মছরু পাগলার গান || সুমনকুমার দাশ

মছরু পাগলার গান || সুমনকুমার দাশ

মছরু পাগলাকে নিয়ে কোথাও লেখালেখি হয়েছে, এমনটা চোখে পড়েনি। এ দীনতা ও সীমাবদ্ধতা আমাদের সবার উপরে বর্তায়। কোনও উরসে কিংবা ঘরোয়া বৈঠকে অথবা সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিক গানের আসরে তাঁর কয়েকটি গান ঘুরেফিরে শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। তবে তাঁর ভাব ও রসপ্রধান গানের যে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন ছিল, সেটা অন্য আরও গীতিকারের মতো তাঁর ভাগ্যেও জোটেনি। অথচ মছরুর গানের অনন্যতা ও ঐশ্বর্য বাংলাগানের বিবর্তনের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

মছরু পাগলা নানা আঙ্গিকের গান রচনা করেছেন। যেমনটা রচনা করেছিলেন তাঁরই পূর্বসূরি শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহরা। মছরু সিলেট-নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউল-গীতিকারদের পরম্পরা অনুযায়ী সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লা ও নবি-বন্দনা, মুর্শিদি, শাহজালাল-শাহপরান বন্দনা, মনঃশিক্ষা, পারঘাটাতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, বিচ্ছেদ ও গণসংগীত পর্যায়ের গান রচনা করেছেন। তবে তিনি বেশকিছু গোষ্ঠ পর্যায়েরও গান রচনা করেছিলেন, যেটি কুষ্টিয়া-নদীয়া-বীরভূমের বাউল মতবাদের ঐতিহ্যের বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়।

মছরুর সমগ্র সৃষ্টিশীল সত্তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পূর্বসূরি/সমসাময়িকদের রচনার সঙ্গে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাঁর রচনায় তেমন কোনও বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ে না, তবে এটা তর্কাতীতভাবে বলাই যায় যে, তাঁর গানের গাঁথুনিতে ভিন্ন একটা মায়াবী দ্যোতনা ও ছন্দময় তাল রয়েছে, যেটি শ্রোতা/পাঠককে আবিষ্ট করতে যথেষ্ট।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অন্য গীতিকারদের মতোই মছরু গান রচনা করলেও তাঁর মধ্যে আলাদা একটা মৌলিক রচনাশৈলী ও বৈচিত্র্য অবশ্য ছিল। এ অঞ্চলের যে কয়েকজন গীতিকার প্রয়াণের পরও প্রবলভাবে ক্রমশ শ্রোতা/পাঠকদের কাছে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন, তাঁদের মধ্যে মছরু নিঃসন্দেহে সামনের কাতারেই থাকবেন। মছরুর গানের অনুপম শব্দবিন্যাস ও দ্যুতিময় সুর তাঁকে জনাদরধন্য গীতিকারে পরিণত করবে — এটা নিঃসংশয়চিত্তে বলা যায়।

দুই
মছরু পাগলা তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই মুর্শিদ-বন্দনা থেকে শুরু করে গণসংগীত পর্যায়ের গান পর্যন্ত রচনা করেছেন। তাঁর গানের সাদামাটা উচ্চারণ রসজ্ঞ পাঠকদের মনে নির্মল অনুভূতির সঞ্চার করবে। একেবারেই সহজ ভাষায় আত্মোপলব্ধি তাঁর গানে উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি গানের কয়েকটি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে,

মরণ তুমি দূরা থাকো
আরও থোড়া দিন
পারো তো মোরে আর কিছু আয়ু
দিতে পারো নি ঋণ।।

এর পরেই মছরু জানিয়েছেন তাঁর বেঁচে থাকার মূল কারণটি। কারণ, ‘এখনও ভবে কিছু কাজ রয়েছে’ তাঁর। তবে এই ভবজগতের বাসিন্দা হয়ে কেবল বৃথা সময় অপচয় করা যে যাবে না — সেটাও তাঁর গানে সাবধানবাণী হিসেবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

মছরু পাগলা অপরাপর সাধকদের কাছ থেকে পরম্পরা অনুযায়ী তত্ত্ব নিয়েছেন ঠিকই, তবে সেসব প্রকাশ করেছেন নিজের মতো করে। তাঁর চিন্তাশক্তি ও মৌলিকত্ব তাই সহজেই যে-কারও চোখে পড়বে। অন্য সাধকদের মতো মছরুও তাঁর মতো করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এভাবেই —‘জীবের জনম দিলে যদি, কেন দিলে মরণব্যাধি’। তবে এ প্রশ্ন উত্থাপনের পরও তিনি মৃত্যুকে প্রাকৃতিক বিধান মেনেই জীবনের গভীরতম সত্য উচ্চারণ করেছেন —

এ দুনিয়া অতিথশালায়
রহিতে না পারব চিরদিন
যত্নে পোষা হাওয়ার পাখি
হাওয়াতে হবে বিলীন

মছরু যেহেতু জানেন — অতিথশালারূপী এই দুনিয়ায় বেশিদিন থাকতে পারবেন না, তাই মায়ামোহে আচ্ছন্ন না হয়ে সাবধানে পথ চলার বাসনা প্রকাশ করেছেন।

মছরু সাবধানে পথ চলার ক্ষেত্রে মুর্শিদবাণীকে চিরসত্য মেনে অগ্রসর হতে চান। তাই তো তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ —‘মুর্শিদবাণী করে লক্ষ্য / তবে রে মন হবে সূক্ষ্ম / শেষে পাবে বিশ্বাসের ফল’। তাঁর বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় আর সবল, যে-কারণে মছরু মুর্শিদের পায়ে তাঁর তরীরূপী দেহ সঁপে দিয়েছেন। মুর্শিদ-নির্দেশিত বাণী মছরুর পথ চলার অনুষঙ্গ। আর তাই হৃদয়ের ভেতরের সত্তাকে উপলব্ধি করার পেছনেই তিনি চিরনিবিষ্ট থেকেছেন। লালন সাঁইয়ের ‘অচিন পাখির সন্ধান’ মছরুর কাছে হয়ে যায় ‘টুনটুনি পাখির অনুসন্ধান’। মছরু লালনের পরম্পরায়ই যেন মনে করিয়ে দেন এ পঙক্তিতে —

কান পেতে শোনো ওরে হৃদয়ও মন্দিরে
টুনটুনি পাখি করে গুনগুনি গান।

মছরু পাগলার সৃষ্টির বিরাট একটা অংশ জুড়ে রয়েছে দেহতত্ত্ব ও মনঃশিক্ষা পর্যায়ের গান। মনের ভেতরের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব আর সংকটের বিষয়টি টের পাওয়া যায় তাঁর গানের পরতে পরতে। মছরু যখন উচ্চারণ করেন —

চিনলে না রে নিজকে নিজে
মন দিলে না আপন কাজে
আর কি হবে বেলা গেলে
সুসময় তোর যাবে বৃথা, পাবে ব্যথা
ভাসবে শুধু নয়ন জলে।

সহজ ভাষায় কী সরেস সত্য উচ্চারণই-না করলেন তিনি! তবে আপনকাজে সাধনায় ব্রতী থাকার জন্য মছরু কুপথে না যাওয়ার উপদেশবাণী দেন। তা না হলে ‘হারা হবে লাভে মূলে’ বলেও সতর্কতা জানাতে তিনি ভোলেন না।

‘মোহে মজে আসল কাজে ফাঁকি দিয়েছি’ বলে যে মছরু পাগলা চাপা আর্তনাদ অনুভব করেন মনের ভেতরে, সেই মছরুই ভেতরে ভেতরে অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হন এই ভেবে যে, ‘দূরের মানুষ কাছে থইয়া / উদাস প্রাণে ঘুরঘুরাইয়া / পরারে খুঁজিতে যাইয়া / নিজেরে হারাইয়াছি’। নিজেকে অনুসন্ধানের সেই বাউলরীতির চিরায়ত দর্শনই যেন মছরু বলে চলেন অবলীলায়। মছরু তাঁর গানে যেমন আত্মানুসন্ধানের উপায় বাতলে দিয়েছেন, তেমনই মানুষ-ভজনারও জয়গান গেয়েছেন। সেই মানুষ-ভজনা করতে গিয়েই তিনি অসংখ্য গণসংগীত রচনা করেছেন। লিখেছেন বেশকিছু আঞ্চলিক পর্যায়ের গানও।

এসব গানের পাশাপাশি মছরু রচিত বিচ্ছেদগানও বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। মানুষের চিরন্তন প্রেম-ভালোবাসাকে কখনও কখনও তিনি রাধা-কৃষ্ণ চরিত্রের আশ্রয়ে উপস্থাপন করেছেন, আবার কখনও-বা নিজেই রাধা সেজে ওই নারীর মর্মবেদনা ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করেছেন। মছরু কৃষ্ণবিরহে সেই বিরহিণী রাধার মনোকষ্ট বুঝতে সক্ষম বলেই সুস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে পারেন —

আসমান-জমিন সাক্ষী রে নাগর
সাক্ষী দশজনায়
দিমু দিমু বরণমালা
তোমারই গলায়।

তিন
সিলেট অঞ্চলের পূর্বসূরি গীতিকারদের থেকে একেবারেই পৃথক নয় মছরু পাগলার গান। তাঁর গানেও সেই পরম্পরা/ধারা বজায় রয়েছে। মছরুর গানের দর্শন ও অর্ন্তগত গূঢ়তত্ত্ব রসিক ভাবুক/শ্রোতা/পাঠকের মনে নতুন ভাবনা ও চিন্তার খোরাক জোগাবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যথাযথ প্রচারের অভাবে ধূসর ও বিবর্ণ হতে থাকা মছরুর গান নিশ্চয়ই একসময় কাল ও সময়কে ধারণ করে বাংলা লোকগানের আলোকিত ভুবনকেই ভাবী প্রজন্মের কাছে সমুজ্জ্বল করবে, এমন প্রত্যাশা মোটেই অমূলক হবে না।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you