আরশিনগরের পড়শি || মুম রহমান

আরশিনগরের পড়শি || মুম রহমান

খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে যায় আর মনের মানুষ তো মনেই বাস করে। সেই অধরা মনের মানুষ ধরতে গেলেই বুঝি লালনের গান ছুঁতে হয়। তবে তার আগে লালনের গল্পটা, মানে লালন সাঁইয়ের জীবনটা, এক-নজরে দেখা যাক।

লালনের জাত-কুল-জন্ম-মান নিয়ে গবেষণার অন্ত নাই। এ নিয়ে জাতের কাণ্ডারিরা ম্যালাই চরকা ঠেলেছেন। চোখে চশমা, মাথায় ঝুঁটি আর খদ্দর পাঞ্জাবি পরে লালন হিন্দু কি মুসলমান সেই বিচার-বিবেচনা চালু আছে সবসময়। এদিকে লালন সাঁই বলেন —

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না দুই নজরে

শ্রুত গল্পে বলে, লালন জাতের রূপটা দেখেছিলেন, এত ভয়াবহভাবেই দেখেছিলেন যে জাতের নামে বজ্জাতির কেরামতিকে অস্বীকার করলেন সারাজীবন। ১৭৭৪-এ কুষ্টিয়ার (তৎকালীন নদীয়ার) কুমারখালিতে তার জন্ম। সেখানে গড়াই নদীর পারে ভাঁড়ারা গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা।

মাধব কর ও পদ্মাবতীর কায়স্থ পুত্র লালন শৈশবেই পেয়েছিলেন যোগীর মন। তবু সংসারখাঁচায় বন্দী লালন স্ত্রী-মাকে নিয়ে জ্ঞাতিকুটুম্ব থেকে দূরে দাসপাড়ায় স্বতন্ত্র বসবাস করতে থাকেন। সেখানে পড়শি বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গী মিলে লালন নবদ্বীপে (মতান্তরে বহরমপুরে) গঙ্গাস্নানে (মতান্তরে তীর্থভ্রমণে) যান। সেখান থেকে ফেরা আর হলো না লালনের। প্রবল বসন্তরোগে আক্রান্ত হন তিনি, অচেতন হয়ে পড়েন। সঙ্গীরা মৃত লালনের মুখাগ্নি না করে সংক্রামক রোগের ভয়ে পালিয়ে যান, কে বা কারা সদয় হয়ে লালনের দেহ জলে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়, গ্রামে খবর পোঁছালে মৃত লালনের শ্রাদ্ধকৃত্য হয়।

এদিকে পরিত্যক্ত লালনের দেহপিঞ্জিরা জলে ভেসে ভেসে কূলে এসে ভেড়ে। এক মুসলিম নারী ঘাটে জল নিতে এসে লালনকে পান। তারই শুশ্রূষায় বেঁচে ওঠেন লালন। অবশ্য তখন তার মুখে গভীর ক্ষতচিহ্ন আর এক চোখ হয়ে গেছে অন্ধ। সেই অবস্থায়ই লালন ঘরে ফেরেন। কিন্তু তখন তার নিজের ঘরের চাবি পরের হাতে। সমাজপতিরা গ্রহণ করে না লালনকে। একে তো সকলের কাছে লালন মৃত, তার শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে সে মুসলমানের হাতে অন্ন-জল গ্রহণ করেছে। সমাজ-স্বজন থেকে প্রত্যাখ্যাত লালন সাঁই বেরিয়ে আসেন পথে।

এইভাবে গৃহত্যাগী লালন দেখা পেলেন সিরাজ সাঁইয়ের। মুসলমান হলেন, বাউলমতে দীক্ষা নিলেন লালন। তারপর সারাজীবন জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। জেনেছেন —

এ কি আসমানী চোর ভাবের শহর লুটছে সদায়
ও তার যাওয়া-আসা কেমন রাহা কে দেখেছে বলো আমায়

২.
গুরু সিরাজ সাঁইয়ের আদেশে ১৮২৩ সালে লালন কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আখড়া গড়েন। ভক্ত-শিষ্য নিয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে সাধুর সেই সাধবাজার। এখানেই মুখে মুখে রচেছেন পদ, গেয়েছেন গান, এই সাধের হাটেই মৃত্যু হয়েছে তার। সেই মৃত্যুও পৌরাণিক গল্পের মতোই মহিমান্বিত। কথিত আছে, মৃত্যুর কিছুকাল আগেই শতোর্ধ্ব সাধক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবু সেই অসুস্থ শরীরেই গান বাঁধতেন। রোগশয্যা থেকে উঠে মৃত্যুর একটু আগেও বলেন, “ওরে আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।” যখন ভক্তিভাব কি সুর ধরা দিত সাঁইয়ের পরানপিঞ্জিরায় তখনই তিনি সাধারণত বলে উঠতেন, “পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে গো!”

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (বাংলা ১২৯৭, ১ কার্তিক) জুম্মাবারের ফজরের কালে জীবনের শেষ পোনা মাছের ঝাঁক ধরলেন সাঁই, গাইলেন —

পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে
ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে

তারপর, সাধক বললেন, “আমি চললাম।” মাটির পিঞ্জিরার দেহ খালি পড়ে রইল, আর সাধকের অচিন পাখি গেল নিরঞ্জনের খোঁজে।

লালন চলে গেলেন, কিন্তু তার গান, তার পোনা মাছের ঝাঁক ছড়িয়ে গেল দূর থেকে দূরে কালে-কালান্তরে। দুই শতক পার হওয়ার মুখেও তাই আজও সারাবছর ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় ভক্ত-শিষ্যরা মত্ত হয় লালনের গানে। আর প্রতি দোলপূর্ণিমায় লালনের গান শুনতে, লালনের মাজার দেখতে, লালনের গান গাইতে আসে হাজার হাজার মানুষ। তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না সাঁইজির আখড়ায়।


ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী হিরণ মিত্র

[১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল সংখ্যায় পাক্ষিক আনন্দভুবন দোলপূর্ণিমাকালে এই রচনাটা ছাপে। রচনাটা আরও বড় কলেবরের, মুখ্যত আখড়ায় জমায়েত-হওয়া বাউলদের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন, সেইখানে একাংশ ছিল লালনের একটা বায়োস্কেচ। ওই অংশটুকু ঈষৎ সম্পাদিত ও অনেকাংশ সংক্ষিপ্ত করে এইখানে ছাপা হলো। — গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you