দম গেলে দিন আর পাবে না || সুমনকুমার দাশ

দম গেলে দিন আর পাবে না || সুমনকুমার দাশ

সৈয়দ আবদুল লতিফের নামটি এত বেশি পরিচিত নয়। কিন্তু মানুষ যে তাঁর নাম শোনেননি তাও কিন্তু নয়। তবে তাঁর শিষ্য/মুরিদ আরকুম শাহের নামটি কিন্তু বহুল পরিচিত। তবে কি শেষপর্যন্ত আরকুম শাহের মুর্শিদ হিসেবেই আবদুল লতিফকে পরিচিত হতে হবে? অথচ বিস্মৃতপ্রায় এ বাউলসাধকের অনেক তত্ত্ববহুল সারবান বাউলগান রয়েছে, যেগুলো এখন পর্যন্ত অনালোচিত রয়ে গেছে।

মৃত্যুর প্রায় ৫৭ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর গানের দর্শন কিংবা জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কোনও আলোচনা আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি! এই যদি হয় অবস্থা —তাহলে বাংলার বাউল ভাবধারার বিচার-বিশ্লেষণ/গবেষণা কী পর্যায়ে রয়েছে, সেটাও কিছুটা অনুমান সম্ভব। লালন, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, শাহ আবদুল করিম কিংবা দুর্বিন শাহ-র গান যেভাবে আলোচিত হয়েছে, সে-তুলনায় সৈয়দ আবদুল লতিফের নাম উচ্চারিত হওয়া তো দূরের কথা, নামগন্ধ পর্যন্তও সেভাবে আলোচিত হয়নি।

সৈয়দ আবদুল লতিফ অনেকের কাছে শাহ আবদুল লতিফ নামে পরিচিত। আর তিনি নিজেকে ‘সুফি’ হিসেবে পরিচয় দিতেন, তাঁর গানেও এমনতর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তাঁর জন্ম সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকার পার্শ্ববর্তী ফুলগাঁও গ্রামে। তাঁর জন্ম ১৮৪০ সালে এবং মৃত্যু ১৯৬০ সালে (২৭ কার্তিক ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ)। তাঁর বাবা সৈয়দ আনোয়ার উদ্দিন। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যান। এ-সময় নানি তাঁকে লালন-পালন করে বড় করে তোলেন। ভারতের একটি মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেছেন। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে বর্তমানে এক মেয়ে জীবিত রয়েছেন। আবদুল লতিফ প্রায় দুইশ গান রচনা করেছেন।

সৈয়দ আবদুল লতিফের রচিত গানগুলোর মধ্যে মুর্শিদি, বিচ্ছেদ, পিরবন্দনা, কামতত্ত্ব ও বাউলতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত গান রয়েছে। বাউলসাধনায় মুর্শিদ-ভজনা যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, তাই সেদিকে তাঁর আগ্রহ লক্ষণীয়। তিনি মুর্শিদ-নিঃসৃত বাণীকে যথাযথভাবে পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক গানে তিনি লিখেছিলেন :

দম গেলে দিন আর পাবে না, মুর্শিদের কথা শুন
মিথ্যাবাদীর সঙ্গ নিয়া কাজে কাজে হলে খুন।।

বাল্যকালে ধুলার খেলা, যুবককালে যৌবনজ্বালা
প্রিয়সীর সঙ্গ নিয়ে বেহুঁশে পাইল দারুণ।।

সুবচন পবিত্র বাণী যে শুনে সে ধনের ধনী
মানের মানি চন্দ্রমণি, বলব কি তার কত গুণ।।

তুচ্ছ করি জন্মভরি, হবে যত পুরুষ-নারী
নরকবাসী গলে ফাঁসি ভবিষ্যৎ কী গুণাগুণ।।

গূঢ়তত্ত্ব গুপ্তবাজার না গেলে কি পাবে নিস্তার
সুফি আবদুল লতিফে কইন নোটিশ জারি সুবুলি ‘কুন ফাইয়া কুন’।।

একই রকম আরেকটি গানে আবদুল লতিফ মুর্শিদের ‘চরণ ধরিয়া’ পথ চলার কথা জানিয়েছেন। বাউল-ফকির মতবাদ অনুযায়ী, আগে ষড়রিপু মুক্ত মানুষ হতে হবে। তবেই সাধনায় মনোনিবেশ সম্ভব। এ বিষয়টি নিয়ে আবদুল লতিফ লিখেছেন —

সরল মনে সরল পিরিতি
পবিত্র মুর্শিদের চরণ ধরিয়া কর আরতি।।

বিশ্বাসকে করিয়া দৃঢ়, রিপুগণের সঙ্গ ছাড় রে
ওরে অন্ধকারে প্রকাশ হবে, দেখবে শুধু রঙবাতি।।

স্বপনে গোপনে পাবে মঞ্জিলে পৌঁছিয়া যাবে রে
ওরে মকসুদ হাসিল হবে, বেগমপুরে সারথী ।।

নদীনালা চলমান হর মধ্যে মধ্যে গায়বি কবরে
ওরে শাহ আবদুল লতিফে বলইন লতিফনগর বসতি।।

সাধনার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পুরো সাধনপদ্ধতিই বৃথা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মুর্শিদ সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। সেই ‘ঘোর বিপদ’ থেকে উদ্ধারে ত্রাণকর্তা কিংবা কাণ্ডারি হিসেবে মুর্শিদের নাম-স্মরণ বা জপ করাই শিষ্যের জন্য উত্তম। এ-কারণেই শাহ আবদুল লতিফ উচ্চারণ করছেন :

অসকালে অকূলে তরি
মুর্শিদ হও যদি কাণ্ডারি
অসকালে অকূলে তরি।।

ভাঙা নায়ে বাদাম দিয়া
তোমার পানে রইলাম চাইয়া
দয়াগুণে কিনারা লাগাও
অকলঙ্ক নাম তোমার কলঙ্ক হবে ভারী।।

অমূল্য ধন ভরা দিয়া
কোথায় রইলায় ছাপিয়া
আমি তোমায় তাল্লাশি না পাই
আশার আশে রইলাম বসে উদ্ধারি লও পায় ধরি।।

শাহ আবদুল লতিফে কইন
মুর্শিদ মৌলা তোমার সব লীলাখেলা
আমি কি আর বুঝিতে পারি।।

এ-রকম ফকিরিতত্ত্বনির্ভর অসংখ্য গান তিনি রচনা করেছেন। সেসব গানের কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা সংকলন প্রকাশিত না হওয়ায় শাহ আবদুল লতিফ নামটি ক্রমশ বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you