বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। সেই জন্মগ্রামের নামটাও বেশ কাব্যমাখা; — সুখলাইন। সত্যি, সুখেরই যেন লাইন পড়ত গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র, এরপরও বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত! বৈশাখ থেকে চৈত্র — উৎসবের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ত। দেখা গেল — ভালো খাবারদাবার জোটা তো দূরের কথা, দিনে একবেলা উনুনে হাঁড়ি চড়ত, অথচ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সেই বাড়ির কোনো সন্তান কিনা এলাকার ডাকসাইটে শিল্পী হিসেবে খ্যাত। তো, সেই গ্রামে যখন কোনো উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হতো, তখন ধারণা করে নেওয়াই যেতে পারে — কেমন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ধুম পড়ত! আর গ্রামের সবাই যেহেতু হিন্দুধর্মের অনুসারী, সংগত কারণেই অন্য উৎসবের চেয়ে দুর্গাপুজো এখানে বহুবর্ণিল ও রঙিন রূপে আমাদের কাছে ধরা দিত।
বাবার চাকুরির সুবাদে শৈশবে (শৈশব বলা ঠিক হবে না, বলা উচিত না-বোঝা বয়সে) গ্রাম ছেড়েছি। তবে বাবার চাকুরিস্থল ঘুঙ্গিয়ারগাঁওবাজার নামক মফস্বল শহরের যেখানে আমাদের বাসা ছিল, সেটিও গ্রাম থেকে বেশি দূরে ছিল না। মাত্র পৌনে-এককিলোমিটারের হাঁটাপথ। সেই ঘুঙ্গিয়ারগাঁওবাজার ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বসবাস। তবে সুখলাইন কিংবা ঘুঙ্গিয়ারগাঁওবাজার যেখানটার কথাই বলি না কেন, সেখানে দুর্গাপুজো ছিল ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের মিলিত এক প্রাণের উৎসব। দেখা গেল পুজোর আনুষ্ঠানিকতা শেষে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানও এসে প্রসাদ গ্রহণ করছেন (একই চিত্র কিন্তু ঈদের সময়েও দেখা যায়, ঈদগাহ ময়দানে নামাজ আদায় শেষে ইসলামধর্মাবলম্বীরা যখন বাসায় ফেরেন, তখন হিন্দুরা এসেও তাদের বাসায় পিঠা-সেমাই খাওয়ায় অংশ নেন)। আবার পুজোর রাতে যখন বাউলা কিংবা মালজোড়া গানের আসর বসে, সেখানে হিন্দুদের পাশাপাশি শিল্পী হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরাও হাজির থাকেন। এখনও এটা বহমান, আর এটাই হলো বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের শাশ্বত সংস্কৃতি।
শৈশবে দুর্গাপুজো মানেই নতুন জামাকাপড় কেনা, আর সেই নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে একদিনের জন্য হলেও জন্মগ্রাম সুখলাইনে যাওয়া। সে-গ্রামে কেবল ডাক্তারবাড়িতেই পুজো হতো। সেখানে মণ্ডপে মা দুর্গাকে প্রণাম শেষে গ্রামের পাশের দাড়াইন নদীর পারে বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যেতাম। গ্রামসংলগ্ন বিশাল মাঠের পাশে যে ঝোপঝাড় ছিল, সেখানে বড় একটি কাশবনও ছিল। সেই ভরদুপুরে সফেদ কাশবনে ছুটোছুটির অনুভূতিই ছিল অন্যরকম। তবে সবচেয়ে সুন্দর সময়টুকু কাটত ঘুঙ্গিয়ারগাঁওবাজারে। সেখানে শাহীদ আলী পাবলিক পাইলট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে যে-পুজো হতো, মূলত সেখানটাতেই কাটত আমাদের আনন্দঘন সময়। সন্ধ্যায় আরতি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হতাম। ধূপের মনকাড়া সুগন্ধি আর ‘ধূপতিওয়ালা’-র নেচে নেচে আরতি প্রদর্শন, আহা, কী অপূর্ব ভঙ্গিমা আর শারীরিক কসরতের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে ধূপ দেখানো হতো! বড় হয়ে এ-রকম ধূপতিওয়ালা হওয়ার বাসনাও ছিল সে-সময়।
কিশোর বয়সে যখন হাইস্কুলের ছাত্র, তখন বিশেষত পুজোর রাতগুলো ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এমনিতেই বাবার কড়া শাসনে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে বেরোতে পারতাম না। কিন্তু পুজোর সময় সেই কড়াকড়িতে শিথিলতা দেখানো হতো। বাঁধনহারা হয়ে রাতবিরেতে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে বেড়াতাম, নিজেকে মনে হতো থ্রিলারের কোনো দুরন্ত নায়ক। সেই থ্রিলারের নায়কভাবা সময়ে, অর্থাৎ পুজোর সময়টাতে, বন্ধুরা দলবেঁধে হাইস্কুলের মাঠে মাঝরাতে-শুরু-হওয়া বাউলা কিংবা মালজোড়া গানের আসরে নিবিষ্ট শ্রোতা হতাম। শাহ আবদুল করিম, রুহী ঠাকুরদের গান শুনতাম। ঢপযাত্রা কিংবা যাত্রাগান দেখতে দেখতে সে-পালার নায়ক চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্নও দেখতাম। আহা! কতই-না সুন্দর ছিল পুজোর দিনগুলো রাতগুলো!
একটা সময় উচ্চশিক্ষার জন্য মফস্বলের সেই প্রিয় শহর ছেড়ে সিলেট নগরের বাসিন্দা হই। কাজের সুবাদে এ-নগরেই এখন থিতু হয়েছি। এখনও দিনক্ষণ মেনে আগের নিয়মেই পুজো আসে। কিন্তু শহরের পুজো আমাকে তেমনভাবে টানে না। মণ্ডপগুলোর চোখধাঁধানো রঙিন বাতি আর আতশবাজিতে আমার মন ভরে না। এখানে লাউড স্পিকারে উচ্চস্বরে হিন্দিগান চলে, সেই গানের সঙ্গে চলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিসমেত নৃত্য — বড় অচেনা মনে হয় এই সংস্কৃতিকে। এসব দেখে দেখে হতাশ হই আর তখনই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে নিজ জন্মমৃত্তিকা সুখলাইনে কিংবা কৈশোর-তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত ঘুঙ্গিয়ারগাঁওবাজারে। সেখানে গিয়ে রাতদুপুরে কোনো মণ্ডপে শুনতে ইচ্ছে করে কোনো-এক অখ্যাত ফকিরের কণ্ঠে শাহ আবদুল করিমের লেখা সেই গান, — “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম / গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান / মিলিয়া বাউলাগান ঘাটুগান গাইতাম …
রচনাকাল ২০১৬
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS