জলের ঘাটেই কেন শ্যাম বসে থাকবে? আর সেই ঘাটের পারেই কেন থাকবে কদমগাছ? যদি কদমগাছ থাকবেই, তবে বাদল দিনের প্রথম কদমফুলের সুবাস ছাপিয়ে কেনই-বা শ্যামের বাঁশির সুললিত সুর মুগ্ধতার আবেশ ছড়াবে? ‘অষ্টআঙুলা’ বাঁশির এমনই মায়ার টান, যে-টানে ‘ভরা যৌবন’ বিলিয়ে দিতেও উন্মুখ রাধা! অথচ বাঁশির সুরে ‘যৌবনজ্বালা’ ধরিয়ে ‘কালোমানিক’ কৃষ্ণ উধাও! ‘অবলা’ রাধা আর কোথায় তাঁরে খুঁজে পায়? মূলত, এই হলো রাধারমণের ‘জলভরা’-পর্বের অধিকাংশ গানের বিষয়বস্তু।
হিন্দুধর্মীয় বিয়ে উপলক্ষে হাওরাঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা যে ধামাইলগান পরিবেশন করে থাকে, সেখানে জলভরা গান অত্যাবশ্যক (যদিও মুসলিম বিয়েতে কিছু কিছু বাড়িতে গীত হয়ে থাকে)। তো, সেই জলভরা-পর্বের রাধা-কৃষ্ণের ভালোবাসা-বিচ্ছেদ একসূত্রে গ্রথিত। রাধারমণের অন্য অনেক গানের মতোই এ পর্যায়ের গানগুলোতেও নারীর আক্ষেপ এবং বিরহের প্রসঙ্গই উত্থাপিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বিরহকাতর নারীর মনোবেদনা বর্ণনায় রাধারমণ নিপুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তনুমন যাঁর ভালো লাগার আবেশে আবিষ্ট/মোহাচ্ছন্ন থাকে সারাক্ষণ, সেই কৃষ্ণকে পরম মমতায় আগলে রাখতে চেয়েছেন রাধা, রাধারমণ সে-প্রসঙ্গেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন — ‘এগো পাইতাম যদি শ্যাম রসময় রাখতাম হৃদয় পিঞ্জিরায়’। সেই ‘শ্যাম রসময়’ হলো কৃষ্ণ, ‘বিধি পাখা’ দিলে যাঁর জন্য রাধা উড়ে তাঁর কাছে চলে যেতেও প্রস্তুত!
দুই
‘জলভরা’-পর্বে ‘বাঁশি’ শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাধা একবার জল আনার জন্য যমুনা/গঙ্গা/কালিন্দি/সুরধুনী নদীর তীরে গিয়েছিলেন, সেখানে কৃষ্ণের (কৃষ্ণ অবশ্য চিকন কালা, নিলাজ কালা, কালশশী, শ্রীকান্ত, বনবিহারি, কানু, মনোচোরা — অনেক অভিধায় পরিচিত) সঙ্গে তাঁর দেখা। এরপর থেকেই মূলত কৃষ্ণ সময়-অসময়ে বাঁশি বাজিয়ে রাধার মন হরণ করার প্রচেষ্টা চালান। শুরুর দিকে রাধা বিষয়টিকে গুরুত্ব না-দিলেও পরে বুঝতে পারেন, এটি ‘ডাকাইতা বাঁশির সুর’। এ সুরের এমনই মায়াবী আকর্ষণ, যা মনপ্রাণ সব হরণ করে নেয়!
কৃষ্ণের বাঁশিও রয়েছে আবার নানা জাতের, নানা ধরনের। এসব বাঁশির আবার একেকটির একেক সুর। পুরাণ অনুযায়ী, ‘বৃহস্পতির যজ্ঞস্থলে’ বাঁশির জন্ম। রাধারমণ কৃষ্ণের বাঁশির সুরের বর্ণনা দিতে গিয়েই উল্লেখ করেছেন, বাঁশির প্রথম রন্ধ্রের টানে যমুনার জল উজানে যায়, দ্বিতীয় রন্ধ্রের টানে সতি নারী পতি ছেড়ে যায়, তৃতীয় রন্ধ্রের টানে যশোমতী পর্যন্ত গতি ভুলে যান এবং চতুর্থ রন্ধ্রের টানে মুনির ধ্যান পর্যন্ত ভেঙে যায়।
যে বাঁশির সুরে মুনির ধ্যান কিংবা যোগী-ঋষির যোগ পর্যন্ত ভঙ্গ হয়ে পড়ে, তাতে তো রাধার মতো একজন মানুষের অটল থাকার কথাই নয়। আর হয়েছেও তাই। সারাক্ষণ যেহেতু ‘লিলুয়া বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে’, তাই রাধাও একসময় কৃষ্ণপ্রেমে মশগুল হয়ে পড়েন। বাঁশির সুরের জাদুতে মুগ্ধ রাধার মুখ দিয়ে তাই তো রাধারমণ বলিয়ে নেন — ‘শুষ্ক তনু শূন্য অন্তর, এর মাঝে কি মধুর স্বর’। প্রেমে মত্ত রাধা আপন মনেই উত্তর খোঁজেন, ‘কেমনে জানিয়াছ বাঁশি আমার নামটি রাধা’?
কৃষ্ণ কি কেবল বাঁশির সুরে রাধার নাম উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত দেবার পাত্র? বরং বাঁশির নানান সুরে রাধাকে উতলা করার দিকেই মনোযোগী বেশি। রাধা যখন এটি বুঝতে পারেন, তখন তাঁর আর ফেরার পথ নেই। রাধা ফিরতে চাইলেও ‘প্রেমবাণ’ তাঁকে বিদ্ধ করে ফেলে, তাই তো রাধার স্বীকারোক্তি — ‘যতই টানি ততই বিন্ধে কাঁটা, খসাইলে খসে না রে’। প্রেমজ্বালায় বিদীর্ণ রাধার অন্তর থেকে তাই আক্ষেপ ঝরে, ‘জগতে কলঙ্কী অইলাম বন্ধের প্রেমিক অইয়া’।
যতই দিন যায় ততই বাঁশির সুরে রাধা ‘উন্মাদিনী’ হয়ে পড়েন। শাশুড়ি-ননদি ঘরে রেখে কৃষ্ণের বাঁশির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাইরে বেরোতে না-পেরে রাধা প্রতিনিয়ত ছটফট করেন। আবার যখন জল আনবার ছলে ঘরের বাইরে বেরোন, তখন অনেক সময় আবার কৃষ্ণের দেখাও মেলে না। এতে রাধার মনে যে খেদ জন্ম নেয়, মনের ভেতরে বিচ্ছেদের আগুন যেভাবে দিবানিশি জ্বলতে থাকে, সেটি শত চেষ্টা করেও তিনি নেভাতে পারেন না। রাধার মনের ওপর এই যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, এটি যেন ‘শিংরা ফলের কাঁটার মতো বিন্দিল পরানে’।
কৃষ্ণের প্রতি বিরহ-দগ্ধ রাধার অনুযোগেরও শেষ নেই। একে তো কৃষ্ণের কারণে শাশুড়ি-ননদি পর্যন্ত রাধার কাছে বৈরী হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যে প্রতিনিয়ত বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে উতলা করে তুললেও সহসা কৃষ্ণের দেখা মেলে না। তাই তো রাধার খেদোক্তি — ‘পিরিত কইরে ছাইড়্যা গেল, অন্তর আমার ঝুরে রে’। একই সঙ্গে কুলমান হারিয়ে সমাজে কলঙ্কী হওয়ার জন্যও রাধা কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন। যদিও রাধা সেই কলঙ্কিনী হওয়ার জন্য সরাসরি খেদ না-করে আক্ষেপ করছেন, কৃষ্ণকে কাছে পেলে কলঙ্কিনী হতেও তাঁর ক্ষতি নেই। কুলমান হারিয়ে কলঙ্ক লাগিয়েও বন্ধুকে তিনি ভুলতে চান না।
কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মনপ্রাণ অবশ হয়ে আসে যে রাধার, সেই রাধা বিনা সুতায় মালা গেঁথে বন্ধুর গলায় পরাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। প্রায়ই দেখা যায়, রাধা যখন রান্না করতে বসেন, তখনই কৃষ্ণের বাঁশির ধ্বনি শোনা যায়। অনেক সময় রাধা বেরোতে পারেন, আবার অনেক সময় পারেন না। যখন বেরোতে পারেন না তখন রান্নাঘরে বসে কেবল নীরবে চোখের পানি ফেলেন। পাছে শাশুড়ি-ননদি তাঁর কান্নার আঁচ টের পেয়ে যেতে পারে, এজন্য তিনি চুলায় শুকনো লাকড়ির বদলে ভেজা লাকড়ি দিয়ে ধোঁয়া উৎপন্ন করেন। এ-অংশটি রাধার মুখ দিয়ে রাধারমণ এভাবেই বর্ণনা দেন, ‘ভিজা লাকড়ি চুলায় দিয়া ধুমার ছলে কান্দি’।
তিন
‘জলভরা’-পর্বের গানগুলোর শারীরিক আদল তৈরি হয়েছে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিচ্ছেদকে উপজীব্য করে। কৃষ্ণের বাঁশির সুর আর নদীর ঘাটে সখিগণ সহ রাধার জল আহরণের বিস্তারিত বর্ণনাই এসব গানে পাওয়া যায়। এই জলভরা-পর্বেই রাধাকৃষ্ণের পরিচয়ের পর্বও স্থান পেয়েছে। তবে সেই মুহূর্ত বা ক্ষণটুকুকে রাধা ‘কুক্ষণ’ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। এরও অবশ্য যৌক্তিক কারণ রয়েছে। গানের পঙক্তিগুলো পাঠেই বোঝা যায়, এটি রাধার অভিমানসুলভ উচ্চারণ। কৃষ্ণের আকণ্ঠ সাক্ষাৎপ্রার্থী রাধা আক্ষেপ থেকেই এমন উচ্চারণ করেছেন। তবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমমহিমার এসব কীর্তিগাথা ছাপিয়েও ‘জলভরা’-পর্বের পরতে পরতে যেন এক নারীর বেদনা, হতাশা আর আক্ষেপের সুরই বারংবার ধ্বনিত হয়। শাশ্বত গ্রামীণ বাংলার নারীর এ-আক্ষেপের সুরই যেন ঘুরে রাধার কণ্ঠে — ‘নারীকুলে জন্ম কেন দিলায় রে দারুণ বিধি’?
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS