পাগলের জন্য অপার হাওর চোখের পানি || শামস শামীম

পাগলের জন্য অপার হাওর চোখের পানি || শামস শামীম

আসমানের স্থায়ী বাসিন্দা হলো পাগল হাসান!

পাগল হাসান ওরফে হাসান মতিউর রহমানের লগে কখনো সরাসরি আড্ডা হয়নি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পলকে হাইহ্যালো হতো। এতটুকুই ছিল সম্পর্ক। কিন্তু তার হৃদয়-উৎসারিত গীতবাণী, মরমি মাটির সুর আর সহজাত গায়কির সঙ্গে ছিল আমার আত্মিক সম্পর্ক। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার গান শুনতাম। সে গলা, গায়কি, শ্রোতা ও অডিয়েন্স বুঝে কণ্ঠ ও সুরের ঢেউ ছড়িয়ে দিতে। তার প্রতিটি গানই ছিল সহজ সরল গ্রামীণ মরমি আবহে বোনা। বাণীতে নাগরিক চতুরতা ছিল না। জোর করে গান বাঁধত না সে। এই অঞ্চলের মরমি সুর, মধুর ভাষা তার গানে চলে আসতো পরম্পরা সড়ক ধরে। তার গানের বাণীগুলোই ছিল সহজাত, হৃদয়-উৎসারিত। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য উঠে আসতো গানের বক্তব্যে। তার সঙ্গে একদশক আগে সংগীতশিল্পী অলক বাপ্পা (Alok Bappa)-দার ডেরায় দেখা হয়েছিল। আমার সমসমায়িক হলেও বয়সের ব্যবধান ছিল ৩-৪ বছরের।

আড্ডায় বসেও পাগল গান লিখত। এভাবে প্রায় হাজারখানেক গান লিখেছে। তবে গত বন্যায় তার গানের ডায়েরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। লেখা গান আড্ডায় সুর দিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লালন, হাসন, রাধারমণ, করিম, শাহনূর, আমির উদ্দিন সহ রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজসেবা অঙ্গনের মানুষদের নিয়েও গান বেঁধেছে, সুর দিয়েছে, গেয়েছে বিভিন্ন আসরে।

তার অজান্তেই কিছু গান নেটদুনিয়া আর নেটদুনিয়ার বাইরের অফলাইন দুনিয়ার মানুষও নিজের করে নিয়েছিলেন। যদিও নেটদুনিয়া নয়, মঞ্চেই তার গান আমার ভালো লেগেছিল।

আজ গ্যুগলপথে, ইউটিউবসড়কে হাঁটলাম। সার্চ অপশনে কেবলই পাগল হাসান। ক্লিকবাজি করে দেখলাম তার কিছু গান ৩০-৩৫ মিলিয়ন মানুষ দেখেছে। তার ইউটিউব ও ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া এসব গানও শুনেছে, দেখেছে কোটি মানুষ। অন্য অনেক শিল্পীরাও গেয়েছে। সেগুলোরও বেশুমার ভিউ হয়েছে। নেটদুনিয়ার গানের ভূবনে সে কতটা প্রভাবশালী ছিল আজ তার চলে যাওয়ার দিনে দেখলাম। আর চোখ ভিজলো কেবল।

আজ নেটদুনিয়ার গলিঘুপচিতে দেখলাম কত আহাজারি পাগলটাকে নিয়ে। দেশ-আন্তর্দেশের মানুষ চোখের জল ফেলেছে। স্মৃতি রোমন্থন করেছে। ছোট্ট জীবনের অল্পদিনের ভ্রমণে দশর্ক ও শ্রোতাদের মনে কত উঁচুতে তার আসন ছিল অনুধাবন করলাম। তার কিছু গান শুনলাম, বারবার, একাধিকবার।

