মাটির লক্ষ্মী বিক্রি করে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন জোটান, “লক্ষ্মী গেলে তার লক্ষ্মী আসে ঘরে” … এই টাচি গল্পটা গানে গানে হয় জানা। আওয়াজটা, গুড়গুড় আওয়াজটা, আমরা শুনতে পাই ঠেসে উদরপূর্তির পরে। পেটে ট্রাবল্ হলেও গুড়গুড় শুব্দ শুনি বটে। এবং শুনি মেঘে। একদম ঘোর বর্ষায় কিংবা আনবর্ষাতেও গুড়গুড় আওয়াজে মেঘের ঠ্যালাধাক্কা আমরা হামেশাই শুনি। কিন্তু গুড়গুড় ছাড়াও মেঘেবাদলিতে এন্তার আওয়াজ আছে আরও বহুধারা।

তা, ঢাকের আওয়াজ তো কখনো ‘গুড়গুড়’ নয়। অ্যাট লিস্ট আমার কানে তা কখনো গুড়গুড় প্রতিভাত হয় না। তাহলে কেন ওইভাবে বলি আমরা? জানা যাবে নে একদিন, হায়াতে কুলাইলে। এইবেলা ছাড়া যাক হ্যাপি শারদীয়া বলে।

নিবন্ধপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you