করোনা সংক্রমণ ও মহামারীতে বিশ্ব এখন দিগ্ভ্রান্ত। কোনো দেশই এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। বিশ্বে মানুষের কাছে করোনা-মহামারী ব্যতিক্রমী এক অভিজ্ঞতা। আগে কখনও কোনো মহামারীতে এ-ধরনের অবস্থা তৈরি হয়নি। চলমান এ ভয়ানক সংকটে তুরস্কে কিছু তরুণ শিল্পী-সংবেদনশীল ব্যক্তি তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার, এবং কারাগার থেকে মুক্তির দাবিতে অনশন করছে। তবে এ অনশন করোনা-মহামারীর মধ্যে তারা শুরু করেনি। শিল্পী হিসেবে তারা ৩৫ বছর ধরে সংগীত পরিবেশনে আন্দোলন করছে। কারণ, তাদের প্রতিবাদী গান কোনো সরকারেরই পছন্দ হয়নি। তাদের লোকগান অন্যার্থে গণসংগীত বিষয়ক ব্যান্ডদলের নাম গ্রুপ ইয়োরাম (Group Yorum)। করোনা মহামারীতে যখন গোটা পৃথিবীতে মৃত্যুর মিছিল, তখন তুরস্কের ইস্তানবুলে মারা গেলেন ইয়োরামের শিল্পী হেলিন বোলেক সহ আরও অনেক। উল্লেখ্য যে, টানা ২৮৮ দিন অনশন করে গত ৩ এপ্রিল চলে গেলেন Group Yorum-এর অন্যতম সদস্য ২৮ বছর বয়সী হেলিন বোলেক। অনশনের ধাপে ধাপে বোলেক ছাড়াও আরও কয়েকেজন মারা গেছেন। এত অল্প বয়সে তারা মারা গেলেন আন্দোলন করতে করতে, ভাবতেই অবাক লাগে। সেই কামাল আতাতুর্ক থেকে নাজিম হিকমত হয়ে আজ পর্যন্ত সংগ্রামেই আছে তুরস্ক। কিছুই বদলালো না। একজন প্রতিষ্ঠিত, জনপ্রিয় সংগ্রামী শিল্পী হেলিন ও মোস্তফার মৃত্যু আমাদের বিস্মিত করে। আহত করে। তাঁদের মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে ২০২০ সালের ৩ ও ২৪ এপ্রিল। বিগত কয়েকমাস থেকে কোভিদ-১৯ এর আক্রমণ-সংক্রমণে গোটা পৃথিবী বিপর্যস্ত, অস্থির। এ সময়ে তুরস্কের বর্তমান সরকার বাঁচতে দিলো না শিল্পীদের। দেওয়ার কথাও নয়। ক্রমশ নির্যাতন, মামলা, গ্রেফতার, হত্যা ইত্যাদি করেও ক্ষান্ত হয়নি সরকার। ২০১৬ সালে ইয়োরামকে নিষিদ্ধ করে এরদোগান সরকার। এরপর থেকে তারা মূলত গৃহবন্দি। আর একের পর এক মিথ্যা মামলা, সাজা প্রদান ইত্যাদি ইয়োরাম দলভুক্ত সদস্যদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে। শিল্পীরা এসব নিষেধাজ্ঞা বাতিল, মামলা প্রত্যাহার ও বন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুর করে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হয় দীর্ঘকালীন আমরণ অনশন। তুরস্কে তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও শিল্পীদের এভাবে গণহারে অনশন ও মৃত্যুকে গভীর সংকট বলেই নানা জন অভিহিত করেছেনে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো এ লেখাটি তৈরি করার সময় মোস্তফা কোচেক-এর ট্রাজিক ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কোচেক হেলিন বোলেক-এর সহপাঠী। আমি নিজেও ভাবিনি যে, একই সংগঠনের একজনকে নিয়ে লিখতে বসে আবার লেখাটি পরিবর্তন করতে হবে। গণমাধ্যমের সংবাদগুলো পাঠ করে যা মনে হলো, এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের দায়িত্ববোধ নেই। একে তো চলছে লকডাউন। অন্যদিকে তুরস্কেও করোনা ইস্যুতে অনেক লোক মারা গেছেন। সংগীত বিষয়ে তুরস্কের এরদোগান সরকার কেন এত বিক্ষুব্ধ হলো, তা বোঝা কঠিন নয়। নিশ্চয়ই তার রাজনৈতিক ভয়-ভীতি, শঙ্কা থাকতে পারে। তিনি হয়তো নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত। এছাড়াও রক্ষণশীল এরদোগানের জন্য বিশ্বপুঁজিবাদের সমর্থন খুব জরুরি।
প্রসঙ্গত, হেলিন বোলেকের মৃত্যুসংবাদে এ লেখাটি শুরু করি। লেখাচলাকালীন হেলিনের সহযোদ্ধা মোস্তফা কোচেকও মারা গেলেন ২৮ বছর বয়সে। ২০১৭ সালে গ্রেফতারের পর ২৯৭ দিন অনশনের পর তিনি মারা গেলেন গত ২৪ এপ্রিল। মোস্তফার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যেই তার বিদায় হলো। এ বিষয়ে দলের এক সদস্য তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, —
‘We lost Mustafa but death fasts still continue today; attorneys Ebru Timtik and Aytac Unsal have been on a death fast for 113 and 82 days, Grup Yorum [music band] member Ibrahim Gokcek for 312 days, Didem Akman and Ozgur Karakaya on 62 days. Days are moving terribly fast, the resisting ones are running out of time.’
