রাজবাড়িতে সপ্তমী, দুর্গা এবং অন্যান্য (সচিত্র) || আনম্য ফারহান

রাজবাড়িতে সপ্তমী, দুর্গা এবং অন্যান্য (সচিত্র) || আনম্য ফারহান

রাজবাড়ি গেছিলাম ছোটভাই রাখির বিয়েতে। পূজার সময় থাকায় মন্ডপ ঘুরব, আগেই বইলা রাখছিলাম পোলাপাইনদের। ঈষৎ কুয়াশা ও শীতমন্ডিত গ্রামের সন্ধ্যারাত্রিতে ঘুইরা ঘুইরা দুর্গার রূপ দেখছিলাম। সপ্তমীর দিন সেদিন। ধানপাকার হেমন্তে, একটু হিমেল হাওয়ার নাচনে লোকজনের মাঝেও দেখছিলাম ওই বরণ কইরা নেওয়ার ঔদার্য্য এবং বৃহৎ ডানার নিচে সবকিছু ধারণ করার গভীর উষ্ণতা। এইদিকের বাগদী পাড়ায় রাতে দেখছিলাম শিউলি ফুল ফুটে হাসতেছে, আর মৃদু গন্ধে বাকবাকুম কইরা অন্ধকাররে দিতেছে শোভা! ছাতিমের গন্ধ পুরা এলাকা জুইড়া একটা উড়তে-থাকা চাদরের মতো পরশ বোলাইতেছিল; ছাতিম যেমন দৃশ্যমান হইয়াও কোন্ এক ডাক জানি ডাকে, অদৃশ্য কোনো গুপ্তলোকের অতল দুঃখের মতো; তেমনই ওর গন্ধওয়ালা চাদরটার হদিস পাই নাই, তবে ও যে ছিল, সেইটা কোটি কোটিভাবে জানাইছে।

মন্ডপ থেকে মন্ডপে দুর্গার রূপ বিভিন্ন। এইদিক থেকে কুমারখালী কাছে হওয়ায় নদীয়া অঞ্চলের পটারির প্রভাব আছে, আর আছে পদ্মাবাহিত এক চিরন্তন শোভা। হরাই নদীবাহিত একটু ক্ষীণ একটা চোরাস্রোতের মতো আরেকটা চিরন্তন ধারাও আছে এই প্রতিমাদের। সেইটাকে প্রকাশিত প্রাচুর্য না বইলা আমি বলব অবধারিত একটা অহংকার, যা একটু গোপন কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুঞ্জরণে দোদুল দুল্ দোদুল দুল্! এখানকার প্রাণ-প্রতিবেশ ও জীবনের মধ্যেও সেইটা যে আছে, তা আর বলতে হয় না।

সাধারণত আমার অভ্যাসই হইল পরপর কয়েকটা মন্ডপ ঘোরা। রাজবাড়িতে গেছিলাম ৬টা মন্ডপে। কাছে দূরে মিলাইয়া। এখন তো স্পিকারে হাই ভলিউমে রিদমিক মিউজিক এবং কীর্তন বাজায়। বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। সেইটা ধর্মঘনিষ্ঠ কইরা তোলার আয়োজন না, বরং উৎসবটাকে আরও বেটার ওয়েতে প্রসেস করার সামাজিক অনুষঙ্গ। এইটা ভালো লাগছে। মিস করছি হইল খোল-করতাল এবং ঢাকের বাদ্য। বিশেষ কইরা ঢাকের বাদ্য।

প্রসাদের খিচুড়ি খাই নাই, যেহেতু নিজেদেরই বিয়ে, তাই খাইতে খাইতে সাড়ে-চারটা/পৌনে-পাঁচটা বাজছিল। ওই পেটে আর খিচুড়ি খাইতে যাই নাই। নাড়ু, খই আর আপেলটাপেল — এইগুলা খাইছি। এই অঞ্চলের মিষ্টান্ন খুবই বিখ্যাত। ইলিশ সন্দেশে একটু সল্টি টেইস্ট যুক্ত করে এরা। আর সেই জগদ্বিখ্যাত চমচম। আহা। আধা পোড়া হালকা পেঁয়াজ কালারের বা ল্যাভেন্ডার শেডের দই রাজবাড়ি আর কুষ্টিয়া ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। গোয়ালন্দ থেকে এর বিস্তার শুরু, শেষ হয় গিয়া কুষ্টিয়ার পদ্মার এইপাড় পর্যন্ত। ওইপাড়ের পাবনা রাজশাহীর দই আবার আরেক রকম।

