ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা

ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

 

চাক্ষুষ যোগাযোগ না থাকলেও একটা মানুষের সাথে একটা মানুষের আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব। অনুভূতি দিয়ে যে-কোনো মানুষের জীবনকে পাঠ করা যায়। জীবনপঞ্জির কিছু না কিছু নথি মানুষ রেখে যান। সেই নদীর দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় তাঁর মনের গহীন গন্তব্য। প্রত্যেকের যাপিত জীবনের একটা দার্শনিক পটভূমি থাকে। সেই দার্শনিক পটভূমিতেই জীবনীর তালাচাবি খুলতে হয়। ফকির সমছুলের যে-সাধনাঘর সেই সাধনাঘরের তালাচাবি হচ্ছে তার দুটি গ্রন্থ। একটির নাম ‘আশিকের রত্নসমগ্র’ ও অন্যটি ‘যাওয়ার পথে’। দুটো গ্রন্থেই আভাষিত আছে তাঁর জীবননৌকার গমনাগমন। আত্মজ্ঞানের পরম পুরুষকে তিনি আশিক হয়েই পেতে চেয়েছেন। সেই আশিকজ্ঞানকে যাপন করেছেন এবং লিখে গেছেন। মায়া ও প্রেমের দুই চোখে আশিকজ্ঞানী হয়ে পরমের প্রতি নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন। এই সমর্পণের চিহ্নই তাঁর গীতিকাব্যে উদ্ভাসিত আছে।

মেঘালয়ের পাদদেশে ভাটিবাংলায় আউল-বাউল-সহজিয়া-পীর-ফকির-সাধু-সন্ন্যাসী মাত্রই মুর্শিদজ্ঞানে বিশ্বাসী। এঁরা কোনো-না-কোনো পীরের বায়াত গ্রহণ করেন। সহজ জীবনের উত্তরাধিকারে পীর-মুর্শিদের বিজ্ঞাপিত পথে পরমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। এঁরা বিশ্বাস করেন পরম কাউকে খালি হাতে ফেরান না। পরমজ্ঞানের এই মানবিক মানুষেরা অত্যন্ত সাধারণ আর সহিষ্ণু জীবনযাপন করেন। সংসারের নানা রকম ঝড়ঝাপটাকে সহজ চোখে মোকাবেলা করেন। হাওর-বাঁওরের এই পরম মানুষেরা শাপলা ফুলের মতো সহজ। ফকির সমছুলের সহজ জীবনটা দেখলেই বোঝা যায় বাংলার ফকিরি ও মুর্শিদজ্ঞানের উত্তরাধিকার।

শত শত পীর-আউলিয়া-সহজিয়া-সাধু-সন্ন্যাসী-দরবেশের এই নরম-কোমল-পবিত্র হাওরাঞ্চলের জনসংস্কৃতি পৃথিবীর যে-কোনো অঞ্চল থেকেই ভিন্ন। বহুমাত্রিক ভাব ও ভাবুকতার ঐশ্বর্যমণ্ডিত জনপদ সুনামগঞ্জ। এই জেলার সদর থানার দরগাপাশা ইউনিয়নের ধরাধরপুর নিবাসী ফকির সমছুল ১৩৪৮ বাংলার চৈত্র মাসের শেষ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। সাধকের পিতার নাম লাল মোহাম্মদ, এবং মাতার নাম সোনাভান বিবি। পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে জীবনের শূন্যতায় প্রবেশ করেন। পিতাকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য নানা রকম কাজের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু সংসারের অভাব কি আর দূর হয়!

সংসারে নানারকম অভাব আর ঝড়ঝাপটায় থাকতে থাকতে এক সময় মুর্শিদজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়। এ সময় তিনি বাড়ি-বাড়ি ফেরি করে নানান রকম জিনিস বিক্রি করতেন। মুর্শিদপ্রেমের নেশাতেই মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে সংসারের মায়াজাল ছিন্ন করে একই জেলার ছাতক উপজেলাধীন হাবিদপুর নিবাসী পিরে-কামিল শাহ নয়ান ভানু আহমেদ আলীর শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে মুর্শিদ হিসেবে বরণ করেন। এই মুর্শিদের তাবেদারিতেই তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।

টানা তেরো বছর তাঁর খেদমতে থাকার পর একদিন মুর্শিদ আদেশ দিলেন স্থান পরিবর্তনের। মুর্শিদের সেই আদেশেই নিজগ্রামের পৈত্রিক ঠিকানা রেখে একই জেলার আক্তাপাড়া গ্রামে চলে আসেন। এখানে কিছুদিন কাটিয়ে মিনাবাজার সংলগ্ন মাসিং নদীর পূর্বতীরে ঘর বাঁধেন। মুর্শিদের সেবাতেই জীবন কাটিয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন মূলত আশিকের জীবন। একজন পরিপূর্ণ আশিক তিনি। তাঁর লেখা ‘আশিকের রত্ন’ গানগুলো মূলত জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার পথ ও পথের সন্ধান।

গানের পথে তিনি মানুষকে খুঁজেছেন। প্রেমিক ও রসিক হয়ে গানের পথে তিনি মানুষের অন্তঃপুর বোঝার চেষ্টা করেছেন। খোদাকে জানতে হলে নিজেকে জানতে হবে, নিজের আত্মাকে, রুহুকে জানতে হবে। জানাবোঝার এই পরমজ্ঞানেই ফকির সমছুল নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ফকিরালির বিষয়গুলো, ভাবসাগরের মরমী ভাবনাগুলোকে গান গানে প্রচার করেছেন তিনি। দেহতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, আত্মতত্ত্বের পরিশুদ্ধ সমর্পণ হচ্ছে ‘আশিকের রত্নসমগ্র’।

ফকির সমছুলের অর্জিত-যাপিত-সমর্পিত জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ তাঁর কাছে বায়েত গ্রহণ করেছেন। ফকির সমছুলের বাড়িটি বর্তমানে ফকিরবাড়ি নামে খ্যাত। তাঁর ফকিরবাড়িতে প্রতিবছর পৌষ মাসের ২৭ তারিখ ওরস অনুষ্ঠিত হয়। অসংখ্য ভক্ত-মরমীয়ারা এই মিলনমেলার আয়োজন করেন। ভক্তের মিলনমেলায় পরিপূর্ণ হন ভক্তবৃন্দ। ফকির সমছুলের গীতিকাব্য ভক্তদের হৃদয় শান্ত ও শমিত করে এই বিরুদ্ধ জলবায়ু ও আবহাওয়ায়।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে ফকির সমছুল

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you