এ ভাষ্য থেকেই বোঝা যায় অনশনে অনেক সদস্যই এর মধ্যে মারা গেছেন। হেলিন বোলেক, ইব্রাহিম গোকচেক ও মোস্তফা কোচেক একসাথে অনশন করেছেন ২৫০দিন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা সত্ত্বেও মোস্তফাকে প্রচুর নির্যাতন করা হয়েছে। মোস্তফার বিপক্ষে নানা অভিযোগও সাজানো হয়। বলা হয় যে, তিনি বন্দি অবস্থায় কারাগারকর্মীকে মারধর করেছেন। আসলে নানা অজুহাতে ইয়োরাম সদস্যদের শাস্তি দেওয়া হলো সরকারের মূল প্রকল্প। এ-সূত্রে মোস্তফা কোচেককে আজীবন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়। মোস্তফার মা বলেছেন, — ‘আমার ছেলে নির্দোষ। জোর করে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, একজন তথ্যবাহকের মাধ্যমে।’ মোস্তফা মৃত্যুর আগে বলেছেন, ‘জীবন খুব সুন্দর তাই আমি মরতে চাই না’। এছাড়াও বলেছেন, তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যদি অস্বীকার করেন, তাহলে তার অন্তঃসত্ত্বা বোনকে ধর্ষণ করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ রক্ষা হলো না, তাকে মরতেই হলো। তার মৃত্যুর পর বন্ধুরা বলেছে, মোস্তফা হলো ন্যায়বিচার ও সম্মানের প্রতীক। যে-ন্যায়ের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। ইয়োরাম ব্যান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা, শিল্পীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার সহ বেশ কিছু দাবিতে অনশন করে আসছিলেন হেলিন বোলেক ও সহযোদ্ধারা।
ইয়োরামের শিল্পীরা নাজিম হিকমতের উত্তরসূরি বলেই তারা এরদোগানবাহিনীর কাছে অসহনীয়। এরদোগানপ্রশাসন তাদের বাঁচতে দেবে না। এর আগেও কামালের বিপরীত স্রোতের যারা ক্ষমতায় এসেছে তারাই কামাল-অনুসারীদের হত্যা কিংবা কারাগারে অন্তরীণ রেখেছে। দূরে থেকে আধুনিক তুরস্কের নির্মাতা কামালের দেশে এমন হালহকিকত দেখে, পর্যবেক্ষণে আমাদের আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
বস্তুত, হেলিন বোলেক, মোস্তফা কোচেক ও তুরস্কের সামগ্রিক বিষয়ে এখানে আমার পক্ষে বিস্তৃত লেখা সম্ভব নয়। তবে এই লেখা তাদের আন্দোলন ও মৃত্যু এসব বিষয়ে জানতে সুযোগ করে দিয়েছে। গণমাধ্যম ও অনলাইন থেকে ইয়োরাম বিষয়ে জানার চেষ্টা করি। হেলিন ও তার ইয়োরাম ব্যান্ড দল সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছি, তা মূলত আলগা থেকে। গভীরভাবে জানা নয়। কিন্তু শিল্পী-সংগ্রামীদের মৃত্যুতে আমরা বেদনাহত হই, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছে জাগে। গণমানুষের অধিকার ও গানের প্রতি তাদের আত্মনিবেদন দেখে ভাবি — একজন শিল্পী দেশ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জনগণের জন্য কতটুকু নিবেদিত হলে নিজেকে এভাবে বিসর্জন দিতে পারে! তাদের উদ্দেশ্য হলো তুরস্কের সংস্কৃতিকে মুক্ত করা। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দাবিতে একজন শিল্পী নিজেকে বিলিয়ে দেয়? দেয়, এর প্রমাণ পেলাম হেলিন বোলেক ও তার দলের কাছে।
আমরা জানি, তুরস্কের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এর মাঝেও কিছু মানুষ শুধু আবেগের অনুবর্তী হয়ে কথা বলে বা অন্ধকার তুরস্ককে দেখতে আগ্রহী। স্পষ্টত, কামাল আতাতুর্ক মারা যাবার পর আর তাঁর নির্দেশিত পথেও তুরস্ক চলেনি। যদিও তিনি উদার জাতীয়তাবাদী চিন্তার মানুষ ছিলেন। ইতিহাসের তথ্য থেকে যেটুকু জানা যায় সবকিছুই এখন অপসারিত হয়েছে। তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনে কামাল আতাতুর্ক নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে নির্মাণ করেন। ১৯২৩ সালে কামাল তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেন। এর আলোকে তিনি দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেন। কামাল ঘোষণা করেছিলেন, — ‘পূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমে আমরা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বিচারিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা বোঝাতে চাই। এগুলোর মধ্যে কোনো একটি বাদ গেলে সমগ্র স্বাধীনতাই বিপন্ন হবে।’
এসব চিন্তাভাবনার আলোকে ১৯২৪ সালে কামাল একীভূত শিক্ষা চালু করেন। একইসাথে তিনি তুর্কি বর্ণমালা প্রচলন করেন। সে-সময় তিনি অত্যন্ত সাহসের সাথে বলেছিলেন, — ‘তুর্কি প্রজাতন্ত্র শেখ, দরবেশ ও অনুসারীদের দেশ হতে পারে না। সর্বোৎকৃষ্ট রীতি হলো সভ্যতার রীতি। মানুষ হওয়ার জন্য সভ্যতার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করাই যথেষ্ট। দরবেশপ্রথার নেতৃবৃন্দ আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন এবং তাদের খানকাহগুলো গুটিয়ে নেবেন ও স্বীকার করবেন যে তাদের রীতিগুলো পুরনো হয়ে গেছে।’ কিন্তু এরপর আধুনিক-তুরস্কবিরোধীরা শক্তি অর্জন করে এবং তাঁকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে। ইতিহাসের এমন পরম্পরায় এখনও সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। আধুনিক তুরস্ক নির্মাণের উত্তরাধিকার হলো ইয়োরাম। তবে গ্রুপ ইয়োরাম-এর মুক্তচিন্তার আন্দোলনের সাথে কামাল আতাতুর্কের সংস্কারবাদী চিন্তা গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
আমরা জেনেছি পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বিপ্লব-বিদ্রোহের মাধ্যম হয়েছে গান। সে-কারণেই বোধ করি শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্র চিরকাল সংস্কৃতিকে বেশিই ভয় করে। সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমায় গায়কের গান, — ‘ভাই রে কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়…’ সকলেরই মনে আছে। রাজা চেষ্টা করেও তার গান থামাতে পারেনি! এ গানের জন্যই শিল্পীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে হীরকরাজা।
