স্যামুয়েল বেকেট একশ একুশ শব্দ দিয়া ওয়ান-অ্যাক্ট প্লে ‘Come and Go’ লেখেন। নাটকে তিনজন ফোর্টি প্লাস মহিলা ক্যারেক্টার আছে যাদের নাম ফ্লো, রু আর ভাই। ইন্টারেস্টিং সব নাম, তাই না? অ্যাবসার্ড প্লেরাইট বেকেটের নাটকে ক্যারেক্টারের এইধরনের নাম খুব দরকারি ঘটনা। যেমন তার ‘Endgame’ নাটকের চারটা চরিত্র যাদের নাম হ্যাম, ক্লোভ, ন্যাগ এবং নেইল। নামের সাথে কি ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রশ্ন থাকে? যদি থাকে, তাইলে এই অস্তিত্ববাদী নামসর্বস্বতারে বেকেটের অ্যাবসার্ড প্লে টোকা দিয়া উড়াইয়া দেয়।
‘Come and Go’ নাটকের মঞ্চ অন্ধকার আর রহস্যময়৷ দর্শকদের মনে হইবো, একটা ভৌতিক কিছু ঘটতে যাইতেছে মঞ্চে। একটু পর। সামনে কিছুটা আলো। একটা বেঞ্চিতে বইসা আছে ফ্লো, রু আর ভাই। সাইলেন্স। তাদের ছোট ছোট ডায়লগে দীর্ঘ ‘Pause’। সাইলেন্স। অস্বস্তিকর ফিসফিসানি। ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতো নাটকের চরিত্ররা যেন একটা ডেথ-চার্ট ফলো করতেছে। উইঠা যাইতেছে। ফের ফিইরা আসতেছে। একজনে আইসা অন্যজনের বেদনাদায়ক ভবিষ্যৎ বলতেছে যেন। হাহাকার করতেছে। কিন্তু মুখোমুখি হইতে রাজি হইতেছে না কেউ।
এই যে সাইলেন্স, দীর্ঘ Pause; অ্যাবসার্ড নাটকের আরেকটা খুব ঘন বেকেটীয় বৈশিষ্ট্য। মনে হইবো, নাটকের মূল প্রোটাগনিস্ট এই সাইলেন্স। দীর্ঘ পজ। মূলত তা-ই। বেকেটের তৈরি করা এই সিন্টিলেইটিং সাইলেন্স হলে বইসা থাকা দর্শকদের মগজে আঘাত করে। দর্শকের মনে হইতে পারে, এই স্পার্কলিং সাইলেন্সে অবিরত ঘটতেছে ভাষার পরাজয়।
নাটকের শেষ ডায়লগটা এমন। সবাই একটা সেল্টিক নট বানায়। (পাশাপাশি তিনজন বইসা একজন আরেকজনের ঠিক বাম হাত ধরবে। আবার একজন আরেকজনের ঠিক ডান হাত ধরবে।) তারপর ফ্লো বলে, “I can feel the rings.” কী অর্থ হইতে পারে এই কথার? কোনো অর্থ হয়তো নাই। কোনো লজিক নাই। কিন্তু যেই নিরর্থকতার বয়ান বেকেটের সব কাজে পাগলের মতো চিৎকার কইরা ওঠে, এইখানেও কি তার দেখা পাওয়া যায়? ‘rings’ বহুবচন। মানে কি অপার শূন্যতা? অথবা ঘুরতে ঘুরতে ফের আগের জায়গায় ফিইরা আসা? ফের আবিষ্কার করা যেন এইসব জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বলপ্রয়োগ, ক্ষমতা সবকিছু লইয়া মানুষের অতিক্রান্ত পথ মানুষের বিলাপের মতো অসহায়।
‘Endgame’ নাটকের মঞ্চও আবছা। অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দুইটা জানালা স্বাভাবিক হাইট থেইকা অনেক উপরে। হ্যামের ঘর আর জানালার বাইরের জগৎ, যেন দুইটা বিচ্ছিন্ন পৃথিবী। অন্ধ হ্যাম। হাঁটতে পারে না হ্যাম। সারাদিন একটা চেয়ারে বইসা থাকে হ্যাম। ক্লোভ হ্যামের দেখাশোনা করে। ক্লোভ এত আন্তরিক; পুরা নাটকে তারে কোথাও বসতে দেখা যায় না। যেন হ্যামের হুকুম মাইনা চলাই তার নিয়তি। হ্যামের বাবা-মা ন্যাগ আর নেইল। ঘরের ভিতর দুইটা অ্যাশবিন হইলো তাদের থাকার জায়গা।
‘Homecoming’ নাটকে লেনি যেইভাবে ম্যাক্সরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এইখানেও হ্যামরে দেখা যায় নিজের বাপ-মারে নিষ্ঠুরভাবে উপহাস করতে।
