প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে

প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে

 

শীতের সন্ধ্যায়
আমার-তোমার কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা
তারার নিচে বাতাস বয়ে যায়
আমার-তোমার কি কোথাও লুকিয়ে থাকার কথা
এতকিছু কি আমাদের আজ হবার কথা…

গানটা আমার নয়, শায়ান চৌধুরী অর্ণবের গাওয়া। না, তেমন কথা কিছুই ছিল না আমাদের। শীতের সন্ধ্যায় ফ্যুটপাথপাশের রেস্তোরাঁবারান্দায় রেগ্যুলার পায়চারি করার কথা ছিল শুধু। কথা ছিল মজনুমামার পানভাণ্ডার থেকে একশলা ফাইভফিফটিফাইভ নিয়া হাতের তেলোয় দিশলাইকাঠি আগলায়া আগুন ধরায়া জাফলং রৌডের গাড়িধাবন্ত টিলাগড় পয়েন্টের কোনায় টেম্পোর অপেক্ষায় দিঘল বিকাল আবোলতাবোল কথা বলা। তারপর কি হলো, বলা আর বাহুল্য।

তখনও দুনিয়া আজকের ন্যায় এত ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়া ওঠে নাই, শীতসন্ধ্যাগুলোতে মানুষের আনাগোনা কম্পারেটিভলি কম হতো শহরসরণি কিংবা বিপণিবিতানগুলোতে, তখনও দুনিয়াটা আবিল হয়া ওঠে নাই আজকের ন্যায়। একটু নয়, একটু বেশিই ঢিমেতালে চলতফিরত জগতখানা, একদম হুড়োহুড়িহীনই ছিল বটে দুনিয়াকাণ্ড। মফস্বল জেলাশহরগুলো তো অবশ্যই ছিল অনেকটাই নিরুপদ্রব, অনুত্তেজ, নিরুত্তাপও। ফলে হারায়া যাওয়া বা দিকশূন্যপানে উড্ডয়নের তাড়া আদৌ অতটা ছিল না আজকের মতো। তবু কথাবার্তা তো ছিলই, পৃথিবীতে এই এক কারবারের তো কোনো পরিসীমা-দেশদ্রাঘিমা-কালাকাল নাই, কথা আর কথা আর কথা।

তা, সেইরকম কথা আমাদেরও আছিল কিছু। কথা ছিল চন্দনের বনে দেখাসাক্ষাতের দিনে টানা পাঁচ-শতাব্দী আমরা তাকায়াই থাকব একে অপরের পানে, সেভেন্টিসের জনপ্রিয় বাংলা কবিতার ইনফ্লুয়েন্সে, তেমন কথা আদৌ হয়েছিল বুঝি? পান করব আরণ্য শব্দাবলি, আলতো চুমুকে চুপচাপ, ছিল কি কথা তেমন? চোখ থেকে সরাবো না চোখ, বলেছিল কেউ? অনন্ত নক্ষত্রবীথির নিচে বয়ে-যাওয়া তারার বাতাসে ভরে উঠব পতপত-পালতোলা জাহাজের ন্যায় আমরা দু-জনা, কারো মুখে উচ্চারিত হয় নাই? কথা ছিল ধার্য রইবে একের জন্য অপরের সমস্ত, একার জন্য অনেকার অজস্র অন্তরার্দ্র গান, ছিল নাকি? ছিল না তেমন কথা কোনো?

কথা তো ছিল অনেক, অনুমান করি, কথা আছে কিছু অবশিষ্ট আর? শুধু সংহার, কথায় কথায়, রচনাসূচনায় একলাফে উপসংহার। কেবলই কাদা ছুঁড়ে বিষায়া তুলতেসি হাওয়ার সারল্য, জলের অবলীলা। আর হরবোলার হন্য-হদ্দ প্রয়াসগুলো অন্যবিধ অর্থ করাইতে যেয়ে ব্যাহত করতেসি আমরা হামেশা তার সুর-অনুরোধ। বুঝতে চাইতেসে না কারো বিষণ্ন রোদন অপরজন, বুঝতে পারতেসে না বিনম্র নিবেদন একজনায় অপরজনার। শুধু অপেক্ষা, আর শীতসন্ধ্যা, আর শিশিরভার, আর বসে-থাকা মানুষগুলা ঘাসের জঙ্গলে হাঁটু ডুবায়া, আর কেবল গুঁজ-করে-রাখা মুখ ও মনমন্দা রাত্রিশীত। প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে, এ-ই তো পরিস্থিতির প্রিসাইস বিবরণ।