বিষয় গণসংগীত, শিল্পীসংগ্রামী ও জনসংগ্রাম হলে প্রসঙ্গতই মনে পড়ে পল রবসন, নাজিম হিকমত, ভুপেন হাজারিকা, সলীল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কাজী নজরুল ইসলাম, রমেশ শীল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সত্যেন সেন, আবদুল লতিফ, সফদর হাশমি, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সোমেন চন্দ, ফকির আলমগীর সহ নানাজনের কথা। উপমহাদেশের শিল্পীরা বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত ও পল রবসনকে অনুসরণ করে গণমানুষের দ্রোহে গান লিখেছেন, গেয়েছেন। যেভাবে কবি নাজিম হিকমতের উত্তরাধিকার হলো আজকের শিল্পীসংগ্রামীদের সংগঠন ইয়োরাম। আমরা সামাজিক ও গণমাধ্যমে তাদের গায়কী, জনপ্রিয়তা ও গানের ব্যঞ্জনা দেখে-শুনে বিস্মিত ও মুগ্ধ হই। এই ব্যঞ্জনার শক্তিকেই শাসকদের যত ভয়। এখন তো সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় কিন্তু তারা ভয় পাচ্ছে সামরিক শাসকদের মতোই। আন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে আমরা জানতে পারি — সামরিক শাসনের বিরোধিতা করতে ১৯৮৫ সালে তুরস্কের একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী ইস্তানবুলে গড়ে তোলেন গ্রুপ ইয়োরাম লোকগানের দল। রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চায় সামরিক শাসকদের মানসিকতাকে তারা গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের লক্ষ্য হলো — সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শের সাথে নিজ দেশের ঐতিহ্যকে সমন্বিত করে তাদের সংগীত ও সংস্কৃতিচর্চা। ইয়োরামের উদ্যোগেই তুরস্কে গানের ইতিহাসে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসে। তাদের মুখ্য পরিবেশনা থাকে গণসংগীতে। তারা মানুষের অধিকার এবং মুক্তির লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কৌশল ও কার্যক্রম নির্ণিত করে। ১৯৮৭ সাল থেকে তুরস্ক সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের অ্যালবামগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। একইসাথে নানা মঞ্চে তাদের আহ্বান ক্রমশ বাড়তেই থাকে। তবে শুরু থেকে শুধু সংগীতেই ইয়োরাম নিমগ্ন থাকেনি। বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, রাজপথ সহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে তারা অংশগ্রহণ করে। ইয়োরাম ব্যান্ডদল মূলত তিনটি ভাষায় গান বুনে থাকে : আনাতলিয়-সিকারসিয়ান, তুর্কি ও কুর্দি।
আন্দোলনকেন্দ্রী ও গণমুখী হওয়ার কারণে ইয়োরাম দলের সদস্যদের প্রায়ই কারাগারে বা পুলিশের কব্জায় থাকতে হয়েছে। আর সাধারণ মামলা ছিল তাদের ক্ষেত্রে খুবই মামুলি বিষয়। এছাড়া কারাগারে ও বাইরে নানাভাবে তাদেরকে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে; হচ্ছে। নির্যাতনের বিষয় হয়ে ওঠে ইয়োরামদলের নিত্যসঙ্গী। কখনও প্রকাশিত অ্যালবাম-সিডি বাজার থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলেছে বা ধ্বংস করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। একসময় তুরস্কে ইয়োরামদলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দলের অধিকাংশ সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের মামলা দিয়ে কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়। ফলে, ২০১৬ সালের পর থেকে তারা মূলত আর গান পরিবেশনই করতে পারেনি।
এভাবেই দলন-পীড়ন-দমনের ভেতর দিয়ে ইয়োরাম অগ্রসর হয়েছে মানুষের সমর্থনে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইয়োরাম দলের সদস্য হেলিন বোলেক ও ইব্রাহিম গোকচেক অনশন অব্যাহত রেখেছিলেন। ইব্রাহিম এখনও অনশনেই রয়েছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের সংগ্রামে, বিপ্লবে, আন্দোলনে ইয়োরাম নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি গানে নতুনত্ব নিয়ে আসে। ফলে সহজেই দেশে ও দেশের বাইরে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দলটি। একদিকে চলেছে গ্রেফতার নির্যাতন আর অন্যদিকে ক্রম যুক্ত হতে থাকে প্রতিশ্রুতিশীল ও নিবেদিত কর্মী। মামলা নির্যাতন নিত্যকার ঘটনার পরও কয়েকবার তাদের সংগৃহীত বাদ্যযন্ত্র ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি ধ্বংস করা হয়। বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তাদের অ্যালবাম সমস্ত ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল ও তার নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা প্রচার করতে থাকে যে, ইয়োরাম দলের সাথে তুরস্কের নিষিদ্ধ বামপন্থী বিপ্লবী পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট-এর যোগাযোগ রয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় সন্ত্রাসবাদী। মোদ্দা কথা হচ্ছে তারা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে যা পুঁজিবাদী বিশ্বের অনেক দেশই সহ্য করতে পারছে না। অন্যদিকে তুরস্ক ইউরোপ-এশিয়ার অন্যতম প্রবেশমুখ এবং ভূরাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওযায় তুরস্ককে বগল থেকে কেউ হারাতে চায় না। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে সেখানে আবার গোষ্ঠী, সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব চরমে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব ঔষধ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে ইয়োরাম। ফলে, পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতির অবদান হলো তুরস্কে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন ও অনুবর্তী রাজনীতির প্রতিনিধি এরদোগান সরকার। এ ভূরাজনৈতিক মারপ্যাঁচে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপক্ষে মানুষের মধ্যে সংবেদন তৈরি করছিল ইয়োরাম, যা কোনোভাবেই তাদের মেনে নেওয়ার কথা নয়।
বস্তুত, ইয়োরাম তাদের দল ও গানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এছাড়াও দলের যে-সকল সদস্যের বিপক্ষে মামলা রয়েছে, তা প্রত্যাহারেরও দাবি জানায়। বর্তমান সরকার এ বিষয়ে পাত্তা না দিলে তারা মৃত্যু অবধি অনশন শুরু করে। এর মধ্যে করোনাসংক্রমণ বাড়তেই থাকে তুরস্কে। ইয়োরাম ঘরে অন্তরীণ থাকলেও করোনা নিয়ে তারা নীরব ছিল না। এর মধ্যেই গত ১১ মার্চ অনশনরত ইব্রাহিম ও বোলেককে জোর করে ডিটেনশন ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ওমর ফারুক গ্রেগারলিগলু তুরস্কের সংসদে ইয়োরাম দলের অনশন বিষয়ে কথা বলেন। এর মধ্যে ইব্রাহিম গোকচেক-এর শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হওয়ায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এ-বছরের ১৭ মার্চ। ইব্রাহিম গোকচেক বলেন, ‘এ অবস্থায় ইয়োরামদলের কেউই নীরব থাকতে পারে না। আমাদের জন্য দুটো পথ খোলা আছে — ‘হয় বিজয় নয় মৃত্যু’। নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ২০১৫ সালে তাদের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে সরকার। আদালতে গিয়েও অবশেষে কোনো সুফল আসেনি।
তুরস্কের আধুনিক সংগীতে ইয়োরামের ভূমিকা কেউ খাটো করে দেখে না। এ বিষয়ে সংগীতবিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক মুরাদ মেরিক বলেন, ‘ইয়োরাম বামপন্থার গণসংগীতের ব্যান্ডদল হলেও তারা সন্ত্রাসী নয়। দেশবিদেশে রয়েছে তাদের অ্যালবামের হাজার হাজার ক্রেতা ও শ্রোতা। এ গানের জন্য তারা সবসময়ই নির্যাতনের শিকার। তারা নিয়োজিত রয়েছে গানে ও বিদ্রোহে। তাদের সেই শক্তি প্রকাশ করে তারা গানে। ইয়োরাম তুরস্কের জনগণের কথা শুনেছে আর গানে এর রূপায়ণে ইতিহাসের বিনির্মাণ করেছে। ব্যান্ডদলের এত জনশ্রুতি তুরস্কের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সংক্ষেপে যেটুকু বলা যায় যে, ইয়োরাম দল স্বাধীনভাবে কনসার্টে অংশ নিতে চায়। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলমান রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। মূলত, জনগণের অন্তরের তাগিদ ও দ্রোহের গান তুরস্কে ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি করে। এ প্রেক্ষিতে সরকার যে ভিত্তিহীন, মিথ্যা মামলা দিয়েছে ইয়োরামের বিপক্ষে তা হাস্যকর।’
ইয়োরাম গানে নিয়ে এসেছে তুরস্কের লোকসাহিত্য, গীতিকা ও লোকঐতিহ্যকে। তারা বলে ও বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি গানের পেছনে রয়েছে ইতিহাসের উপাদান। দেশের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তারা তা বহন করছে মাত্র। গানে তাদের ফিউশনকর্ম সমৃদ্ধ করেছে বিভ্রান্তি তৈরি করেনি। তারা গানের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদ করেছে এবং তাদের আদর্শের বার্তা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট রয়েছে। দলের প্রতিটি সদস্যের কথা হলো — সংগীতের অধিকার দিতেই হবে, এছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অনশনের দু-শ দিনের মাথায় ইব্রাহিম গোকচেক যখন মৃত্যুর কাছাকছি তখনও তিনি বলেন — মৃত্যু আগে! তিনি বিশ্বাস করেন — মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও মুক্ত হবে তুরস্কের সংস্কৃতি। ডাক্তার সহ আইনজীবীরাও বলেছেন অনশনরতদের অবস্থা ভালো নয়। তারপরও অনশন তারা বন্ধ করেনি। গত নভেম্বরে হেলিন বোলেক কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও খাবার খেতে অস্বীকার করেন। তার দাবি ছিল গ্রেফতারকৃত ইয়োরাম দলের সকলকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে। গান পরিবেশনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়াও ইদিল কালচারাল সেন্টার মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেখানে আর যেন তল্লাশি চালানো না হয়। মূলত, ১৯৯৬ সালের পর থেকে অনশন ও জীবন এক হয়ে গেছে। অধিকাংশ ইয়োরাম সদস্য সহ অনেক রাজনৈতিক কর্মী এ অনশনে যোগ দিয়েছে এবং ক্রমশ মৃত্যুসংখ্যা বেড়েছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। ২০১৮ সালে হোসেইন শান্তি পুরস্কারজয়ী ফিনকানসিও বলেছেন, ‘অনশনকারীরা বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে কারণ তারা কোনোভাবেই ন্যায্য বিচার পাচ্ছে না।’ প্রকৃতপক্ষে যারা অপরাধী নয় তারাই অনশনে রয়েছে, উল্টো তাদের রাজনৈতিক শত্রু মনে করছে সরকার। তারা মূলত ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করছে। জুলফু লিভানেলি — যিনি সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছিলেন — তিনিও বলেছেন যে, রাষ্ট্র এখানে নৈতিক দায়িত্ব পালন করছে না, ফলে আইনের সুবিচার থেকে আন্দোলনকারীরা বঞ্চিত। সর্বোতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং ন্যূনতম নাগরিক অধিকারের বিষয়ও সরকার ভুলে গেছে। আইনজীবী গুলিজার তানকা এসব মামলার রেকর্ডপত্র দেখে বলেছেন, ২০০০ সালের ৩০ ডিসেম্বর একই কারণে ৩০জন বন্দিকে হত্যা করা হয়। তারা কেউই এ সরকারের কাছে সুবিচার পায়নি।
ইয়োরাম সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে স্টিভ সুইনি জানান : (ক) সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে ও মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় গঠিত হয় গ্রুপ ইয়োরাম। (খ) তারা মূলত লোকসংগীতের প্রেরণায় বিপ্লব ও গণমানুষের গান তৈরি ও পরিবেশন করেছে। এটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। (গ) তারা তুরস্কের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে। বিশেষত ভিক্টর জারা ও নাজিম হিকমতের প্রভাবই বেশি। সুইনি বলেন, ‘‘আমরা গানে গানে বলেছি, ‘খুনি আমেরিকা বিদায় হও (আমেরিকা খাতিল দাফল)’… এ আমার দেশ, আমরা নির্যাতনের কথা ভুলিনি’। … যদি অভিযোগ করা হয় আমরা রাজনৈতিক গান রচনা করি ও গাই, হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করছি, তা করি। যা আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য খুব প্রয়োজন। … আমরা আমাদের সংগীত ও লোকঐতিহ্যকে সামনে এনেছি, শাসকরা তা রুদ্ধ করতে চায়। … আমরা লক্ষ মানুষের মনের কথা বলছি, যেখানে শাসকদের আঘাত অর্থহীন বলে মনে করি। আর আমরা ৩৪ বছর ধরে সে-লড়াই করছি। … আমাদের গান, দল নিষিদ্ধ করা হলো, গ্রেফতার নির্যাতন তো আছেই। দলের অফিস ইদিল-এ হামলা করা হলো। বিভিন্ন সদস্যকে কারাগারে দেওয়া হলো। আর চলছে হত্যা … এতকিছুর পর আমাদের এ অনশনে যাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। আমরা দৃঢ়তার সাথে বলেছি — ‘আগে মৃত্যু’! … আমরা বিশ্বের শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট — নিষেধ ভাঙতে চাই। আর ইয়োরামের চেতনা সবখানেই আছে। … এ অনশনকে অনেকেই অনুসরণ করেছে। বিভিন্ন দেশের শিল্পী-শিক্ষক সংগ্রামী মানুষ আমাদের পক্ষে কাজ করছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই আমরা লড়াই করছি।”