অনেকে জোর করে ফোকগান লেখে। জোর করে শব্দ বসিয়ে দিয়ে পণ্ডিত সাজতে চায়। এক্ষেত্রে পাগলটা ছিল ব্যতিক্রম। হৃদয়ের গহিন থেকে, এই মাটির নাভি ফুঁড়ে গানে ধরেছে সহজাত শব্দ। যেখানে নাগরিক চাতুরি নেই, বাড়াবাড়ি নেই, জোরজবরদস্তি নেই। শ্রোতা বুঝে, মাটির ধর্ম ও মর্ম বুঝে ফলেছে শব্দ। এসেছে নদীর ঢেউয়ের মতো সুর। সেটাকেই ভরাট কণ্ঠে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বতরঙ্গে। মাটির মানুষ, আধুনিক-নাগরিক মানুষ তাকে হৃদয়ে আসন দিয়েছে। সুরের ভুবনে বসে সে ছড়িয়ে দিয়েছে সুরের ইন্দ্রজাল। মানুষের কাছ থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে, রসে ভেজা মরমি মাটি থেকে, ভাটির মহাজনদের বিচরণক্ষেত্র থেকে সে পেয়েছিল রত্নভাণ্ডার। সেখানেই ফলিয়েছে সুরবাণী। নিজেকে শান দিয়েছিল ঐতিহ্যের মাটিতে বসে। খ্যাতি ও সম্মানের উঁচু আসনে থিতু হওয়ার আগেই সে স্মৃতি হয়ে গেছে। ঘাতক বাস তাকে কেড়ে নিয়েছে।

সুর ও বাণীর ঐন্দ্রজালিক রসায়ন রক্তমাংসের পাগলকে শারীরিক থামিয়ে দিয়েছে। পাগল হাসান তার গান ও সুরের কারণেই টিকে থাকবে। কণ্ঠ ও সংগীতসুধায় মাতিয়ে রাখবে আমাদের। প্রেয়সীকে আসমানে না-যাওয়ার আকুতি জানিয়ে নিজেই আসমানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল পাগলটা। তার জন্য একসাগর অশ্রু।

২.
পাগল হাসান দেড়যুগ আগে সুনামগঞ্জ শহরে একটি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরি করত। ওই প্রতিষ্ঠানেরই আরেক ছোট কর্মীর মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতে। অভাব তাকে নিয়ত তাড়া দেয়। দুঃখের সংসারে উপচেপড়া বিরহে পিষ্ট হাসান পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়। পুড়ে পুড়ে সে খাঁটি হয় — মাটির হাসান। প্রকৃতির পাঠশালা থেকে শিক্ষা নেয়। তুমুল বিরহের, অভাবের সংসার তার।

সংসার শুরুর আরো আগ থেকেই পাগলটা গুনগুন গাইত, সুর করত, গীত রচনা করত। সেগুলো তেলচিটচিটে বিছানাবালিশের তলে লুকিয়ে রাখত। বন্ধুদের আড্ডায় কখনো খোলা গলায় গাইত দু-চার পদ। বন্ধুজনেরা মরমি সুর ও গায়কির সমঝদার না-হওয়ায় তার সুর ও বাণীগুলো আঁতুড়ঘরেই কাঁদত। শ্রেণিবৈষম্যের শিকারও হতে হয় অবচেতনে বিভিন্ন স্থানে। একসময় চাকরিটাই ছেড়ে দেয়। গীত, সুর, বাণীতেই ঘর বাঁধে। এভাবে পাগল হাসান হয়ে ওঠে। কেউ জানে না তার দুঃখময় অতীত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মাটির সুরে বোনা তার সহজিয়া গীত — নিয়তিবাদী, বস্তুবাদী, ভাববাদী এবং উভয় সংকটে ভোগা মানুষও লুফে নেয়। সহজ কথায়, গীতল সুরে মানুষ পাগল হয় পাগলের গানে। এ যেন তাদেরই কথা, তাদেরই সুর। যেই সুর অভাব ও টানাপোড়েনে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। চতুর নাগরিকতার ভিড় ঠেলে গোপনে এগিয়েছে অশ্বগতিতে। নাগরিক মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছে ভুল করে হলেও রসে-ভেজা মাটিতেই থিতু হতে হবে। হাসানরাই এই পথের দিশারী।

