জীবন ও যাত্রার অভিলাষ || নিখিল দেব

জীবন ও যাত্রার অভিলাষ || নিখিল দেব

গত এক দশক বাচ্চু-জেমসদের গান খুব-একটা শুনছি না। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া তেমন কিছুই যেন মন দিয়ে শুনতে পারছি না। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শোনামাত্র আমার বেড়ে-ওঠার সময় ও সিঁড়ি ‘স্মৃতি অম্লান’ হয়ে ধরা দিলো। স্মৃতি, কেবল অতীতের নয়, ভবিষ্যতে যেয়ে বর্তমান ও পেছন দেখার মুহূর্তও যেন দেখলাম। বুঝলাম, ওটা কালের ধ্বনি, — যা থেকে কারোরই মুক্তি নেই। দুয়েক দিন সময় নিলাম কোনোকিছু লেখার আগে। দেখতে চাইলাম ভাবনাটা সাময়িক কি না। হতে পারে। কালের পরিধি বিবেচনায়। কিন্তু এক জীবনের আদলে দেখলে বাচ্চু-জেমসদের প্রভাব স্থায়ী। হয়তো চিরস্থায়ী।

ভূমিকা
তখন আমার ছোট্টবেলা। বয়স ১২-১৩? বাড়িতে আসা এক যুবক মামার বদৌলতে প্রথম শুনেছি “কষ্ট পেতে ভালোবাসি”। বাচ্চুর প্রথম গানের অ্যালবাম? আমার যেখানটায় জন্ম ও বেড়ে-ওঠা, — ওখানে ব্যান্ডের সংস্কৃতি তখনও পৌঁছেনি। পৌঁছার কথাও ছিল না। ব্যান্ডের গান নগরের বিষয়। যে-কোনো নগরে এখনও নিজেরে অবাঞ্চিত মনে হয়। ব্যান্ডের গানে আমি খুব যে পরে মগ্ন ছিলাম তাও না। কিন্তু কালের মাধ্যম এড়ানো যায়? আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের, — যা বেড়ে উঠেছে ’৮০-’৯০ দশকে, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক মেকআপের পেছনে বাচ্চু-জেমসের গান অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে। সবটুকু লিখে প্রকাশ করার স্পেস এখন নিতে পারছি না। ইচ্ছেও করছে না। তবু একটু ঘুরে আসছি।

বিবরণ
প্রতিটি প্রজন্মের ভাব প্রকাশের জন্য মাধ্যম প্রয়োজন হয়। আশির দশকের বাংলাদেশ, যে একদম নবীন, ও রাজনৈতিক গোলযোগে টলছে যার ভবিষ্যৎ, খুব-একটা উজ্জ্বল কিছু নয়। হয়ে-ওঠা তরুণদের ভাবপ্রকাশের মাধ্যম তাই খুব সীমিত। রাহমানের কবিতা খুব জাতীয়তাবাদী। মহাদেব সাহা লিখছেন প্রেমের কবিতা। অনেকের মন ভরছে না। কে, কী, কারা ভাষা দিবে আমাদের লেখায় ও বলায়? প্রেমের বয়সে গান-কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ সহজাত। মর্যাদারও পরিচয়। ভালো-খারাপের হিসেব আলাদা করে করা যাবে। আমাদের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। জেমস্-বাচ্চুর গান আমাদের বলা ও লেখায় বিরাজ করতে লাগল। আমাদের প্রেম ভাষা পেলো। আমাদের আড্ডা প্রাণবন্ত হলো। সুন্দরীদের (বিপরীতও সত্য) দেখে ভালোবাসার কষ্টও যে ভালো লাগার সেটা ভাবনা ও প্রকাশে তুমুল নাচ শুরু করে দিলো। আমি, আমরা, আমাদের প্রজন্ম সেই নৃত্যেরই অভিব্যক্তি। ক্ষীণ হলেও এটা সত্যি।

কীসের অভিলাষ?
বিষয়ে মোড় নিচ্ছি। বাচ্চুর গান মৃত্যুর দিকে মুখ করা। আমি সংগীতের, বা বাচ্চুর গানের, বিশেষজ্ঞ নই। যাঁরা সংগীত নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাঁরা এ বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন। আমার এ-লেখা কেবল ভাব প্রকাশের। তাই কোনো অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। বাচ্চুর গানের লিরিক ও নির্দেশনার দিকে নজর দিলে দেখা যায় ওগুলোর ভিতরে মর্বিড ভাবনা লুকিয়ে আছে। “হাসতে দেখো”, “সুখের পৃথিবী”, “উড়াল দিবো আকাশে”, “তিন পুরুষ” — এসব গান বাচ্চুর ভেতরকার সবকিছু-বিনাশে-যাবে — মৃত্যুই-ধ্রুব-সত্য — এই দর্শনকেই প্রকাশ করে। হয়তো আমরা কাউকেই চেনার মতো করে চিনি না; হয়তো সেটা সম্ভবও নয়। মৃত্যুর দরোজা তাই সবসময় আমাদের জীবনে অপেক্ষায় আছে। ফ্রয়েড, বা আরও বেবাকেই, যেটাকে ডেথড্রাইভ বলেছেন।

শেষ
লিজেন্ডরাও সময়ের কাছে পরাজিত। আমরা সবাই। আমরা মারা যাই। সবাই বেঁচে থাকে। সবাই মারা যায়। আমরা সবাই কিছু-না-কিছুর সাক্ষী হয়ে বাঁচি। বাচ্চু-জেমসদের গান কালের বিবেচনায় হয়তো কিছুই নয়। কোনোকিছুই কিছু নয়। কিন্তু, আমাদের স্মৃতি ও আলিঙ্গন ব্যতিরেকে কালও কিছু নয়। গত এক দশক ওসব গান খুব-একটা শুনছি না। তবু, এসব গানের সুর, লিরিক, ও বাজনা স্মৃতিতে অমলিন। কেন? নবীন বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে বাচ্চুরা একটা সময়ের প্রতিনিধি। আমি, আমরা তার প্রমাণ।

[ঋণ : জাহেদ আহমদ। জাহেদভাই নাড়া না-দিলে এই লেখা তৈরি হতো না। হাতেও ব্যথা, লিখতে পারি না। লিখেছি বলে নয়, লিখতে পেরে ভালো লাগছে তাই কৃতজ্ঞতা রইল। ঋণ বাড়ে, জীবন ছোট হয়।]

রচনাকাল : অক্টোবর ১০, ২০১৮

… …

নিখিল দেব
Latest posts by নিখিল দেব (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you