অনশনে মৃত্যু সম্পর্কে সবাই বলছে তারা ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বলী। গ্রুপ ইয়োরাম এ-অনশনের সাথে কোনো সহিংসপন্থার আশ্রয় নেয়নি। আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যমে তা-ই বলা হয়েছে। তবু বোঝেনি তুরস্ক সরকার। কারণ তারা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা ধর্মীয় লেবাসে সাম্রাজ্যবাদের করতলে থাকতে আগ্রহী। এমনকি হেলিন বোলেকের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বাধা এবং সেখান থেকে অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। শোক সমাবেশ ঠেকাতে পুলিশকে গরমপানি ও গোলা ছুঁড়তে হয়। ইয়োরাম মূলত কুর্দি ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ক্ষমতাসীনরা বলেছে — বিপজ্জনক সন্ত্রাস, যা সবকালে সব দেশেই বলা হয়ে থাকে। ২০১৬ সালের পর থেকে যা-কিছু নির্যাতন সম্ভব তা করা হয়েছে গ্রুপ ইয়োরামের বিরুদ্ধে। সে-সময় মিথ্যা মামলায় প্রায় দুইহাজার সদস্যকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। বোলেককে গত বছরের ২০ নভেম্বর মুক্ত করে দিলেও তিনি অনশন বন্ধ করেননি। তখন গোকচেক ও বোলেক সহ অন্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হেলিন বোলেকের মৃত্যু, নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে নিন্দা জানিয়ে PEN বিবৃতি প্রদান করে। এ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘We are immensely saddened to learn of Helin Bölek’s passing. We strongly condemn the actions of the Turkish government that led to her death. Bölek was on a death fast because the Turkish authorities refused to guarantee this artistic group several of the most basic liberties necessary to a free and democratic society: that Grup Yorum be allowed to make music in peace, that their cultural center not be raided again and again, that their concerts not be banned, and that their members not be imprisoned for merely making music. Artists take risks, but they should not have to risk their lives. Turkish authorities’ hostile attitude toward freedom of expression and their continued crackdown on artists, writers, thinkers, and activists, especially those working on Kurdish issues, must cease immediately, and Grup Yorum members still in prison must be unconditionally released. Bölek’s death makes the truth painfully clear: The very lives of artists are on the line.” প্রতিবাদ, আটককৃত শিল্পীদের দাবি সত্ত্বেও বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কোনো দায়িত্ব নেয়নি। বোলেকের শেষকৃত্যে লাশের সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পীরা গানের মাধ্যমেই তাদের উচ্চারণ ও শপথ করে :
Every house is a castle
Our home is a school
‘Revolution to Victory’ in our language
A resistance in every home
A fedayeen (militant) in every home
‘Revolution to Victory’ in our language.
প্রসঙ্গত, ইতালির একটি গণসংগীত ‘বেল্লা চাও’ [Bella ciao] যা লোকগান হিসেবে সমাদৃত, এ গানটির গীতিকার কে — এখনও জানা যায়নি। এ গানটিও ইয়োরাম দল গেয়ে জনশ্রুতি অর্জন করে। ইতালিতে এ গানটি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গাওয়া হতো।
পরম্পরা হিসেবে বলছিলাম কবি নাজিম হিকমতের কথা। উল্লেখযোগ্য যে কামাল আতাতুর্ক-এর আমল থেকেই কবিশিল্পীদের কপালে নেমে আসে দুর্যোগ। তখন নাজিম হিকমতরা শুধু কবিতা ও শিল্পচর্চা করেননি, ছিলেন গণমানুষের সঙ্গী। গ্রুপ ইয়োরাম তা-ই করছে। ইয়োরাম দলের সদস্যরাও বলেছেন তারা নাজিম হিকমতের উত্তরসূরি। ফলে, ইয়োরামের সংগ্রাম-আন্দোলন বিষয়ে কথা বলতে গেলে নাজিম হিকমত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য যে, আমাদের দেশের বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শিল্পী ও রাজনীতির কর্মীরা এ কামাল আতাতুর্ক ও নাজিম হিকমতের আদর্শে উজ্জীবিত ও প্রণোদিত হয়েছেন। বিনায়ক সেন ‘নাজিম হিকমতের পৃথিবী’ শিরোনামার লেখায় ভিন্ন কিছু তথ্য দিয়েছেন। নাজিমের জীবনে কারাগার ও গ্রেফতার এক অবিচ্ছিন্ন বিষয়। বিনায়ক জানাচ্ছেন, — ‘এ সময়ের আতাতুর্কশাসনের লক্ষণীয় দিক ছিল বামপন্থীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা। এখন জানা যাচ্ছে যে, স্বয়ং আতাতুর্ক এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুক্রু কায়া নাজিমের কবিতা গোপনে ভালোবাসতেন বলে বামপন্থী সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে চায়নি তুরস্কের সরকার। ছোট ছোট মামলায় জড়িয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই ছিল দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য।’ একটি সাক্ষাৎকারে নাজিম হিকমতের কাছে জানতে চাওয়া হলো — ‘আপনি কার জন্যে কবিতা লেখেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নাজিমের উত্তর ছিল : ‘কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। একজন বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী, দায়বদ্ধ কবি (যে-নামেই তাকে চিহ্নিত করুন না কেন) তিনি হবেন এক সদা-সক্রিয় কবি : তিনি শুধু মানুষের হৃদয়ের কথাই বলবেন না, হৃদয়কে তিনি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন।’ এক্ষেত্রে নাজিম হিকমত উল্লেখ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষের প্রতিনিধি পল রবসনের কথা। বস্তুত, গণসংগীতে পল রবসন ও নাজিম হিকমত বিশ্বপ্লাবী দুটি নাম। পল রবসন কণ্ঠে তুলেছিলেন নিগৃহীত কালো মানুষের অধিকারের দাবি, জনগণের মধ্যে সমতা ও সাম্যের কথা। এছাড়াও উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন করেছেন পল রবসন। তখন কালোদের পক্ষে মানবিক নিরিখেও কেউ কথা বলার ছিল না। নিপীড়িত মানুষের হয়ে গান গাইলেন পল রবসন। রবসন বলেছেন, ‘Because my father was a slave, and my people died to build this country, and I am going to stay right here and have a part of it just like you.’
ফলত, প্রাসঙ্গিকভাবেই পল রবসন ও নাজিম হিকমত উপমহাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে সমভাবে শ্রদ্ধায় স্মরণীয় ও বরণীয়। সত্যেন সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা সহ অনেকেই রয়েছেন পল রবসনের ভাবশিষ্য। ভূপেন হাজারিকা তাঁর এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন : ‘একদিন হঠাৎ শুনলাম, পল রবসন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। সম্প্রতি তাঁকে নিগৃহীত করা হয়েছে। প্রায় সম্পূর্ণ আমেরিকাই তাঁকে বয়কট করেছে। হলিউড থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টেজেও তাঁকে বয়কট করেছে। কোথাও তাঁকে গান করতে দেওয়া হবে না। রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো তাঁর গান রেকর্ড করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। … পল ছ-ফুটের বেশি লম্বা। কোনো গ্রিনরুম নেই। নির্ধারিত সময়ে এলেন তিনি। পুরো কালো নয়। চকোলেট ব্রাউন গায়ের রঙ। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বান, ‘ওল ম্যান রিভার, ইউ ডোন্ট নাথিং। ইউ জাস্ট কিপ রোলিং রোলিং।’ লোকগীতি। তিনটে অন্তরা আছে। সঙ্গে শুধু একটা গিটার রয়েছে। খুব যে একটা ব্যাকরণ মেনে গান করেন তাও নয়। মনে পড়ে গেল, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় প্রথম যখন গান করি তখন আমিও তো দাঁড়িয়ে গান করেছি। অসাধারণ লাগল পল রবসনের সংগীত পরিবেশনারীতি। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। বললাম, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে আপনাকে এসে বিরক্ত করব। বললেন, নিশ্চই আসবেন। ওখান থেকে ফিরে এসে বন্ধুদের বললাম, সার্থক হয়ে গেল আমেরিকা দর্শন।’ পলের অনুসরণে তাঁর মতো করে ভূপেন হাজারিকা গাইলেন, ‘বিস্তীর্ণ দু-পারের / অসংখ্য মানুষের / হাহাকার শুনেও / নিঃশব্দে নীরবে / ও-গঙ্গা তুমি / গঙ্গা বইছ কেন’।
স্মরণীয়, ১৯৪৯ সালে বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত পল রবসনকে শ্রদ্ধা জানান যেভাবে :
They don’t let us sing our songs, Robeson,
My songbird with the wings of an eagle,
My Black brother with the pearly smile,
They don’t let us sing our songs.
They are afraid, Robeson,
Afraid of the dawn,
Afraid to see, to hear, to touch –
Afraid to cry like the rain washing a naked body,
Afraid to laugh like sinking one’s teeth into a hard quince.
They are afraid to love, to love like Ferhad
(surely you too must have a Ferhad, Robeson, what is his name?)
They are afraid of the seed, of the earth
and of the running water
Afraid to remember the hand of a friend,
Asking no discount, no commission, no interest –
A hand that has never alighted
like a lively bird in the palms of their hands.
They are afraid of hope, Robeson, afraid of hope, hope!
They are afraid, my songbird with the wing of an eagle,
They are afraid of our songs, Robeson. [To Paul Robson]
এ কবিতাই গণসংগীত হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সবখানে। গ্রেফতার, কারাগার, মৃত্যু কাউকে আটকাতে পারেনি। এটিকে ভাষান্তর ও স্বীয় ভাষায় রূপায়ণ করেন বাংলার গণসংগীতের গাঙচিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস। আজও এ উপমহাদেশে বিভিন্ন সংগ্রামে আন্দোলনে উচ্চারিত হয় এ গান।
নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
আমরা আমাদের গান গাই,
ওরা চায় না, ওরা চায় না
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা ভয় পেয়েছে রবসন
আমাদের দীপ্তকণ্ঠে ভয় পেয়েছে
আমাদের রক্তচোখে ভয় পেয়েছে
আমাদের কুচকাওয়াজে ভয় পেয়েছে, রবসন
ওরা বিপ্লবের রঙ্গরূপে ভয় পেয়েছে, রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা ভয় পেয়েছে জীবনে
ওরা ভয় পেয়েছে মরণে
ওরা ভয় পেয়েছে সেই স্মৃতিকে
ওরা ভয় পেয়েছে দুঃস্বপনে
ওরা ভয় পেয়েছে, রবসন
জনতার কলচ্ছ্বাসে ভয় পেয়েছে
একতার তীব্রতায় ভয় পেয়েছে
হিম্মতের শক্তিকে ভয় পেয়েছে, রবসন
ওরা সংহারের মূর্তি দেখে ভয় পেয়েছে, রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন
[হেমাঙ্গ বিশ্বাস]
এছাড়াও প্রাসঙ্গিক উপযোগে স্মরণ করতে হয় নাজিম হিকমতের অন্য গান ও কবিতাসমূহ। পৃথিবীর এমন কোনো পাঠক বা শ্রোতা নেই যে ‘আমি জেলে যাবার পর’ কবিতাটি পাঠ করেননি বা শোনেননি। নাজিম হিকমতের সেই বিখ্যাত কবিতা মূল তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজিতে, পরে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এখানে পাঠের সুবিধার্থে এ কবিতার ইংরেজি ও বাংলা ভাষার পাঠ তুলে ধরা হলো।
Since I’ve been in jail
The world has turned around the sun ten times
And if you ask the earth, it will say:
‘It’s not worth mentioning,
a microscopic time.’
And if you ask me, I will say:
‘It’s ten years of my life.’
I had a pencil
the year I came to jail.
It wore out in a week from writing.
And if you ask the pencil, it will say:
‘A whole life.’
And if you ask me, I will say:
‘It’s nothing, a mere week.’
Osman who was jailed for murder
completed a seven-year stretch and left
since I’ve been in jail.
He wandered around outside for a while,
and then got jailed again for smuggling.
He served a six-month term and left again,
and yesterday a letter came saying he’s married
and a child will be born in the spring.
Now they’re ten years old
the children who fell from their mothers’ womb
that year I came to jail,
And the colts of that year who had long thin shaky legs
have long since become docile broad-rumped mares.
But the olive shoots are still shoots
and they’re still children.
New squares have opened up in my distant city
since I’ve been in jail.
And our family
is living in a house I’ve never seen
on a street I don’t know.
The bread was pure white, like cotton,
the year I came to jail.
Later it was rationed out,
And we here on the inside beat one another
for a piece of black crust the size of a fist.
Now it’s free again,
But brown and tasteless.
The year I came to jail
The Second One had just begun.
The ovens in Dachau Camp were not yet lit,
The atom bomb was not yet hurled upon Hiroshima.
Time flowed like the blood of a child with his throat cut.
Later that chapter was officially closed;
Now American dollars are talking about a Third.
But in spite of everything, the days have brightened
since I’ve been in jail,
And about half of them
‘put their heavy hands on the pavement
and on the edge of darkness
straightened up.’
Since I’ve been in jail
the world has turned around the sun ten times.
And again I repeat with the same passion
what I wrote for them
the year I came to jail:
‘They
whose number is as great
as ants on the earth
fish in the water
birds in the sky
are fearful and brave
ignorant and learned
and they are children,
And they
who destroy and create
it is only their adventure in these songs.’
And for the rest,
for example, my lying here for ten years,
it’s nothing…
[Nazim Hikmet : Since I’ve Been In Jail]
*
জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুণে গুণে দশবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে –
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।’
আমি বলব –
‘না, আমার জীবনের দশটা বছর।’
যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষয়ে ফেলতে এক হপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব :
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’
যখন জেলে এলাম
খুনের আসামী ওসমান
কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল
তারপর চোরাই চালানের দায়ে
ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল
আবার খালাস হল।
কাল চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।
আমি জেলে আসবার সময়
যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল
আজ তারা দশ বছরের বালক।
সেদিনকার রোগা ঘোড়ার বাচ্চাগুলো
এখন রীতিমত নিতম্বিনী।
কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল
আজও তারা তেমনি শিশু।
আমি জেলে যাবার পর
দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক
আর আমার বাড়ির লোকে
এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায়
সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি।
যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম
রুটি ছিল তুলোর মত সাদা
তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ
এখানে এই জেলখানায়
লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল
আজ আবার অবাধে কিনতে পারে।
কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি।
যে বছর আমি জেলে এলাম
দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু
দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি
তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়।
টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল
তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়।
আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল।
কিন্তু আমি জেলে যাবার পর
আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন।
আর অন্ধকারের কিনার থেকে
ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে
অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ।
আমি জেলে যাবার পর
সূর্যকে গুণে গুণে দশবার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে
যারা মাটির পিঁপড়ের মত
সমুদ্রের মাছের মত
আকাশের পাখির মত
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মত সরল
যারা ধ্বংস করে
যারা সৃষ্টি করে
কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে।
আর যা কিছু
—ধরো, আমার জেলের দশটা বছর—
ওসব তো কথার কথা।
[অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়]
প্রসঙ্গত, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে নাজিম হিকমতকে ২০ বছর কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। তাঁকে মোট সাজা দেওয়া হয়েছিল ৫৬ বছর। নাজিম হিকমতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি কবিতা লিখেছেন ও বিপ্লবে উস্কানি দিয়েছেন। বোঝা যায় নাজিম হিকমত ও ইয়োরামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চরিত্র ও ধরন একই।
১৯৪৯ সালে নাজিমের মুক্তির জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন পাবলো নেরুদা, পল রবসন ও জ্যঁ পল সার্ত্রে। আবার ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার লাভ করেন নাজিম হিকমত। এ বছরেই পীড়নবিরোধী ও গণআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে নাজিম আমরণ অনশন শুরু করেন। নিয়তি হলো এ তুরস্কেই তাঁকে দুইবার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। এরপর তিনি বুলগেরিয়া হয়ে রাশিয়াতে পালিয়ে যান। অতঃপর তুরস্ক সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৬৩ সালে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন কবি নাজিম হিকমত। সহজেই উপলব্ধি করা যায় কবি পাবলো নেরুদা, পল রবসন, কবি নাজিম হিকমতের সাথে পরম্পরাগত সম্পর্ক ও সাদৃশ্য রয়েছে গ্রুপ ইয়োরামের সংগ্রামের। একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এজন্য আমরা আগেই বলেছিলাম তুরস্কে এ-আন্দোলন নতুন কোনো বিষয় নয়।