বেকেটের প্লেতে টাইম অ্যান্ড স্পেইসের ব্যবহার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্পেইস যেন ভৌতিক আবহাওয়া লইয়া দর্শকের সামনে হাজির হয়। আর টাইম? যেন কোথাও স্টাক হইয়া আছে। মানুষের লাইফে অস্তিত্বহীন সময়ের কি কোনো জায়গা আছে? সময়রে বাদ দিয়া মানুষের কর্মতৎপরতার দিকে তাকাইলে দিনের শেষে কী থাকে? পুনরাবৃত্তি! মহাশূন্যের যাত্রায় করুণভাবে প্রতারিত হওয়া অন্ধকার মুখ। একই চাওয়া, একই বাসনা, একই স্বপ্ন, একই অপেক্ষা, একই জন্ম, একই মৃত্যু। একই মিথ্যা, একই ছল। একই নৃশংসতা। একই সৃষ্টি। একই দুঃখ। একই সুখ।
‘Endgame’ কী এইখানে? পুরা ওয়ান-অ্যাক্ট প্লেটাই বেকেটের এন্ডগেইম। ইন ফ্যাক্ট, পৃথিবীর অবধারিত নিরর্থকতা হইলো এন্ডগেইম। একটা অ্যাবসার্ড তামাশারে প্রতিনিয়ত লজিক্যাল করার চেষ্টা, অর্থ তৈরি করার কূটকৌশল হইলো এন্ডগেইম। যার শুরু আর শেষ একই। নিয়তির মতো। নির্ধারিত৷ অনর্থক। পর্দা নামার আগে হ্যাম তার চেয়ারে বইসা থাকবে। পর্দা উঠার আগে যেমন ছিল। একই জায়গায়। একই দশায়। ব্যর্থ হ্যাম। অন্ধ হ্যাম।
এক অনিশ্চয়তার দিকে রওনা দিবে ক্লোভ। হ্যাম তারে বাধা দিতে পারবে না আর। পুনরাবৃত্তির মতো অনিশ্চয়তাও রঙহীন এক করুণ ঘটনা। হ্যামের রুম থেইকা পাকঘরের মধ্যখান পর্যন্ত; এইটুক অতীত নিয়া ক্লোভ কোথায় যাবে?
আবছা অতীতে আরো কিছুদিন বাঁইচা থাকবে ন্যাগ। যেহেতু নেইল বা মৃত্যু এন্ডগেইমের এক আনজাস্টিফায়েবল ড্যামেজ।
আইরিশ প্লেরাইট স্যামুয়েল বেকেট ‘Endgame’ প্রথম মঞ্চায়ন করেন ৩ এপ্রিল ১৯৫৭ সালে। রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার, লন্ডনে। যদিও নাটকটা লেখা হয় ফরাশি ভাষায়। আর ‘Come and Go’ লেখা হয় ইংরেজিতে, ১৯৬৫ সালে। প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৪ জুন ১৯৬৬ সালে। স্খিলার থিয়েটার, জার্মানিতে।
বিংশ শতাব্দী যেইভাবে সৃষ্টির, সেইভাবে ধ্বংসের। পর পর দুই ধ্বংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধ, নির্বিচার খুন, দুর্যোগ, মানুষের করুণ পরিণতি দেখা এইসব ক্রিয়েটিভরা সবার আগে যেইটারে সন্দেহ করেন, তা হইলো তাদের জ্ঞান। যেইভাবে এই জ্ঞান ভাষার চাষ করে, সেই প্রক্রিয়ারে। আবার এইটাও ঠিক, অভিজ্ঞতা হিসাবে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধের বীভৎসতাই ছিল না, বরং যুদ্ধপরবর্তী মানুষের বাউন্সব্যাক, স্ট্যাবিলিটি, ভাঙচুর থেইকা ফের সোজা হইয়া উঠতে পারাটাও ছিল। ফলে যে-কোনো অ্যাবসল্যুট অথবা অর্গানাইজড ইন্সটিটিউশন কীভাবে একটা নিরর্থক প্র্যাক্টিস হইয়া ওঠে; অভিজ্ঞতা হিসাবে এইরকম একটা ধারণা হাজির হবে, এইটাও অবধারিত ছিল।
রচনাকাল : আগস্ট ২০২১
হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপারে মঞ্চনাটক
- স্যামুয়েল বেকেট, নিরর্থকতা, সাইলেন্স আর ভাষার পরাজয়… || হাসান শাহরিয়ার - January 6, 2025
- মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ, ক্ষমতাবান বনাম ক্ষমতাহীন, গণমানসিক বৈকল্য ও অন্যান্য তাধিন তাধিন || হাসান শাহরিয়ার - November 28, 2024
- মিতা নূর, অলিম্পিক ব্যাটারি, সুইসাইড, বিংশের বাংলাদেশ যথারীতি একবিংশে, অনেক অনেক আহাম্মকের কারবার অথবা রোজগার… || হাসান শাহরিয়ার - November 24, 2024
COMMENTS