রাত বারোটার বেশি বাজতেছে। ‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা’ শুনতেছিলাম। রাধার বিরহ নিজের ভিতর যত টানতেছিলাম, বাইরে বিরতিহীন ঝরতে থাকা বৃষ্টির শব্দ উধাও হইতেছিল সকাতর। বিরহের ভাষা আমার মনমল্লারে। ভাবতেছিলাম, এইবার কোথায় যাবো আমি? সৃষ্টির শুরুতে? অ্যান্টিম্যাটারের শিরায় শিরায় ভাষাশূন্য শক্তির ওঙ্কারে? সেইখানে আমি কীভাবে ছিলাম? আমার সমস্ত আকুতি নিয়া?
আজ রাতে সুরমা নদীর ধারে কিনব্রিজের কাছে সত্যজিৎ রাজনের একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘প্রাগভবিষ্যের পদাবলি’ দেখতে গেছিলাম। বেশ কিছুদিন ধইরা অনলাইন প্রচারণা দেখতেছিলাম। আর মনে মনে দিনক্ষণ ঠিক করতেছিলাম গোপনে হানাবার। বৃষ্টিমাতমের এক মহিমান্বিত দিন আজ। অতএব ‘আজ হঠাৎ সন্ধ্যে / দেখা হবে তোমার সঙ্গে’ ঘটাবার মাহেন্দ্রক্ষণ।
সত্যজিৎ রাজনের চিত্রে দেখি এক ধরনের ক্ষুব্ধ-অস্থিরতা। দেবী দুর্গার কথা ভাবি। তার চোখ ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার। দেবী লক্ষ্মীর কথা ভাবি। মনে হয়, তার চোখ ইকোনোমিক্সের কুরুক্ষেত্র। দেবী সরস্বতীর চোখ যেন বিদ্যা-জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আবহমান গঙ্গা। দেবী কালীর চোখ আমার কাছে বিদ্রোহ আর বিপ্লবের, বরাবর। নারীবৈভবের এমন এক মহাপুরাণের মেঘপুঞ্জে সত্যজিৎ রাজনের আঁকা অসংখ্য চোখের তাক-করা কার্তুজে কেন নিজেরে এত অসহায় লাগে? ভ্যান গগের ওই বিনাশী চোখ নাকি শিবের তান্ডবউস্কানো-অনুকম্পাহীন চোখ—কোথাও কি সত্যজিতের এইসব চোখের দেখা পাইছিলাম কোনোদিন? সাথে সরীসৃপের ভয়াল লেজ বা লোলুপ-জিহ্বা সমস্ত অন্ধকার সাথে নিয়া নড়তে থাকে এক আদিম স্পৃহার প্রতিশোধে? নাকি প্রতিঘাতে?
একযুগের বেশি সময় ধইরা সত্যজিৎ রাজনের চিত্রকর্ম দেখতেছি। তাঁর সাথে যখনই দেখা হয়, বিনা দ্বিধায় তাঁর চিত্রকর্ম নিয়া আমার অস্বস্তির কথা বলে ফেলি। প্রতিটা রেখার টান যেন এক-একটা বিভীষিকা। আঘাতের না প্রত্যাঘাতের—আমি বুঝতে পারি না। রঙ, কাগজের ধরন, চিত্রকর্মের বিবিধ ফর্মের ব্যাপারে একেবারে ইতরজ্ঞান আমার। অবচেতনের যে ফ্রিকোয়েন্সি থাকে, আমার ধারণা আমি শুধু তার আঘাতে সাড়া দিতে পারি। সত্যজিতের চিত্রকর্ম এইভাবে আমার ভিতর হাজির হইতে থাকে। রঙের জাহাজে রঙহীন-ভাষার অস্বর নিনাদে।
জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্মে সমাজের এক অংশে ওই সময়ের আঁচড় দেখা যায়, যেইখানে জোটবদ্ধতার সার্বভৌম বাসনা কাতরভাবে নিষ্পেষিত, অবদমিত। জয়নুলের ছবিতে ব্যক্তি অনুপস্থিত। বরং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব নিয়া যেই আখড়ায় বাহাস হবার কথা, তার মুমূর্ষুতায় জয়নুলের রঙ ও ক্যানভাস অস্থির। এস.এম সুলতানেও ব্যক্তি নাই। এক কৌম সোসাইটির ভিতর সুলতানের ক্যানভাস তাঁর সময়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যাত্রারে হোঁচট দিতে চায়। সুলতানের স্বপ্ন বিবলিক্যাল না। পৌরাণিকও না। দ্বান্দ্বিকতার যুক্তি যেইখানে বিরাম নিতে চায় এক অদেখা ফড়িঙের গীতল মোহে, সুলতান তার ফসিল রাঙান। কিন্তু সত্যজিৎ রাজন জেন-ওয়াই জেনারেশন। এইটা ওই জেনারেশন—বড় হইতে হইতে যারে দেখতে হইছে মুক্তির নামে ব্যক্তির ব্যবচ্ছেদ। এই ব্যক্তির কি দেশ আছে? আছে কিন্তু সুরক্ষিত সীমানা?
সত্যজিতের ক্যানভাস ব্যক্তির রোমান্টিকতা থেইকা অনেক দূরে সইরা আসে। সত্যজিতের ক্যানভাস ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক কুরুক্ষেত্র যেন। এক-এক রেখা কৌরব-পান্ডবের হস্তিনাপুর হরণ। প্যাঁচানো, বিকট, নৃশংস, ফের অসহায় সব টান। মনে হয়, ব্যক্তির অনেক গভীরে থাকা অশ্রুত যত ভাষার আর্তনাদ। দ্বিধা ও সংকট।
হঠাৎ আবার ধরা পড়তে পারে এক মনোহরিণীর আবছা ইমেইজ। অরক্ষিত। সংশয়ে মুমূর্ষু। কুঠুরিতে আবদ্ধ। অপেক্ষায় । যেন এতটুক ওই জানালা ধইরা অনিচ্ছার আলো আছাড় খাইতেছে ব্যাকেটের গড়া অন্ধ-হ্যামের চোখে। সত্যজিতের ক্যানভাস পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্ব, ব্রহ্মনাদ, আদি-অন্ত, বিষ্ণু-শিবচক্র কিংবা বিবলিক্যাল ন্যারেটিভ—মোহের মতো রঙ ও রেখায় আইডিয়ার বৃষ্টিফোঁটা—ব্যক্তি নয়, যেন সবাই উন্মাদের মতো ওই ব্যক্তির ভিতর হারাইয়া যাওয়া আদি ধুনের খোঁজ করতেছে, নিরলে।
সেপ্টেম্বর ২০২৫
* লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ফটোগ্রাফি লেখকের সৌজন্যে পাওয়া।
সত্যজিৎ রাজন এক্সিবিশন প্রতিবেদন
হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
- হুমায়ূন, মধ্যবিত্তের ফ্যান্টাসি ও ডেড ফিলোসোফি || হাসান শাহরিয়ার - October 9, 2025
- বৃষ্টিতে ব্রহ্মনাদের খোঁজে প্রাগভবিষ্যের পদাবলিতে… || হাসান শাহরিয়ার - September 17, 2025
- মেসি : মহাকালের মায়া, নৈশব্দের রেফিউজ || হাসান শাহরিয়ার - September 6, 2025
COMMENTS