মানুষ থাকলি আল্লা আছে, মানুষ ভজো গিয়া || সুমনকুমার দাশ

মানুষ থাকলি আল্লা আছে, মানুষ ভজো গিয়া || সুমনকুমার দাশ

তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি, বন্ধুদের সঙ্গে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনধামে গিয়েছিলাম। আজ আমরা যে লালন কমপ্লেক্স দেখছি, তখন সেখানে এত দালানকোঠা এবং চাকচিক্য ছিল না। নগরায়ণের ছোঁয়াও ততটুকু পায়নি — সেটা উনিশ শ নিরানব্বইয়ের কথা। আমরা ছিলাম নয় বন্ধু। সারা রান্তা হৈ-হুল্লোড় আর বেসুরো গলায় লালনের পদ আওড়িয়ে যখন ছেঁউড়িয়া পৌঁছি তখন মধ্যদুপুর। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার উদ্দেশে লালনধামের ঠিক পাশের একটা ভাঙা ছাউনি আর পাটকাঠির বেড়াসম্বলিত টং দোকানে ঢুকলাম।

দোকানে ঢুকেই চোখে পড়ল একজন বয়স্ক লোক নীরবে চা পান করছেন। আমাদের দেখে আগ বাড়িয়েই কথা বললেন, ‘বাপ রে, সাঁইজির কাছে আসছিস্?’ আমাদের কেউই তাঁর কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ফলে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ছিলাম। তিনি যখন পুনরায় হাত জোড় করে বুকে-কপালে ঠেকিয়ে প্রণামভঙ্গিতে বললেন, ‘লালন সাঁইজি আমার মনের মধ্যে আছে রে বাপ। তোমাদের মনের মধ্যেও আছে।’ এরপরেই তিনি প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘নাকি ভুল কলাম?’ তখন আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে — তিনি ‘সাঁইজি’ বলতে লালনকেই বুঝিয়েছেন।

এভাবেই আমাদের আলাপ জমে ওঠে। এরই মধ্যে জেনে যাই — তিনি হচ্ছেন ফকির দুর্লভ শাহ। কুষ্টিয়ায় আমাদের প্রথম পরিচিত ব্যক্তি। খাওয়া শেষে তাঁকে নিয়েই ধামে ঢুকি। তিনি আমাদের ঘুরিয়েফিরিয়ে সবকিছু দেখান। ২০১১ সালের অক্টোবরে লালন মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠান দেখার জন্য যখন দ্বিতীয়বারের মতো কুষ্টিয়া যাই, তখন প্রথমেই ফকির দুর্লভ শাহের খোঁজ করি। এক বাউল-সাধুর কল্যাণে পেয়েও যাই ঠিকানা। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন ছেঁউড়িয়ার কারিগরপাড়ার ঠিক শেষ বাড়িটিতে।

ফকির দুর্লভ শাহের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটাও বেশ চমৎকার। যাওয়ার সময় চোখে পড়বে প্রশস্ত রাস্তা, দুপাশে সারি সারি গাছ আর তাঁতপল্লি। তবে তাঁর বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার পর একটু হতাশ হতে হয়। বাড়িতে ঢোকার কয়েক শ গজ আগে থেকেই কাঁচা মাটির রাস্তা। আগের রাতের সামান্য বৃষ্টিতেই হয়তো জল-কাদায় থিকথিক করছে, কাদা-মাটির দুর্গন্ধও নাকে এল। স্যান্ডেলে-পায়ে কাদায় একাকার করে একসময় আমরা ফকির দুর্লভ শাহের ঘরে ঢুকি।

ঘর বলতে যা বোঝায়, সেটা কিন্তু তাও নয়। টিনের চালা আর বাঁশের তৈরি বেড়া। একনজর দেখলেই সবার মনে পড়বে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের সেই বিখ্যাত ‘আসমানী’ কবিতাটির কথা —  ‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা, ভেন্না পাতার ছানি’। ঘরে যে বেড়া দেওয়া হয়েছে, সেটি নিতান্তই দিতে হবে বলে দেওয়া। কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে হালকা বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। ঘরের ভেতর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনায়াসে বাইরের সবকিছু দেখা যায়।

বেড়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছি — হয়তো এই ঘরে দুর্লভ শাহ ‘শীতরাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে’ থাকেন। নিমিষেই কল্পনায় ভেবে নিলাম — শীতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে হাড়কাঁপানো বাতাস আসে। এবং বাতাস উপেক্ষা করে একটা কাঁথা গায়ে তিনি কোনোমতে লেপ্টে দিনরাত কাটান। ঘরে দুইটি চৌকি। একটি চৌকির সামনের অংশ আগুনে পুড়ে কালোরঙ হয়ে রয়েছে। অপর একটি চৌকিতে ছোট শিশুর মতো গুটিসুটি হয়ে হাত-পা এক করে শুয়ে রয়েছেন ফকির দুর্লভ শাহ। খালি গা, গলায় একটি বিশাল সাইজের কালো রঙের তাবিজ ঝুলানো, হাঁটুর উপরে লুঙ্গি উঠে আছে আর মাথাটা বালিশ থেকে সরে গেছে। সারা শরীরের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ, তবু কী ফর্শা জ্যোতি বের হচ্ছে পুরো শরীর থেকে!

আমাকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখে একজন অর্ধবয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন। তিনি জাগিয়ে তুললেন দুর্লভ শাহকে। চৌকির এক কোণায় গিয়ে বসতেই অনেকটা যেন দোলনার মতো দুলে উঠল পুরো চৌকি। সামান্য একটু এদিক-ওদিক নড়লেই মড়মড় শব্দ করে। সেই শব্দ উপেক্ষা করে নিরানব্বই সালের ভাসা-ভাসা স্মৃতি নিয়ে ফকির দুর্লভ শাহের মুখোমুখি হই। প্রথমেই তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি — ‘নিরানব্বই সালে আপনার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল।’ তিনি বললেন, ‘হবে হয়তো! ম্যালা আগের ঘটনা বোধহয়, মনে নাই আর!’

আমি আর কথার সুযোগ পেলাম না। দুর্লভ শাহ নিজে থেকেই বলে উঠেন : ‘মরণের বাতি যে জ্বলবি কবে? এই যে বাঁইচে আছি — সাঁইজির কৃপা না করলি বাঁইচে থাকতাম কেমনি? এই জীবনে মানুষির সেবা করতি পারলাম কই? — অ্যাই, তোরা কে আছিস্? — তাড়াতাড়ি আয় — গান গাইতি হবি যে!’ গান গাওয়ার জন্য তিনি কাকে ডাকলেন তা আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট হলো না, তবে কারো অপেক্ষা না করেই ১১৭ বছর বয়সী এই বাউলসাধক একমনে হাততালি দিয়ে গাওয়া শুরু করলেন :

লণ্ঠনে রূপের বাতি জ্বলছে রে সদায়
দেখো না রে মন দেখতে যার
বাসনা হৃদয়।।

রতির গিরে ফসকা মারা
শুধু কথার ব্যবসা করা
তার কি হবে রূপ নিহারা
মিছে গোল বাঁধায়।।

যেদিন বাতি নিভে যাবে
ভাবের শহর আঁধার হবে
সুখপাখি সে পালাইবে
ছেড়ে সুখালয়।।

সিরাজ সাঁই বলে রে লালন
স্বরূপ রূপে দিলে নয়ন
তবে হবে রূপ দরশন
পড়িসনে ধাঁধায়।।

এত বয়স, অথচ কী সুন্দর ভরাট কণ্ঠ! আমার মুগ্ধতার রেশ না-কাটতেই তিনি পুনরায় কথা বলা শুরু করলেন : ‘মানুষ থাকলে আল্লা আছে, না থাকলে কী হবে? মানুষ নাই, আল্লাও নাই। ধর্মগ্রন্থে আল্লা নাই, আল্লা আছেন মানুষের ভিতরে। তাই মানুষ ভজো গিয়া, মানুষের মধ্যে আল্লা-ভগবান সবকিছু।’ এরপর আমার উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন ছোঁড়েন : ‘সত্যি না মিথ্যা কলাম?’ আমি উত্তর দিই : ‘সত্যি বলেছেন।’ এরপর তিনি একনাগাড়ে বলে চললেন : ‘তে, বোঝো অবস্থা! কোন কালামে কোন ভেদ আছে — বলতে পারো? সবটাই সাঁইজির ইচ্ছা। সাঁইজি মানবজাতির জন্যি সব বলে গেছেন। মানুষে-মানুষে মিল না থাকলি হবি ক্যামনে? এই মানুষের সন্ধানেই জীবন কাটালাম রে বাপ! মানুষ ধরবার আশায় লালনের মাজারেই পড়ে থাকতাম বেশি। বুঝছেন বাপ?’

দুর্লভ শাহ বলছেন আর আমি একমনে শুনছি। একসময় নিজের মুঠোফোনের রেকর্ডার অপশন ওপেন করে তাঁর মুখের কাছে ধরলাম। সেই মুঠোফোনে রেকর্ড হতে শুরু করল দুর্লভ শাহের কথা : ‘লালন বলছেন — তোর ভিতরে কি আছে, তাই আগে চিন। সেটাই পরকালের উদ্ধারের চাবি। তোর ভেতরেই আল্লা আর ভগবান। এঁরা দুইজন দ্বৈতনাথ, একজনের ভিতরে আরেকজন আছে। দুইজনই এক, আর এই মানুষটাই আছে তোর ভিতরে। মিথ্যে কথা বলবে নে, সত্যপথে চলবে, তুমি অন্যায় করবে নে, দেখবে আল্লা কও আর ভগবান কও, তাঁর সন্ধান ঠিকই পাবে। ওই আছে সাঁইজির গানে — ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন / সত্য সুপথ না চিনিলে, পাবি নে মানুষের দরশন।’

একপর্যায়ে রামায়ণের বীর হনুমানের গল্প শোনান দুর্লভ শাহ। তিনি বলেন, ‘বীর হনুমান টান দিয়ে নিজের বুক ছিঁড়ে রাম-লক্ষণ-সীতাকে দেখালেন। অর্থাৎ ভগবানকে দেখালেন। তে, তুই খালি আল্লা আল্লা করলি, কিন্তু আল্লা দেখাতি পারলি না। তালি তুই তো পশু হনুমানের চেয়েও অধম। তালি তো দেখা যায় তোর বুকের ভিতরে আল্লা নাই, ভগবান নাই! এইজন্যি ঠিকমতো সাধনা করতি হবে। সাধনা করলে সব পাবি। প্রহ্লাদের ঘটনাটা তো তাই-ই। একমনে ডাকছে বলেই তো সে ভগবানরে পাইছে। তে, খালি ডাকলেই হবে না, মন থাকি ডাকতে হবে। এই যে আল্লা-ভগবান বললাম, তার সঙ্গে যুক্ত হতি হবে। নিজের কাছেই আল্লা-ভগবান আছে।’

দুর্লভ শাহ একটু থামেন। বেশি কথা বলে ফেলার কারণেই হয়তো হাঁপাচ্ছেন। আমি তাঁকে একটু থামতে বলি। কিন্তু তিনি সে-কথা না-শুনে বলতেই থাকেন : ‘ওই মক্কায় গিয়া দেখবে পাথরের মক্কা, ওখানে চুমুক দিলে কি কিছু বের হয়? হবেও না। আপন ঘরের মক্কায় চুমুক দিলে আল্লা ঠিকই আসবে। আর নিজের ঘরে যে স্ত্রী আছে, তারে সম্মান দিতে হবে। আমার দাদারা অন্যায় করল, বাবারা অন্যায় করল, আমি নিজেও অন্যায় করছি। সেই অন্যায় করা যাবে না। পরকালের সব হচ্ছে স্ত্রী, সেই স্ত্রীই উদ্ধার করব। স্ত্রীর সঙ্গে নামাজ করব, চুমু দিব, তার দুধেও একটু চুমু দেওয়া যায়, সব যায়, কিন্তু প্রোডাকশন করব না। মনে রেখো বাপ, প্রোডাকশন করলেই কিন্তু মরে গেলায় রে। বউকে মা বললে সমস্যা কোথায় রে বাপ? নিজের বউটাকে কষ্ট দিবি নি, পরের মেয়ে পরের ঘর থেকে আসছে, তারা মা জ্ঞানে ভক্তি করবি রে।’

কথা বলতে বলতে দুর্লভ শাহের মুখে সাদা ফেনা জমে ওঠে। হাত দিয়ে ফেনা মুছে তিনি জানান, তাঁর গুরু কোকিল শাহ, দাদাগুরু ভোলাই শাহ আর বড়বাপ হচ্ছেন লালন। আর জন্মদাতা পিতা হচ্ছেন যদু মল্লিক, মা খুকি। তিন মেয়ের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ভিটেমাটিতেই তাঁদের সংসার। স্ত্রী মারা গেছেন বেশ আগে। ঘরের ঠিক পাশেই স্ত্রীর কবর। দিনরাত স্ত্রীর কবরের দিকে তাকিয়ে আফসোস করেন। একমাত্র ছেলেও দেহ রেখেছেন সেই কবে।