যা-ই হোক, ৬টা মন্ডপেই মায়ের ছবি স্পষ্ট কইরা তোলার চেষ্টা করছি। যদিও ছবি শুধু ছবিই। কেবলই ছবি-ই নয় আবার!

হা হা…।

প্রতিমা থেকে প্রতিমায়, ফুল থেকে ফুলে, ঝইরা পড়ার মধ্য দিয়া না, বরং বিলীন হওয়ার মধ্য দিয়া মানুষের সকল আচার যে নতুনতর হয়; গৃহীত হইয়া সার্বজনীন একটা বহমানতার মধ্যেও থাকে একইসঙ্গে; তার দর্শন পাওয়া মানবজন্মের আরেক ন্যারেটিভ। পুরাতনই, সব গল্পই যেমন পুরাতন, কিন্তু ওই পুরাতনই নতুন হইতেছে কীভাবে, তার স্পিরিট কীভাবে যুক্ত করতেছে কায়নাথ — বিশ্বসংসার — অযুত নিযুত সভ্যতা; তা নতুন নতুন কালে ও শিল্পবিপ্লবের দেহ থেকে দেহে বইতেছে নতুনভাবেই।

বস্তুবাদী দর্শন ও ভাববাদী দর্শনের ভেদ যেইখানে, জ্ঞানতত্ত্বের (Epistemology) ও সত্তাতত্ত্বের (Ontology) সংযোগ সেইখানে। আরেকটু খুইলা বললে, অধিবিদ্যাকে (Metaphysics) অতিক্রম করলে জ্ঞানাতিরিক্ত সত্তা দাঁড়ায়ে থাকে, থাকেই; তাকে হেগেলকৃত ‘জ্ঞানই চরম সত্তা’ দ্বারা বুঝতে না পারা গেলেও কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) দ্বারা বরং আগানো যায়; এবং তৎপরবর্তী নব্য বাস্তববাদ দ্বারা সত্তাতত্ত্ব ও অধিবিদ্যাকে কিছুটা পৃথক করা গেলেও নব্য বাস্তববাদের নৈরাজ্যের (Anarchy) ঝুঁকিটা থাকেই। এইটা কাটানো গেলে বাস্তববাদের সম্ভাবনা ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম বা স্পেকুলেটিভ রিয়ালিজমে আইসা ভালোভাবেই দাঁড়াবে। ভাববাদের সাথে এমনিতে অধিবিদ্যার শক্ত সিঁড়ি রচিত আছেই, দরকার দ্রবীভূত হওয়ার বায়বীয় অনুভূতিগুলাকে আরও বুঝতে পারার দিকে যাওয়া এবং সেইমতো স্পেস দেওয়া। উপলক্ষগুলারে আয়োজনের সম্ভারে ফেইলা না দিয়া তা থেকে আহরিত অ-বস্তুকে (পড়তে হবে বস্তুকে) রিয়ালিটিতে আরও রিয়াল করা।

২৩/১০/২০২৩

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : Amit Pramanik, পাপন, তুই ঘুমাইস আর রেস্ট নিস ঠিকঠাক; থ্যাংকস দিব না। যা বলছিলাম তা শুনবি নিশ্চয়ই। Mejbah Uddin, তুমি আর নিশো সাথে থাকায় মজা হইছে; থ্যাংকস ম্যান।)

ফোটোগ্রাফি / আনম্য ফারহান


আনম্য ফারহান রচনারাশি
গানপারে দুর্গাপূজা

COMMENTS

error: