যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা … নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ …
বিসর্জনের বিষণ্নতা বাতাসে, তেতো নয়, মিষ্টি বিষাদ। বিসর্জনবাতাস। বাংলা শব্দ বিষণ্নতা, প্রায়শ আমরা যার অনুবাদ করে ফেলি ডিপ্রেশন, আদৌ কোনো অসুখ অথবা বালাই-ব্যামো নয়। ব্যামো অর্থের ইংরেজি বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন কবিরাজের অ্যারিয়া অফ জুরিসডিকশন, বঙ্গীয় বিষণ্নতা কবির। বাংলা বিষাদ অত্যন্ত সৃজনবান্ধব এক পরিস্থিতি, প্রো-ক্রিয়েটিভিটি, কিছু-না-কিছু করার বা বিশেষত লেখার ও আঁকার অনুপ্রেরণা। আমাদের যা-কিছু অর্জন, যা-কিছু শৈল্পিক, সত্যসুন্দরশিব যা-কিছু, সমস্তকিছুর পেছনে এই বিষণ্নতার প্রাণনা অবদায়ক হিশেবে ক্রিয়াশীল। মহাভারতের মা নিষাদ উচ্চারণমুহূর্ত ও তৎপূর্ব-তৎপরবর্তী কীর্তি-কীর্তনকলাপ স্মরণ করুন।
—
রূপকের মুখ মনে পড়ছে। দিবাকরকে মনে পড়ছে। এরা দুজনে নেই পৃথিবীতে আর। রূপক রঞ্জন দেব ও দিবাকর ভট্টাচার্য। অবিরাম জাগিবার, ঘুমাবার, জানিবার শুনিবার দেখিবার দায় ও নির্মম ভার হইতে মুক্ত এরা। লাইফের শুরুতেই বিদায় নিয়েছে এরা লাইফ থেকে। এদের দুজনেরই সনে দুর্গাপুজো জড়িয়ে আছে আমার। দিবাকর অ্যাডিয়্যু জানায় ঢের আগে, গত শতকে, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে। রূপক একবিংশ শতকের মৃত্যুজাতক। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর বাবু রূপক রঞ্জন দেব উড়াল দেন। মরাবাঁচা ব্যাপারস্যাপার, — কথাটা তাইলে এই সুযোগে বলেই ফেলি, — বিরাট গাঁজাখুরি ছাড়া আর-কিছুই না। মারা যাবার ছয়ঘণ্টা আগেও রূপকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ঈদের পূর্বরাত্রি ছিল, কিছু মনোমালিন্য তৈরি হয়ে গেছিল শেষের পাঁচ-ছয়মাসে। রূপকের সঙ্গে দুইযুগের চলাফেরার ভেতর প্রথমবারের মতো মনোমালিন্য, এবং কী হাস্যকর ও বদনসিব আমার, শেষ মনোমালিন্যও! মণ্ডপে মণ্ডপে, দুর্গাপুজোয়, রূপক ও আমি, ঘুরেছি, দেখেছি বিগ্রহ ও দ্য লিভিং ডুর্গাস্, মনখারাপ হয়েছে ফের ঝলমলিয়ে উঠেছে মনের দেহ, দুইই হয়েছে সুন্দরের সাক্ষাতে। রূপক, শুভ বিজয়া! হ্যাপি দুর্গতিনাশিনী ভিনজাগতিক শরৎকাল, দিবাকর ভটচারি!
—
বিজয়াশীর্বাদ জানালেন আমার সহকর্মী ও সতীর্থ সত্যজিৎ রাজন, ওর্ফে সত্যজিৎ চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী, মুঠোফোন-চির্কুটে। লিখেছেন : “যা দেবী সর্বভূতেষু শব্দরূপেন সংস্থিতা, নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ” — শুধু ওইটুকু। শুভেচ্ছাবাচনের ভেতর সূক্ষ্ম সম্পাদনাটুকু নজর করার মতো। উমা দেবীকে শব্দরূপা কল্পনা করা। ভাবছিলাম, আমি যদি মুর্গিমিলন কি স্যুইডেনআসলাম হইতাম, তাইলে সত্যজিৎ নিশ্চয় লিখতেন : যা দেবী সর্বভূতেষু অস্ত্ররূপেন সংস্থিতা … না, হাস্য করি না, কামনা করি যেন মহিষাসুরগুলো বধ হয় অথবা তাদের চৈতন্যবোধোদয় ঘটে। শুভশক্তির বোধন ঘটুক, দেবীপক্ষে এ-ই হোক প্রত্যাশা। যা দেবী সর্বভূতেষু শুভরূপেন সংস্থিতা …
—
আশ্বিন ছাব্বিশ, শুরু হয়ে গেল দুর্গাপূজা, শারদীয় দুধসন্দেশের ধবধবে ধলপ্রহর-সকাল। সিজন অফ মিল্ককেইক। মিল্কশেইক নৈব চ। আজকাল আমার বাচ্চারা, আর তাদের মা-বাপেরা, যেই হারে মিল্কশেইকভক্ত, আমি দেখি আর বাকরহিত হই। পিঠা তারা আজ আর খেতে চায় না, পায়ও না খেতে। এবং না-পেয়ে, কিংবা অন্য কোনো অথবা নানাবিধ অন্যান্য কারণে, এদের স্বাদযন্ত্র ও রসনাগ্রন্থিতে একটা পাকাপাকি চেইঞ্জ এসে গিয়েছে। হয়তো। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসছি আশ্বিন পয়লা পক্ষে, ১৭ বা ১৮ থেকে, দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যায়। এখন দেখি, বড় হতে হতে ইদানীং, পূজার মহরৎ কেবল পেছাচ্ছে। এ-বছর দেখি শেষপক্ষে যেয়ে ঠেকেছে পূজাশুরুর সময়। এইটা গাণিতিক হিসাবে তেমন কোনো ভুল তো নয়। নিশ্চয়। পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির এইটা অবধারিত রেজাল্ট। ভূগোল পড়তাম যদি মন দিয়া, তাইলে তো আইজ বুঝাইতে পারতাম। যদিও দিবাভাগে দাহ তথৈবচ, সন্ধ্যার পর ক্যুলিং ইফেক্ট টের পাওয়া যায়। গেল হপ্তায় একটানা দুইদিন ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে গেলেও পুরোপুরি শীতের আমেজ পেতে এখনো অনেক দিরং সইতে হবে।
—
এইবার জোরেশোরে নেমে আসুক শীত, চাইছি।
শীত আসুক।
বসুক শীত বনকুসুমের গুল্মলতায়িত।
ঝরুক ঝর্ণাপারদের মতো উইন্টার সুবাসিত।
অপেক্ষায়, শীতকাল, তুমি কবে আসবে বলো তো?
মধ্যিখানে হেমন্ত।
মুখোপাধ্যায় মশাইয়ের গলার মতো, অদ্ভুত বৈরাগ্যবহ, ভরাট, স্বরাট, প্রোফাউন্ড বিউটি।
জীবনানন্দকবিতার আদি ও অন্ত জুড়ে এই ঋতু ভরভরন্ত।
—
মরি হায়, শরৎ চলিয়া যায়! এরপর শীত। কত প্রস্তুতি উনার, কত সমারোহ কত-না আড়ম্বর, সম্রাজ্ঞী শীতের! শরৎ ও হেমন্ত — দু-দুটো তোরণ পেরিয়ে, দুই-দুইটা গার্ড অফ অনার পেয়ে, এরপর তিনি এসে বসেন সিংহাসনে। এর অনেক আগে থেকেই উনার আগমনি গীত শোনা যায় যদিও, শাস্ত্রমতে তেরোই ভাদ্র উনার জন্ম হলেও জমানা খানিক বিগড়ে যাওয়ায় ভাদ্রে সেভাবে এখন শীত আঁচ করা সাধ্যির প্রায় উর্ধ্বে, সূক্ষ্ম অনুভূতি-ইন্দ্রিয়যোগে একদম জবাকুসুমসঙ্কাশং ভোরবেলা আঁচ পাওয়া যায় জন্মলগ্নী শীতের। তবে, সেই শীত জ্যান্ত গোটা-দুই আন তো — যদি ফর্মাশ করেন কেউ, কোনো সুকুমারপৌত্র, মুসিবতে পড়া ছাড়া গত্যন্তর দেখি না। আজি হতে তেইশ বর্ষ পূর্বেকার শীত আর আজিকার শীত অভিন্ন তো নয়। আর কে না জানে যে অ্যানশিয়েন্ট কাল থেকেই মওসুম থোড়া-সা বেইমান হ্যায়। এখন সেই বেইমানি আরও অকহতব্য। মুহুর্মুহু মিনিটে-মিনিটে অ্যাভেন্যুপার্শ্বের বিলবোর্ড বদলাইবার মতো জলবায়ু বদলায়, চেইঞ্জ হয় সিজনের ভাবগতিক ও আবহাওয়া। আজকাল অতি সীমিত আয়ু লইয়া আরোহন করেন ভুবনেশ্বরী শীতরাধিকা তার তখত-এ-তাউশে। এবং যদিও অত্যল্প অধিবাস আজকালকার উইন্টারের, তবু তার রূপের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে হেথা-হোথা সবকিছু, সব্বাই, কত লোকের ঠোঁট ফেটে যায় পা ফেটে যায় ত্বক খসখসে হয়ে যায় শীতদেবীর রূপের তজল্লায়! এবং গন্ধবণিক ও রূপদোকানিরা এই ফোকটে টুপাইস কামাইতে লেগে যায়। শীতের শীর্ষ বলতে এখনও বড়-সড়কের দুইধারে একেকটি শিমলতার মাচান, সকালে-বিকালে সেই শিমঝোপা মাচানের লতায় লতায় লিকলিকানো খয়েরিবর্ণ ফুল, শিমফুলে লেগে-থাকা নাকছাবি শিশিরের স্ফটিকস্বচ্ছ মধু!
—
দুর্গাপুজোর সিজনে, ছেলেবেলায়, আমাদের আম্মা একটা গান খুব কমন গাইতেন। দুপুর বারোটায় ছুটি হয়ে যেত স্কুল, মর্নিং শিফ্ট ছিল, স্কুলফের্তা আমি মূর্তিমতি বিপদের ন্যায় আম্মাকে জ্ঞান করতাম। অসম্ভব মধুর প্রতারণাকারিণী তিনি। ভুলিয়েভালিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে ঘুমপাড়ানির কাজে এই মহিলার মতো দক্ষ দ্বিতীয়া কাউকে পাইনি আজও, খুঁজছি, হোয়াটেভার। তক্কে তক্কে থাকতেন তিনি আমাকে ঘুম পাড়াতে। আমি যত বলতাম আধাঘণ্টা ফুটবল শটিয়ে এসে তারপর ঘুমাব, উনি বলতেন উল্টোটা হোক। উনি বলতেন, ঘুমাতে হবে না, আধাঘণ্টা খাটের পেটে রেস্ট নিয়া তারপর ফুটবল অথবা আস্ত দুনিয়া যা-ইচ্ছা শটাইতে যাও বাপ! মহিলার কনফিডেন্স লেভেল চিন্তা করে আজ টাশকি খাই। প্রতিদিন ওই মিছরির মুখ মাতৃরূপা মায়াবিনীর পৌনপুনিক ছলনাজালে পড়তাম আর সন্ধেসন্ধি বিকেলবেলা আধো চোখ মেলে দেখতাম পৃথিবীর সমস্ত ফুটবল আকাশে ছুঁড়ছে আমার ইশকুলসঙ্গী কিংবা পাড়াতুতো বন্ধুরা, তারা আমার জন্য ওয়েইট করতে করতে একসময় বদলা প্লেয়ার নিয়া খেলতে লেগে গেছে। এত বেদনা হতো তখন! সমস্ত বেদনা একসময় ক্রোধে রূপ নিত, আম্মার বিরুদ্ধে সম্ভব-অসম্ভব অনেকরকম ক্রোধ চরিতার্থকরণের পথ-পন্থা-স্ট্র্যাটেজি নিয়া ভাবতাম ফুটবলমাঠের কিনারায় খাজুল মুখে ঘাসে পাছা ফেলে বসে। সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগে স্ন্যাক্স খেতে দেয়া হতো মুড়ি-বিস্কিট ইত্যাদি যেদিন যা জুটাতে পারতেন আম্মা বেচারি, মুড়ির বাটি কি বিস্কিটের পিরিচ ঝটাং ছুঁড়ে ফেলে সক্রন্দন উঁচু গলায় আম্মার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো কন্সিডারেশনে এনে সেইগুলো শোধরানোর জন্য আম্মার কাছেই অনুযোগাত্মক ফরিয়াদ জানাতাম, আম্মা তাৎক্ষণিক নিজেরে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়া গালমাথা হাতিয়ে-মাতিয়ে পড়ার টেবিলে পাঠাতেন। তো, থাক এসব, মহা আমার আম্মাকাহিনি লিখতে গেলে অডিসি পিছে পড়ে যাবে, আর আমি তো ভাই ইলিয়াড নই। কিন্তু গানটা শুনায়ে বিদায় নেই নিবন্ধের এই ভুক্তিটি থেকে। সেইসব ঘুমপাড়ানিয়া কারসাজিমূলক দুপুরগুলোতে, এই দুর্গাসিজনে, আম্মা তার ছেলেবেলায় দেখা পূজাস্মৃতি চারণ করতেন আমাদের সঙ্গে। এবং বলতেন তার বান্ধবীদের নানাবিধ শয়তানির গল্প। আর ঘুমট্যাবলেট সুরে টেনে টেনে গাইতেন এই গান, — দুপুরবেলার ঘুঘুপাখিবিধুর চুমুনম্র অর্ধস্ফুট গলায় : দেবী যাও গো জামাইর ঘর / বচ্ছর ফুরাইলে দেবী আনাইমু নাইওর …
লেখা : জাহেদ আহমদ ।। লেখাকাল : ২০১৩
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS