চন্দ্রবিন্দুর নতুন অ্যালবাম ‘টালোবাসা’ শুনছি। এখনও শোনা শেষ হয়নি। ‘কেরানি’ নামক একটি গান বেশ মনে ধরেছে। এর কারণ এ-গানে কেবল কথার ফুলঝুরি নয়, এর সংগীত আয়োজনও চমৎকার। অসাধারণ একটা গ্রুভ আর প্রগ্রেশন্স, পরিমিতি সকল মিলিয়ে। তবে শুনতে শুনতে মনে হলো, চন্দ্রবিন্দু আসলে কেমন ধরনের ব্যান্ড, কি বলতে চায়, কেন বলতে চায় ইত্যাদি।
কলেজ থেকেই ওদের গান শুনি, মাঝে ক্লান্ত লাগত শুনতে। নতুন অ্যালবাম আগ্রহী করে তুলল এজন্য যে এখনও কি বলার আছে তাদের সেই ভেবে। তাছাড়া বলার ধরন কি বিশেষ বদলালো? ‘টালোবাসা’ চন্দ্রবিন্দুর অ্যানাদার অ্যালবামই বটে। এর কোনো নতুন সংযোজন নাই। স্ল্যাপেস্টিক কমেডি ধাঁচের বাংলা গান, সাথে অল্প একটু রোমান্টিক। বাংলাদেশে চন্দ্রবিন্দুর যে-গানসমূহ বিখ্যাত হয়েছে তার প্রায় সবটাই রোমান্টিক ধাঁচের। ওদের রাজনৈতিক ইন্টারপ্রিটেশন যেহেতু ভারতীয় রাজনৈতিক কন্টেক্সটনির্ভর, ফলে এখানে সেটি ততটা প্রাসঙ্গিক থাকে না। তবে নায়াগ্রা আর ভায়াগ্রার যে ছন্দমিল তা সকল শ্রোতাদের বিমলানন্দ দিয়ে আসছে বহুদিন ধরে।
চন্দ্রবিন্দু এই অ্যালবামেও কীর্তন বা বাংলা লোকগানের কিছু ফর্মকে বেশ নিষ্ঠার সাথেই জুড়ে দিয়েছে বিশেষ কিছু গানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা উপভোগ্য। তবে একটা ব্যাপার খুব মজার; আজকাল শিল্পসাহিত্যে ব্যক্তি-শ্রেণির রাজনীতির হাজিরা এসব লোপ পেয়েছে। আমি বলতে চাইছি এসবের ক্রিটিক গানবাজনায় হাজির নেই। মাহফুজ আনাম জেমসের গানে বা আজমভাইয়ের গানে এমনকি আইয়ুব বাচ্চুর গানে যে ‘পকেটমারের’ কথা উঠে এসেছে আমার সমকালে, তা ভীষণ বিমূর্ত আর একাকার। মাকসুদভাই যে ‘মামা ভাগ্নের’ কথা বলেছেন তার ‘বঙ্গাব্দ’ অ্যালবামে, সেই সমাজবাস্তবতার কথা আমরা বাংলা গানে আজ যেন বলি না। অতটা স্পষ্ট করে বলি না। আমি দেখতে পাই জেমসের জুয়ার টেবিলের সেই ‘লোকটা’ যে আলোআঁধারি ছুঁয়ে থাকে, আজম খানের সেই নামহীন গোত্রহীন মা যে ছেলের জন্য কেবল কেঁদেই চলেছে, আর আইয়ুব বাচ্চুর মরমি বিচ্ছেদের সুরে যে চিরঅভিমানী প্রেমিক এই শহরে বহুকাল পার করে দিলো নানা সংঘাতে, সেসব যেন আমাদের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আর্বান মিউজিক্যাল ডকুমেন্টেশন।
চন্দ্রবিন্দু তাদের এই অ্যালবামে কেরানি চরিত্রটিকে ঠিক সেভাবেই দেখছেন আন্দাজ করি। তাকে নিয়ে উপহাস করছেন। ব্যাঙ্গাত্মক তির ছুঁড়ছেন তার দিকে। একবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তির স্খলন, হেরে যাওয়া ইত্যাদি যেন এসব মশকরা ইয়ার্কির ভেতরে প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এই উপহাসের ভেতর শিল্পী নিজেও নিজেকে স্যাটায়ার করেন বোধ করি। কারণ ব্যক্তি আজ কার দিকে আঙুল তুলবে? কে তাকে বিচারকের দ্বায়িত্ব দিলো?
এ-সকল অমীমাংসিত অধ্যায় পাশে রেখেও ‘টালোবাসা’ শোনা যায়। যা অনুচ্চারিত, সেখানে থেকে যায় মস্ত এক আশাবাদ। ওম শান্তি!
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
গানপারে চন্দ্রবিন্দু
- স্ল্যাপেস্টিক কমেডি ধাঁচের বাংলা গান || শিবু কুমার শীল - January 5, 2025
- এ-দেশে সাম্প্রদায়িকতা নাই : এ এক আশ্চর্য প্যারাডাইজ || শিবু কুমার শীল - October 16, 2021
- বুদ্ধদিনের গান || শিবু কুমার শীল - June 11, 2021
COMMENTS