জীবনকথা বলতে গিয়ে দুর্লভ শাহের চোখে পানি জমে। ডানচোখে ছানি পড়ায় তিনি দেখতে পারেন না বললেই চলে, সেই চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। কয়েক ফোঁটা পানি রঙ-ক্ষয়ে-যাওয়া ছেঁড়া বিছানার চাদরে গড়িয়ে পড়ে। তিনি ডান হাত দিয়ে চোখ মুছে গান ধরেন :

বান্দা ফুলসুরাতের কথা কিছু
ভাবিও মনে।
পার হতে অবশ্য একদিন
হবে সেইখানে।।

বলব কি সেই পারের দুস্কর
চক্ষু হবে ঘোর অন্ধকার
কেউ দেখবে না কারও আকার
কে যাবে কম্নে।।

সে-পথ ত্রিভঙ্গ বাঁকা
তাতে হীরের ধার চোখা
ইমান আমান হলে পাকা
তরবি সেইখানে।।

ফাতেমা নবিজির ফরজন
তার দাউন ভরসা তখন
এখন মেয়ে দোষে লালন
দেখলে সামনে।।

সেদিনের দেখা দুর্লভ শাহ প্রসঙ্গে একটু পরে আবার ফিরে আসছি, এরই ফাঁকে আমরা দুর্লভ শাহ প্রসঙ্গে কবি-গবেষক আজাদুর রহমানের ‘নির্জনতার নিমগ্ন সাধক ফকির দুর্লভ শাহ’ শিরোনামের একটি লেখার কিছু অংশ জেনে নিতে পারি। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘লালন মত লালন পথ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন :

“দুর্লভের জন্ম ইংরেজ আমলে। ছোটবেলায় স্কুলে গিয়েছেন কি না পরিষ্কার মনে নেই। বাবার সাথে কাজ করে অনেকটা এলোমেলোভাবেই কেটে যায় শৈশবকাল। তারপর যুবক বয়সে কুষ্টিয়া মোহিনীমিলে আট টাকা মাইনের চাকুরি নেন। তিনি একবারে লালনপথে আসেননি। গল্পটা অন্যরকম। প্রথম জীবনে তিনি ইসলামপুরের পির খোদা মওলানা সাহেবের মুরিদ ছিলেন এবং পিরের উপদেশমতো নামাজ-রোজা করতেন। আর দশজন মুরিদের মতো ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু মানুষকে ভক্তি করা যাবে কি না — এ নিয়ে দুর্লভের সাথে পির খোদা মওলানার বাহাস হলে দুজনের মধ্যে দ্বিমত হয়ে যায়। দুর্লভের ভাষায়, ‘তুমি আমার গুরু, তোমাকেই যদি ভক্তি করতে না পারি তবে কি করব?’ বাহাসের কিছুদিন পর মওলানা সাহেব মারা গেলে কোকিল শাহের সাথে আলাপ হয়। তারপর একসময় কোকিল শাহের কাছেই দীক্ষা নেন তিনি।”

দুর্লভ গুরুকে আলাদা বস্তু মনে করেন। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হলো : ‘আমার নালিশটা তো আমি উকিলের মাধ্যমেই দেই। গুরুই তো উকিল হয়া আমার নালিশ জানাবে। গুরুচরণ পেলেই রাসুলের চরণ পাওয়া যাবে।’ দুর্লভ শাহ কথা শেষ করেন না বরং দম নিয়ে আবার অগোছালোভাবে বলতে থাকেন : ‘এই যে দুইটা নাকে দুইটা হাওয়া বারাচ্ছে, সবসময় আল্লাহ ইল্লাল্লাহ হচ্ছে, এর উপর কেউ নজর দেয়নি। এ নিঃশ্বাস ধরে রাখতে হবে। কাম জাগায়ে রাখলেই জাগে; না-জাগালেই জাগে না। মনের সাথে লড়াই করতে হবে। সামান্য একটা চাতক পাখি এত দাবি করতাছে, দিদার করতাছে; ম্যাঘের জল ছাড়া কিচ্ছু খায় না, আর আমি কী মানুষ হলাম বাপ! দিদার করতে পারলাম না! শরীরের ভিতরে শক্তি ধরে রাখতে হবে। এটাই সাধনা। শক্তি বাড়াইয়া গেলে তো জ্ঞান বাড়াইয়া যায়। জ্ঞান বাড়লে কামের ঘরে অটোমেটিক তালা পড়ে যাবে। সবই জ্ঞানীকথা লালন দিয়ে গেছে। রসুলের কথা পাকা রইছে, ফাতেমার কথা পাকা রইছে। আমার ভিতরে যে খোদা আছে সেই খোদা দিয়ে গুরুর ভিতরের খোদাকে ধরতে হবে, তবেই তো পাওয়া যাবে অপার খোদাকে। সবার কি হবে তাতে আমার কি, আমার চিন্তা আমাকে করে আপন ঘরের খুঁটি ঠিক রাখতে হবে। ভার নিয়া তুমি কি করছ তাই আল্লায় দেখবে। আল্লাহর কাছে গিয়া তো বলতে পারব তোমার নিয়ামত খিয়ানত করিনি। …”

