খুব বেশি দিরং হবার আগে কথাগুলো বলে রাখতে চাইছিলাম, যদিও বহুবিধ বালামুসিবতে এরই মধ্যে দেরি বিস্তর হয়ে গেছে। বেশি নয়, দেড়-দুইটা মাত্র কথা। হাসান আবিদুর রেজা, ডাকনাম জুয়েল, আমাদের বয়সী মিউজিকলিস্নারদের কাছে এই আর্টিস্টের ঘটা করে পরিচয় দেয়া বাহুল্য মনে করি। তিনি তার সময়ের একজন ইউনিক ভোক্যাল আর্টিস্ট ছিলেন, এই বিবৃতির সত্যতা আমাদের আঙুলের একটি ক্লিকের দূরে বিরাজ করছে। সেদিকে এখন আর না যাই। ট্রিবিউট জানাইতে চাইছিলাম, দুই কি তিনটি স্মৃতি রিকালেকশনের মধ্যস্থতায় তা জানাইতে চাই। শিল্পী জুয়েলের গলা বা গায়কীর বা আবয়বিক উপস্থাপনের প্রশংসা আপাতত উহ্য রাখি অনিবার্য দুর্বিপাকে পড়ে। একসময় নিশ্চয় তা করতে সচেষ্ট হব।
অনুচ্ছেদান্তরে একটা আরও খবর ইয়াদ করিয়ে দেয়া দরকার। ডামাডোলের ভিতর অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন, জুয়েল ইন্তেকাল করেন চব্বিশের তিরিশ জুলাই। ঠিক পিঠাপিঠি ইন্তেকাল করেন শাফিন আহমেদ ওরফে মনোজিৎ দাশগুপ্ত শাফিন। শাফিনের মৃত্যুর সম্ভবত দুইদিনের মাথায় জুয়েলের মৃত্যুসংবাদ আমাদের কানে/মিডিয়ায় আসে। অ্যানিওয়ে। দেশে তখন মৃত্যুর মোচ্ছব। ভদ্রলোকি লিঙ্গুয়ায় মহোৎসব, মরণের। গণহননের হোতা হাসিনা তার পিতৃকুল মাতৃকুল ভ্রাতৃকুল ভগ্নিকুল শ্বশুরকুল ভাসুরকুল সব্বাইকে নিয়ে লেলিহান লুটপাটে মত্ত ছিলেন। টোয়েন্টিফোর্টি পর্যন্ত তখতে-তাউশ বহাল রাখতে ছিলেন অন্ধচক্ষু বদ্ধপরিকর। করছিলেন সেজন্যে যা যা কর্তব্য যথা গুম, খুন, গণহত্যা হাজারে হাজার কাতারে কাতার বেশুমার। শুমার করিয়া দেখিলে সর্বনিম্ন সময়ে কয়েক হাজার। এহেন অশ্লেষার রাক্ষসবেলায় ইন্তেকাল করেন বাংলাদেশপর্বের দুইজন লিজেন্ডারি মিউজিশিয়্যান জুয়েল ও শাফিন, একজন কর্কটে একযুগ ভুগে এবং অন্যজন অতি অকস্মাৎ বিদেশে শো করতে যেয়ে। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন।
জুয়েল প্রসঙ্গে যে-দুইটা মেমোরি রিকালেক্ট করতে চাইছিলাম তা করেই নিবন্ধ খতম করব। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় একফর্মা সাইজের একটা কাগজ বেরোত, কবিতার, দেখতে খুবই কিউট। এমন কিউট পত্রিকা আজ আর বাইর হইতে দেখা যায় না। কাগজটার নাম ছিল ‘জীবনানন্দ’, সম্পাদনা করতেন হেনরী স্বপন; কাগজটা বাইরাইতো বরিশাল থেকে। এর ব্যাকপেইজে সম্পাদনাপর্ষদ বা উপদেষ্টামণ্ডলীর নাম ছাপা হতো প্রিন্টার্স লাইনে। সেখানে একটা নাম ছিল হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, আরেকটা অনন্ত হীরা। এই দুইজনকেই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি ভিন্ন পরিচয়ে, একজন সংগীতকার ও অন্যজন মঞ্চনাট্যকার। ক্রমে এ-ও জানতে পারি যে উভয়ে জ্ঞাতিসূত্রে সম্পর্কিত। জুয়েলের সহধর্মিণীকেও লোকেইট করি নিউজপ্রেজেন্টার হিশেবে, সংগীতা আহমেদ। অনন্ত হীরার সহধর্মিণী থিয়েটারআর্টিস্ট নুনা আফরোজ। যা-ই হোক।
আরেকটা ফানি মেমোরি শেয়ার করেই নিবন্ধ থেকে বিদায় নেব। জুয়েলের পয়লা অ্যালবাম যদিও ‘কুয়াশা প্রহর’, আমাদের মনোযোগ ও নজর কাড়েন তিনি দ্বিতীয় স্টুডিয়োরেকর্ডেড অ্যালবাম ‘এক বিকেল’ দিয়ে। “সেদিনের এক বিকেলে / তোমার চোখে জল দেখেছি আমি”, এই গান মুখে মুখে ফিরেছিল বহুদিন বাংলাদেশের তরুণতর গানশ্রোতাদের। সত্যি বললে, রেন্ডিশন বিবেচনায় জুয়েলের সমস্ত গানের ডেলিভারি আপ টু দ্য স্ট্যান্ডার্ড হলেও ‘সেদিনের এক বিকেলে’ গানটিই ছিল গায়ক জুয়েলের পরিচয়তিলক। মজার ব্যাপার হলো, জুয়েলকে এবির ল্যুক অ্যালাইক হবার কারণে এই ধন্দ আমাদের বহুদিন পর্যন্ত বহাল ছিল যে জুয়েল আসলে আইয়ুব বাচ্চুর আরেক নাম কি না। আইয়ুব বাচ্চুই জুয়েল, এই বিশ্বাস নিয়ে একটা দোলাচল কাটতে লেগেছে আরও বহুদিন।
অনেক অনেক পরে, টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশনের এরা চালু হলে, একটা টকশোতে বাচ্চু-জুয়েল দুইজনে এসে সেই ফানি মেমোরিটা নিয়া সানন্দে আলাপ করেছিলেন। জুয়েল স্বীকার করেছিলেন যে তার ভক্তকুলের অনেকেই জিগ্যেশ করতেন, চিঠিতে এবং সাক্ষাতে, তিনি এবির আপন ভাই কি না। আর এবি যেহেতু জুয়েলের গানের সুর ও সংগীত আয়োজন করতেন, কাজেই এবির সঙ্গে তার সাযুজ্য সবাই নির্দ্বিধায় মেনেও নিতেন। কিন্তু এইটা আজ অস্বীকার করার উপায় নাই যে এবি বহু ভয়েসআর্টিস্ট বাংলা গানের শ্রোতাদের উপহার দিলেও জুয়েল তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন এবং থাকবেন।
শাফিন আহমেদ ট্রিবিউট
আইয়ুব বাচ্চু ট্রিবিউট
সঞ্জীব চৌধুরী ট্রিবিউট
- জুয়েল, সেদিনের সেই বিকেল - January 3, 2025
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
COMMENTS