গোয়াইনঘাটের ঘটনার রেশ ও রিফ্লেকশন || হাসান আহমদ

গোয়াইনঘাটের ঘটনার রেশ ও রিফ্লেকশন || হাসান আহমদ

শেয়ার করুন:

মালনীছড়া চা-বাগানের ভেতর দিয়ে যে গভীর বনপথ হিলুয়াছড়া হয়ে কালাগুল গিয়ে মিশেছে, কিছুদিন আগেও আমি সে-রাস্তা দিয়ে প্রায়ই ভ্রমণ করতাম। এই কাঁচা রাস্তাটির নির্জনতা আর ছায়াঘেরা দীর্ঘ পথকে আমি আমার বিক্ষিপ্ত মনের প্রশান্তির জন্য একটা আধ্যাত্মিক ভ্রমণের পার্থিব রুট হিসেবে বিবেচনা করতাম।

যা-ই হোক, কালাগুল গ্রামের পরিচিত এক ভদ্রলোককে একদিন বললাম, “ভাই, এই রাস্তাটি পাকা হয়ে গেলে তো আপনাদের সিলেটে যাতায়াতের পথ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। কেননা, মাকড়খলা, কালাগুল এবং তৎসংলগ্ন আরও অনেকগুলো গ্রামের মানুষকে, সাহেববাজারের রাস্তা দিয়ে, ধোপাগুল পয়েন্ট হয়ে, অনেক পথ ঘুরে সিলেটে যেতে হয়।”
লোকটি বললেন, মালনীছড়া চা-বাগানের মালিক মিস্টার রাগীব আলী বহুবছর আগে এই এলাকায় একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় করতে চেয়েছিলেন। তখন গ্রামবাসী সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে এলাকা খরাপ হয়ে যাবে। এখানে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা হবে। ফলে গ্রামের পরিবেশ নষ্ট হবে ইত্যাদি।
মিস্টার রাগীব আলী তাদেরকে বলেছিলেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে এলাকাবাসীর উন্নয়ন হবে, তাদের কর্মসংস্থান হবে, তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয়, তিনি হিলুয়াছড়া-মালিনীছড়ার রাস্তাটি পাকা করে দিবেন।

তাতেও গ্রামবাসী রাজি হয়নি, তারা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় করতে দেয়নি। পরে মিস্টার রাগীব আলী কামালবাজার এলাকায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের লিডিং ইউনিভার্সিটি

এই ঘটনা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। এখনও এই দেশে এমন পশ্চাৎপদ চিন্তার একটা বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে, ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।

আমি ভাবলাম, ওই গ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেটি হতো সে-গ্রামের মানুষের সৌভাগ্যের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হতে পারতো। সেখানকার জমিজমার দাম বেড়ে যেত। হয়তো তাদের সন্তানসন্ততি সেখানে পড়ার সুযোগ পেত। সিলেট শহরের সাথে তাদের যোগাযোগের দূরত্ব অর্ধেক কমতো এবং কষ্ট লাঘব হতো।

কিন্তু দূরদৃষ্টির অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সুশিক্ষার অভাবের কারণে তারা এ-সবকিছু উপেক্ষা করেছে এবং নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জীবনমান পাল্টে দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

গোয়াইনঘাটে পর্যটকদের বাধা দেওয়ার ঘটনাও একই রকমের। দুটি ঘটনাই একই সূত্রে গাঁথা। গোয়াইনঘাটের ওই এলাকায় পর্যটনের প্রসার হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সেখানকার জনগোষ্ঠী। সেখানে ব্যবসাবাণিজ্য এবং আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসার হতো। মানুষের কর্মসংস্থান হতো। মানুষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ ত্বরান্বিত হয়।

আজকের পৃথিবীতে সৌদি আরব এবং ইরানের মতো কট্টর ও রক্ষণশীল দেশ যেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থে নিজেদের দরজা পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত আলিম-ওলামা এখনও তাদের পশ্চাৎপদ চিন্তার শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারছে না। এর মূল কারণ, প্রকৃত মানবিক শিক্ষার অভাব। আর মধ্যযুগীয় কায়দার পাঠ্যসূচি।

রাষ্ট্র রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য তাদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা ভাবছে না, অর্থাৎ, তাদের কারিকুলাম যুগোপযোগী করার চিন্তা করছে না।

আমাদের দরকার কামাল আতাতুর্ক পাশার মতো একজন নেতা, যিনি ধর্মের-আফিমে-বুঁদ-হয়ে-থাকা এদেশের মানুষকে পথ দেখাবেন, এবং মানুষের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন, ধর্ম যে প্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না তা মানুষকে বোঝাবেন।

এদেশের দুর্ভাগ্য, হয়তো কখনোই আমরা আতাতুর্ক পাশার মতো নেতা পাবো না।

১১ জুন ২০২৫


হাসান আহমদ রচনারাশি

হাসান আহমদ
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you