রবি ঠাকুরের দল ছড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু এই দেশভক্তিতে এক। দেশের অতীত এবং ভবিষ্যতের প্রতি যার নাড়ির টান সে-মানুষ এই দলের লোক। মজার কথাটা এই হিন্দু-গোরা জাত মানত কিন্তু সে সম্প্রদায় মানত না। মুসলমান ও হিন্দু দুইয়ে মিলে যে ভারতবর্ষ সেই দেশকে গোরা কোনোদিন ভোলেনি। এই মজার কথাটা যদি রবি ঠাকুরের দলে না ছড়ায়, কোথায় ছড়াবে?
হিন্দু-গোরার বুকটা দরাজ ছিল বলেই বোধহয় পরেশবাবুর উদার বিশ্বকে রচনার শেষে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হলো। গোরার দেশভক্তি এবং পরেশবাবুর মানুষের ধর্ম এই দুই বস্তু নিকট প্রতিবেশী, একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়া চলে। এই যাওয়াটুকুই রবি ঠাকুরের দলটির সাধনা। সংযত সাহস, উজানের শক্তি, অতিরিক্তের ইচ্ছা, দেশভক্তি, সবই এসে শেষ পর্যন্ত এই মানুষের ধর্মে মিলে যায়। নিরীহ মানুষের সাহসটা কিন্তু থাকে। ললিতা ও বিনয় বিভিন্ন সম্প্রদায় ত্যাগ না করেই মিলিত হয়। সেই মিলন ঘটেছিল পরেশবাবুর আশ্রয়ে। সে-সম্পর্কে সুচরিতার বক্তব্য স্মরণ করবেন : “পরেশবাবু যখন চলিয়া গেলেন তখন সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে জানিত পরেশ ললিতাকে মনে মনে কত ভালোবাসেন। সেই ললিতা বাঁধা পথ ছাড়িয়া দিয়া এত বড় একটা অনির্দেশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে, ইহাতে তাঁহার মন যে কত উদ্বিগ্ন তাহা তাহার বুঝিতে বাকি ছিল না। তৎসত্ত্বেও এই বয়সে তিনি এমন একটা বিপ্লবে সহায়তা করিতে চলিয়াছেন, অথচ ইহার মধ্যে বিক্ষোভ কতই অল্প। নিজের জোর তিনি কোথাও কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তাঁহার মধ্যে কত বড় একটা জোর অনায়াসেই আত্মগোপন করিয়া আছে।” এই সময় সুচরিতাকে গোরা বোধকরি ঘুষি পাকিয়েই বেশ অভিভূত করে রেখেছিল। তার কাছেও কিন্তু শান্ত মানুষের এই জোর বড় মনে হলো।
শেষকালে প্রথম প্রশ্নে ফিরে আসি। মানুষ নিরীহ হলেই দুর্বল হয় না। সাধারণ জীবনেও একটা অসাধারণ জোর লুকিয়ে থাকতে পারে। এই জোরটা আসে কোথা থেকে? রবি ঠাকুরের দলটির এটাই মূল জিজ্ঞাসা। রবীন্দ্রনাথকে যে সামান্যও চিনেছে সে জানে যে সবকিছুর পিছনে এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে একটা গভীর ঈশ্বর-অনুভূতি এই মনে কাজ করেছে। এই ঈশ্বর ভারতবর্ষের অনেক বড় মাপের মানুষের মনেই এসেছে। এঁদের জোরটা শেষ পর্যন্ত এই ঈশ্বরের জোর। ঈশ্বরবিহীন আগুন এই দেশে বড়-একটা দেখি না। তবু বলব এই ঈশ্বরের চেহারা লোক থেকে লোকে পাল্টেছে, আবার একই লোকের মনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় পাল্টে গেছে। শুনেছি, শেষ জীবনে গান্ধী বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর মুখোমুখি হলে তাঁর ঈশ্বর তাঁর পাশে দাঁড়াবেন। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ মানুষ কখনও ঘাতকের মোকাবিলা করতে পারে না। এই বিশ্বাসেই গান্ধী প্রাণ দিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বোধকরি সকলের জীবনেই থাকতে পারেন। এটাই বোধহয় কবির সব থেকে বড় শক্তি। আধুনিক সভ্যতার ভালোটুকু মেনে নিয়ে, বিজ্ঞানকে পথের সাথী করে, কবির এই ঈশ্বরবিশ্বাস নিরীশ্বর মনকেও টানে। জীবনদেবতাকে মানতে কি কঠিন সত্যকে গ্রহণ করতে নিরীশ্বর মানুষেরও অসুবিধা ঘটে না। বিশ্বাসের জোরটুকু নেওয়া শক্ত হতে পারে। বিশ্বাস সকলের জন্যই সত্য।
বড় মাপের মানুষের বড় মাপের বিশ্বাস। জোরটাও তদনুপাতে ঘটে থাকে। এইখানে রবি ঠাকুর ও রবি ঠাকুরের দল কিন্তু পৃথক। বিশ্বাস ছড়ানো থাকে; বিশ্বাসের জোর প্রতিটি মানুষের নিজস্ব। সত্যদ্রষ্টারা বেঁচে থাকেন। জাতির আচরণে না বাঁচেন, জাতির বিশ্বাসে বাঁচেন। গান্ধীকে কি রবীন্দ্রনাথকে জীবনে না নিই, বিপদে আপদে এদের মনে পড়ে। রবি ঠাকুরের দলটি লোকের মনে ছড়িয়ে আছে। কোনোদিনই এই লোকগুলি দপ্তর খুলে জাঁকিয়ে বসবে না। সেটা বাঁচোয়া। কোনোদিনই এই দলটি বিশেষ কিছু করবে এমন কথাও মনে হয় না। সেটা হতাশা। কিন্তু এই মানুষগুলি রবি ঠাকুরকে চেনে। এদের ভালোমন্দের জ্ঞানটুকু কবি তৈরি করে দিয়েছেন। কোথাও যেন মানুষের মনে একটা যোগ্য প্রত্যুত্তর তৈরি হচ্ছে। এটা বিশ্বাস।
সমাপ্ত
অশীন দাশগুপ্ত প্রবন্ধ সমগ্র (কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০১ দ্বিতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০৮) থেকে রচনাটা আহৃত। – গানপার
… …
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS