ঝিলকাইছ না রে ভাই
অনে আমার আগের দিন আর নাই
সমাজের যে-চেহারা দেখা যাচ্ছে, বা চরিত্র দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন আছে! নিভৃতচারী প্রয়াত বাউল মকদ্দস আলম উদাসীর ছবি মাথায় রেখে উদ্ধৃতির এই কথাটি ভাবছিলাম গত ক’দিন ধরে। গতকাল হাওরের আরেক রত্ন প্রয়াত বাউল শফিকুন্নূরের স্মরণানুষ্ঠানে গিয়ে আমার উক্ত ভাবনাটি আবার উস্কানি দিয়েছে।
অনুষ্ঠানটিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাউল শীতনদা। বাউলের নিজ রক্তমাংসের উত্তরাধিকারীর কারণে সঙ্গে-প্রসঙ্গে, আলাপে-বিলাপে, মহাজনী-বৈঠকী নানা আলোচনায় ‘সুজন বন্ধু’ খ্যাত বাউল শফিকুন্নূর হাজির হন। শফিকুন্নূরের গানের তিন প্রজন্মের মানুষ এখনো জীবিত আছেন। হাওরের শান্ত-অশান্ত-স্থির-কোমল-ঢেউ তার কণ্ঠে খেলা করত। তার পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রসঙ্গ এখনো প্রাসঙ্গিক। সেই পরম্পরা গতকাল অনুষ্ঠানে গিয়ে আবারও প্রত্যক্ষ করলাম। রক্তের উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়ায় নগরে এই লোকমহাজনকে নিয়ে এ-রকম অনুষ্ঠানে আমরা আবারও তার গান শুনতে পেরেছি।
সিলেট শহরের সারদা হলে এই অনুষ্ঠানে চন্দনা মজুমদার থেকে শুরু করে মহাজন শাহ আলী নূর, আবদুর রাহমান, কালা মিয়া, সিরাজুদ্দিন, মালতি পাল সহ অসংখ্য গুণী শিল্পীরা হাজির ছিলেন। তারা শফিকুন্নূরের হারিয়ে-যাওয়া, প্রচলিত, অপ্রচলিত গানগুলো পরিবেশন করেছেন। অনুষ্ঠানের আয়োজনে কোনও কমতি ছিল না। সচেতন উত্তরাধিকারীরা অনুষ্ঠানটিকে কালারফুল রূপ দিয়েছিলেন।
যাক, সে-প্রসঙ্গ আর না-কপচিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে সাধক মহাজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম সেই মহাজন প্রয়াত বাউল মকদ্দস আলম উদাসীকে নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত লেখার অবতারণা। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ‘তস্কর সিন্ডিকেট’-এর বাইরে ব্রাত্য অথচ প্রোজ্জ্বল ও আলাদা ছিলেন উদাসী। প্রচলিত জনপ্রিয় সুরের ধারা এড়িয়ে তিনি বাউলামির পরম্পরাকে গ্রহণ করেও আলাদা ছিলেন। সুর ও বাণীতে সেটি ধরা পড়েছে। ন্যাটিভ শব্দের সঙ্গে আঞ্চলিক প্রবাদ, প্রবচন গানের বাণীতে শক্তিশালী উপমায় সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। এতে গানের ভাব ও বক্তব্য আরো স্ট্রং হয়েছে।
জীবনসংসারের প্রতি প্রশ্নহীন উদাসীন বাউল মকদ্দস উদাসী রক্তের উত্তরাধিকারীর সঙ্গে তেমন কোনও শিষ্য উত্তরাধিকারীও রেখে যাওয়ার চিন্তা করেননি। অথচ যুগের হাওয়া লাগিয়ে চললে বহুকিছুই করতে পারতেন। এই সামর্থ্য ও শক্তিও ছিল মহাজন উদাসীর। কিন্তু সেই পথ মাড়াননি। সংগীত সাধনাই ছিল মুখ্য। অবহেলা, অনাদরে, বিনা চিকিৎসায় বন্যার্ত হয়ে মারা যাবার তিন বছর পরও আমরা তাকে চর্চিত হতে দেখি না। নীরবে জন্ম ও মৃত্যুদিন যায়। কেউ খবর রাখি না।
‘জীবনযুদ্ধে হইলাম আমি পরাজয় / ছয় রিপুর কবলে পড়ি দিনে দিনে হইলাম ক্ষয়’… ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো গানের মধ্যে এটি তার একটি গীত। গান ছাড়া উদাসী আর কোনও উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। ‘সংগীতের জড় বাউল গান / গাইলে বৃদ্ধি করে জ্ঞান / যার অপর নাম বিজ্ঞান / বুঝিয়ো জ্ঞানীর কাছে।’ সংগীতকেই জড় বা মূল শিকড় ভাবতে পারে কয়জন! তিনি শিল্পীকে ভাবতেন ‘বিজ্ঞানী’, গানকেও ভাবতেন ‘বিজ্ঞান’। সমাজরাষ্ট্রের অগ্রসর, মুক্তবুদ্ধির লোকই হতে পারে বিজ্ঞানী। মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার বিরুদ্ধে আমাদের চেনাজানা বেশুমার শিল্পীও (?) যখন হাঁটেন তখন স্কুলকলেজের বারান্দায় না যাওয়া উদাসীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন এক লোক বিজ্ঞানী হিসেবে ভেবে, তার সরল চেহারাটা দেখে আমার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় মহান মানুষটির সামনে মাথা নুয়ে আসে।