২.
বহু বহুকাল বাদে, প্যারালাইজড এক অসহায় সন্ধ্যায়, একদিন শুনতে চাইল মন আমার সেই গান, লুকায়া থাকার সেই নির্বচনীয় অভিজ্ঞান। গানটার নাম ‘লুকিয়ে’, অ্যালবাম ‘ডুব’, বেমালুম ভুলে গেসলাম গানটার গীতিকার কে কিংবা কে এর সুরকার। ধরেই নিসিলাম কথা হোক যার তার, সুর নিশ্চয় কোকাকলায় ক্লিশে হয়া যাবার আগেকার আদি ও আস্লি অর্ণবের। কিন্তু, অবাক, না! সার্চ দিয়া দেখি এর কথা আর সুর ফারিহার! এর আগে এই জিনিশ হারাম খিয়ালই করি নাই যে এই চমৎকার গানটার গীতিকার ও সুরকার অর্ণব নন, আমি চিনি না এমন কেউ একজনের, নাম যার ফারিহা! শায়ান চৌধুরী অর্ণব, ইউটিউবের ডেসক্রিপশন পার্টে দেখলাম, গানটার কম্পোজিশন ও অ্যারেইঞ্জমেন্ট ও মিক্সিং করেছেন; ও, বলা বাহুল্য, গেয়েছেন। শুধু খটকা লাগল একটা জায়গায়; সুর ব্যাপারটাকেই তো কম্পোজিশন বলা হয় ইংলিশে, নাকি? কিন্তু, লক্ষ করে দেখসি, সংগীতজগতের কোর অ্যারিয়ার বাইরেকার কেউ সুর করলে সেইটাকে কম্পোজিশন না-বলে কেন জানি টিউন বলে অভিহিত করা হয়! এই বিদঘুটে ব্যাপারটা করেন প্রফেশন্যাল মিউজিশিয়্যানরা, বাংলাদেশে, আজব! ননপ্রফেশন্যাল সুরকারকে হেয়/খাটো করবার জন্যে?

যে-কারণেই হোক, এইটা আমাদের দেশে আকসার হয়। অ্যানিওয়ে, যেইটা বলবার কথা তা এ-ই, ইট’স্ নট অ্যা বিগ ডিল বলার উপায় নাই। ইট ইজ অভিয়াসলি অ্যা বিগ ডিল। আমার জানামতে একটা গানের সুরকার স্বত্ব ক্লেইম করতে গেলে টিউন শব্দ দিয়া কাজ হয় না, ইন্টার্ন্যাশন্যালি কপিরাইট ক্লেইম করতে গেলে কম্পোজিশন শব্দ দিয়া তা করতে হয়। কিন্তু আমি তো আর লাইনের লোক না, আমার ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু যারা লাইনের লোক তারা ব্যাপারটা নিয়া ভাববেন, সুর ব্যাপারটা টিউন না কম্পোজিশন, এবং সম্ভব হলে বলবেন।

৩.
সব মিলায়া গানটা দারুণ শ্রুতিস্নিগ্ধ। সুরের দিক থেকে, সংগীত ও আবহ আয়োজনের দিক থেকে, রেন্ডিশনের দিক থেকে চমৎকার একটা কাজ। এভারগ্রিন ল্যভ স্যং, সন্দেহ নাই। গীতিকার ও সুরকার ফারিহা, গাইসেন ও সার্বিক আয়োজন করসেন কোকস্টুডিয়োয় ক্লিশে হবার বহু আগেকার আদি ও আস্লি অর্ণব। গানটা, লুকিয়ে, শুনে দেখুন একবার/আরেকবার। এবং, গানের কথাগুলা পাঠ করুন, পড়ুন —

শীতের সন্ধ্যায়
আমার তোমার কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা?
তারার নিচে বাতাস বয়ে যায়
আমার তোমার কি কোথাও লুকিয়ে থাকার কথা?

সময় কি আমাদের স্বপ্ন দেখাবে?
নাকি নিয়ে যাবে আরও দূরে?
চলো ভাবি এই আশায় একসাথে হাত ধরে
সেই রোদজ্বলা মিষ্টি শীতের ভোরে, বিকেলে

এতকিছু কি আমাদের আজ হওয়ার কথা?
ভাবছি যা, সময় তা নিয়ে যায় অযথা

আমার তোমার কি কোথাও আজ হারিয়ে যাওয়ার কথা?
আমার তোমার কি কোথাও আজ লুকিয়ে থাকার কথা?

গান : লুকিয়ে; কথা ও সুর : ফারিহা; কণ্ঠ : অর্ণব;
কম্পোজিশন, অ্যারেইঞ্জমেন্ট, মিক্সিং : অর্ণব;
অ্যালবা : ডুব (২০০৮); লেবেল : বেঙ্গল মিউজিক কোম্পানি লিমিটেড

৪.
পক্ষাঘাতগ্রস্ত সন্ধ্যায়, মাছের চোখের চিত্রার্পিত অলস অনাসক্ততায়, আমার তোমার কি আবার আরেকটাবার কোথাও কোনো কোলাহলের আড়ালে একবার দেখা করবার কথা?

জাহেদ আহমদ


গানপারে অর্ণব

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you