এ তো গেল আজাদুর রহমানের বয়ান। প্রায় একই ধরনের কথা ওইদিন দুর্লভ শাহ আমাকেও শুনিয়েছিলেন। তাই কোনও ধরনের পরিবর্তন না করে হুবহু জনাব আজাদুরের লেখার অংশটুকু তুলে ধরলাম। তিনি আমাকে ওইদিন আরও বলেছিলেন : ‘রসুল মরেনি, তিনি জিন্দা। এমনিতে দেখা গেছে তিনি মরে গেছেন। আসলে তা না। যারা সঠিকভাবে ডাকতাছে, তারা পাইতাছে। আমি তাঁকে জিন্দা বানাতে পারি না, সেটা আমার নিজের দোষ। আমরা নষ্ট হয়ে গেলাম। কাজ না-করলে কিছুই হবে না। খাটতে হবে, আল্লার জন্য খাটা। অর্থাৎ নিজের জন্য খাটা।’

কথা বলতে বলতেই একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দুর্লভ শাহ। তিনি বলেন : ‘সাঁইজির এখানে এসে অনেকে মদ-গাঁজা-ভাং খায়। এগুলো খাইতে তো সাঁইজি বলে নাই। শুরুর দিকে আমি গাঁজা খাইতাম। কিন্তু আমার গুরু একদিন তা খেতে মানা করে দিলেন, আমার ভুল ভাঙল, ওইদিনই গাঁজা খাওয়া ছেড়ে দিলাম। ওইগুলা বিষ বাবা। যারা বলে ওইগুলা খাইয়া সাধনা হয়, তা মিথ্যে রে বাবা।’ এ পর্যায়ে তিনি মিনিট দুয়েকের জন্য থেমে আবারও গান ধরলেন :

মন তোর বাকির কাগজ গেল হুজুরে
কখন জানি আসবে শমন
সাধের অন্তষপুরে।।

যখন ভিটেয় হও বসতি
দিয়েছিলে খোশ কবলতি
হরদমে নাম রাখব স্থিতি
এখন ভুলেছ তারে।।

আইনমাফিক নিরিখ দেনা
তাতে কেন ইতরপনা
যাবে রে মন যাবে জানা
জানা যাবে আখেরে।।

সুখ পেলে হও সুখভোলা
দুখ পেলে হও দুখউতলা
লালন কয় সাধনের খেলা
কিসে জুত ধরে।।

গান শেষে দুর্লভ শাহ পুনরায় কথা বলতে শুরু করেন। এবার আমি বাধা দিই। তাঁকে বললাম, ‘অসুস্থ শরীরে অনেকক্ষণ ধরে আপনি একনাগাড়ে কথা বলছেন। আজ আর না। পরে আবার আপনার সঙ্গে কথা হবে।’ ইচ্ছে ছিল তাঁকে প্রশ্ন করি — আপনার দিন চলে কীভাবে? তবে এ প্রশ্ন আর করলাম না। ঘরদোর-পরিবেশ-পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে খেয়ে-না-খেয়ে কোনোমতে হয়তো সংসার চলছে। তাই প্রশ্ন করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইলাম না তাঁকে। বিদায় নিয়ে ফিরতি পথে রওয়ানা দিই। তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে পথে উঠতেই দেখি গাছের ফাঁক দিয়ে পশ্চিমের লাল সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত হচ্ছে। আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থের ‘জীবন’ কবিতার কিছু পঙক্তি। পথ চলতে চলতে মনে মনে আওড়ালাম :

মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো!
সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা!
সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো
যে পেয়েছে, — সকল মানুষ আর দেবতার কথা
যে জেনেছে, — আর এক ক্ষুধা তবু — এক বিহ্বলতা
তাহারো জানিতে হয়! এইমতো অন্ধকারে এসে! —
জেগে-জেগে যা জেনেছ, — জেনেছ তা — জেগে জেনেছ তা, —
নতুন জানিবে কিছু হয়তো-বা ঘুমের চোখে সে!
সব ভালোবাসা যার বোঝা হলো, — দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী হিরণ মিত্র

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you