সময়ের প্রয়োজন ও তস্করঘেরা সংস্কৃতিচর্চার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এমন উত্তরাধিকারী থাকলে গ্রামে, শহরে, নগরে আমরা তাকে উপস্থাপিত হতে দেখতাম। তার মতো সমসাময়িক আরেক মহাজন ফকির সমছুলের বেলায়ও তেমনটিই দেখছি। এই দুই মহাজন যে-গীতসম্ভার রেখে গেছেন অনায়াসেই লোকগানের সাধারণ ও বোদ্ধা শ্রোতাদেরও মোহাবিষ্ট রাখার রসদ লুকিয়ে আছে তাতে। রসে টলটলে হয়তো কিছু নেই। বাণীতে শঠতা, কপটতা এড়িয়ে মকদ্দস আলম উদাসী বিশ্বাস ও ভালোলাগাকে উপস্থাপন করেছেন, রঙে ঢঙে সমাজবাস্তবতাও পেয়েছে স্থান। আঞ্চলিক ফেলনা ও গুরুগম্ভীর শব্দভাণ্ডারকে ব্যবহার করেছেন মুন্সিয়ানায়। এতে গানের ফিলোসোফি নতুন মাত্রা পেয়েছে। ভাবনার পালে দোলা দিয়ে যায়। আমৃত্যু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেও তিনি কারো ‘তাউল্যা আতাই’ চরিত্র দিয়ে মুগ্ধ করেননি। ক্ষমতার কাছে ঘেঁষেননি কখনোই। তবে রাজনীতি ও সময় সচেতন এই অগ্রসর লোককবি সেসব বয়ানও রেখে গেছেন গানে। তার আদর্শ ও বিশ্বাসের স্পষ্ট বয়ান রাখডাক ছাড়াই বলে গেছেন।
এই তল্লাটে দেখনদারি ও বুঝনদারির গরিমা রপ্ত করা উদাসী ‘দাদারে আদা পড়া হিকাউনি’ বলতে পেরেছিলেন স্পর্ধায়। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির তস্করদের লুইচ্চামি ধরতে পেরেও তিনি নিজের নামের মতোই উদাসী ছিলেন। তবে খুব করে বুঝতে পেরেছিলেন ‘ঘরের মাড়ইল কাটে সদা উন্দুরে / গাছে উইটঠা কমলা খায় লেঙ্গুরকাটা বান্দরে’। ধান্দামান্দায় অন্যের পোঁদে কাঠি দিয়ে মেকি রাজত্ব বিস্তারকারীদের চেহারাটাও ধরতে পেরেছিলেন। বলতে পেরেছিলেন, ‘ছেঙ্গের মুল্লুক ব্যাঙ্গে খাইলিছে / বাঁশ থাকি ছিংলা বড়ো / জ্ঞানীর মাথা ঘুরাইছে’। এ-বিষয়ে তার প্রাসঙ্গিক আরেকটি গীতও তার মুখ থেকে শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বলেছিলেন গীতটির প্রেক্ষাপটও…। ‘উগারতলে হুড়াহুড়ি মুরগিনতে / মুরগারে ফালাইয়া মারে ফুরু ফুরু ডেমাইন্তে / মকদ্দস উদাসী আউলা / দেখি ইতা লীলাখেলা / হক্কলতা তলেদি দিলা / থাকিতে দেয় না শান্তিতে’।
উত্তরাধিকারহীনতার সঙ্গে বৈষয়িক কিছুও রেখে যাননি আমৃত্যু উদাসীন মকদ্দস উদাসী। একাধিকবারের আলাপে জেনেছিলাম জগৎসংসারে কোনও বৈষয়িক সম্পদের চিহ্ন রেখে যেতে চান না। যাবারকালে তাই-ই হয়েছে। কোনও মোহ ও মায়ার চিহ্ন রেখে যাননি। শুন্য হাতে এসে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবার আগে তার সহজ ফিলোসোফি রেখে গেছেন। নানা রঙের তস্কর, সময়ের পল্টিবাজ বাটপার, মেকি আদর্শ ধারণকারী হাত চেটেপুটে ঝুটা খাওয়া বহুবর্ণের ইজারাদার সবাই নিজের সুরত নতুন করে চেনাচ্ছে। আর লাফানি দেখে মনে পড়ছে বিনয়ী মহাজন উদাসীর পঙক্তি … ‘ঝিলকাইছ না রে ভাই / অনে আমার আগের দিন আর নাই’ …
- শফিকুন্নূর স্মরণানুষ্ঠানে সতীর্থ সাধক ও সময় নিয়া ভাবনা || শামস শামীম - January 4, 2025
- চোখের জলে প্রজ্জ্বলিত প্রেম ও প্রতিরোধের কবিতা || শামস শামীম - December 30, 2024
- গুরুদক্ষিণা || শামস শামীম - July 1, 2024
COMMENTS