গানে তার খ্যাতি আসে। দেশ-আন্তর্দেশে ছড়িয়ে পড়ে হাসান। মঞ্চ কাঁপায়। মানুষ মাতে। কিন্তু তার অভাবের সংসারের ছবিটা জীবন শুরুর পর থেকেই শাদাকালো থাকে। দুই সন্তান পৃথিবীতে এলেও তার সংসারের ছবিটা আর রঙিন হয় না। টানাপোড়েন যেন তার চিরন্তন নিয়তি।

নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষ হাসান। আসর মাতায়। তার নামে দেওয়ানা দর্শকশ্রোতা। পাগল হাসান পাগল হাসান বলে তারা চেঁচায়। নাগরিক শিল্পীরাও এই সময়ে তার গীতগান কণ্ঠে তুলে নেয়। তারাও খ্যাতি পায়। কাম ও কামাই ভালো হয়। কিন্তু হাসান সেই মরমি মানুষই থেকে যায়।

অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা উত্তোলনের জন্য সাজা সংস্কৃতিকর্মী/সংগঠকদের সঙ্গে চতুর সাংস্কৃতিক আয়োজকরাও তার নির্লোভ ও নির্মোহ ভালো মানুষের মনের সন্ধান পেয়ে যায়। তাকে ধরে আসর মাতানোর মওকা খোঁজে নামমাত্র পারিশ্রমিকে। আসরের জন্য তার কোনো দরদাম নেই। সে কখনো দাম হাঁকিয়ে গাইতে আসেনি। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় চতুরের দল। তারা ২-৫-১০ হাজার টাকা দিয়ে তার সময় কিনে নেয়। পাগলও মনে মনে চতুর মানুষদের চরিত্র ধরতে পেরে নিজেকে উজাড় করে দেয়। কণ্ঠ ছেড়ে মঞ্চ মাতিয়ে তোলে। মানুষের মন বোঝার পির হয়ে ওঠে। একের পর এক গান গেয়ে আসর মাতিয়ে বিদায় নেয়। মঞ্চ তার নাম গাইতে থাকে। হাততালি দিতে থাকে। কিন্তু তার ভিতরের দহন, অভাবের কাহন সবাই ভুলে যায়। কণ্ঠ ব্যবহারকারীরা সবকিছু জেনেও নিজেদের পুষ্ট করে।

পাগল হয়তো চতুর মানুষদের সেই ধর্মটা বুঝত। তাদের দ্বিচারি সত্তার খবর সে জানত। তাই সংগীত পরিভ্রমণে নিজেকে প্রোজ্জ্বলভাবে তৈরি করে। অর্থ নয়, বিত্ত নয় সংগীতই তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তাকে লোকমানস সংগীতসম্রাটের আসনে বসায়।

সেই আসনে নিজেকে তুমুলভাবে উপস্থাপন করেই চলে গেল সে। তার অভাবের সংসারে আর ফিরল না স্বচ্ছলতা। স্ত্রী, দুই ছেলে, মা ও বোনরাও হাবুডুবু খাবে। খাবি খাবে অভাবে। আর আমরা মৃত্যুবার্ষিকী এলে আবারও তাকে নিয়ে মাতবো। এই ছিল, সেই ছিল বলে মঞ্চে মুখ দেখাবো, হয়তো দু-এক ফোঁটা মেকি অশ্রুও ঝরাব। কিন্তু তার অন্তরে অন্তরে নিজেদের মিশাইতে পারব না। তার অভাবের বেদনাকে নিজের করতে পারব না।

গানের মতোই ‘মইরা গিয়া কদর বাইড়া যায়’ হয়ে গেল হাসান। কেউ জানল না তার ‘কত জ্বালা লইয়া পাগল মন মজাইলা সুরে / মাথা ঝুলে হেলেদুলে পুড়ছ হৃদয়পুরে’।

পুড়ে পুড়ে খাঁটি হওয়া পাগল হাসানের জন্য আমার চিরতরের অশ্রুগাথা।


শামস শামীম রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you