যে-কোনো অযৌক্তিক মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, যা অবশ্যই কষ্টদায়ক। অন্যার্থে ইয়োরাম শিল্পীদের মৃত্যু আমাদের বিস্মিত করে না। এসব মৃত্যু, দহন, পীড়নের ধারাবাহিকতায় এ সভ্যতা নির্মিত হয়েছে, এগিয়েছে। এরাই কালে কালে নিজেকে অঙ্গার করে এতদূর নিয়ে এসেছেন পৃথিবীকে। তাঁরা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন এ পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য। বিপরীতে অধিকাংশ পরজীবী, সৃজনশীলতাবিরোধীরা এ ভূগোল, সভ্যতার রস, সুধা, গুণ, আবিষ্কারের সমূহ সুবিধা নিয়ে আনন্দ, সুখ গ্রহণ করে। তারা নিজের উপলব্ধির শূন্যতাকে দুর্বলতা মনে না করে আত্মসুখ লাভ করে। ইহজগতের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করতে তারা অভ্যস্ত, কিন্তু শ্রম ও জ্ঞানচর্চার প্রতি তাদের কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। তারা সুবিধা গ্রহণ করে কিন্তু আবিষ্কার ও সৃষ্টিশীলতার বিরোধিতা করে। এতে তাদের লজ্জাও নেই। আর কথার বড়াই করে। আবার সৃজনশীলতার বিরুদ্ধে লড়ে যায় আরামআয়েশ ভোগ করে। ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা পায়, ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে। লোভে-লালসায় নিজের জগৎ নির্মাণ ও বেদি তৈরি করে, যে-ক্ষমতার আলোক ও কলকব্জা তৈরি করে হেলিন বোলেকরা। আবার এসব নির্লজ্জ, ক্ষমতালোভী ও সুবিধাবাদীরা ক্ষমতার দম্ভ, অস্ত্র দিয়ে হেলিনদেরকেই হত্যা করে। আমরা এসব শিল্পীসংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। গণমানুষের গান ও প্রাণ মুক্ত হোক এই প্রত্যাশা করি। অনেকেই জানেন ইয়োরাম পরিবেশিত জনপ্রিয় কয়েকটি গণসংগীত রয়েছে। পাঠের জন্য ইংরেজিতে ভাষান্তরিত কয়েকটি গান এখানে উল্লেখ করা হলো।
[১]
You’re in debt.
If you haven’t hold the arm of
An exhausted one;
If you haven’t solaced the hopeless;
If you haven’t given to them who calls for “Water.”;
You’re a lost case, my brother.
To the wrinkles on your forehead,
To the blaze in your eyes,
You owe to the life itself.
If you haven’t said ‘May it be easy!’
To the laborers that crush the rocks;
If you’ve left them without a ‘Good morning!’,
The ones that adorn gardens;
You’re a lost case, my brother.
To the wrinkles on your forehead,
To the blaze in your eye,
You owe to the life itself.
If you haven’t felt the urge, in your heart,
To attend to the manifestations with banners,
And to the strikes with halays,
Like love;
You’re a lost case, my brother.
To the wrinkles on your forehead,
To the blaze in your eye,
You owe to the life itself.
A mountain song
Now, your path is through loneliness;
You’re walking on the snow, hopeless.
Without humans, without warmness
You’re in the cruel wilderness.
Oh my darling, my friend, my sibling
Now, surround the mountains.
Oh my darling, my friend, my sibling
Your breath is among the clouds.
Mounts and stones are your sweethearts,
And famished wolves await below.
You on the mountains, me in the dungeons;
We are not alone.
From a valley, to another one
Upon a yellow cloud;
Smile at your country
With tweeting bullets.
Shall be the revolt.
My friend who (warms/washes)
his/her forehead with a mountain fire,
who washes his/her forehead with blood.
The maroon rose that smiles on your lips
shall be the revolt that stirs up my heart.
The silence that grows roaring
in your quiet chest,
one day, in my hand,
shall be the Mauser that’s ready to burst.
Rest your head on my shoulder.
Let me carry you in my chest.
Let my chest be the life for yours.
Wake up Berkin
His mustache incipiently grow
His young age stucked darks
Resist Berkin
there is much time for morning, much time for morning…
Resist
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up Berkin, wake up Berkin wake up
Wake up, wake up Berkin wake up
Your body has been melted while you
Your dreams has been withered in yourself
Hunger wolf’s full teeth has got a bread, in full teeth, in full teeth
wake up
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up Berkin, wake up Berkin wake up
Wake up, wake up Berkin wake up
The death has set a place in your heart
Has set sleep in to your dark ayes
A mother has cried next to your body, cried, cried… Resist
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up Berkin, wake up Berkin wake up
Wake up, wake up Berkin wake up
You’re a sapling into community’s heart
You’re our Berkin Elvan
Your case will be done untill the sun rise,
untill the sun rise, untill the sun rise, believe
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up, wake up, wake up Berkin, wake up
Wake up Berkin, wake up Berkin wake up
Wake up, wake up Berkin wake up
(২)
Ciao Bella
See, one morning when I awakened
Ciao bella, ciao bella, ciao bella
Ciao, ciao, ciao…
My homeland which I found its hands tied up
Is under occupation all around
My homeland which I found its hands tied up
Is under occupation all around
You, the Partisan
Take me also with you
Ciao bella, ciao bella, ciao bella
Ciao, ciao, ciao…
Take me also with you up to your mountains
Can’t stand the captivity
Take me also with you up to your mountains
Can’t stand the captivity
If I die in a partisan way
Ciao bella, ciao bella, ciao bella
Ciao, ciao, ciao…
You must bury me with your own hands
With your own hands in your own land
You must bury me with your own hands
With your own hands in your own land
The sun is going to rise
The flower is going to bloom
Ciao bella, ciao bella, ciao bella
Ciao, ciao, ciao…
All passers-by will say “hi”
Hi, you beautiful flower
All passers-by will say “hi”
Hi, you beautiful flower
(৩)
Dağlara Gel
If something bad happens to you, dear
to mountains, come to mountains
it hides you, doesn’t turn you in, dear
to mountains, come to mountains
since my soul fell in love, dear
since it was cooked by the fire of love
green mountains have been full of violets, dear
to mountains, come to mountains
gevheri, fell upon tongues, dear
to the foreign lands
by god, i don’t give you to others
to mountains, come to mountains
May 1
What the days bring with is oppression, cruelty and blood;
But this can’t go on, the exploitation won’t continue;
A new life will arrive; here and everywhere
May 1, May 1, the celebration day of workers,
Of peoples advancing on the glorious road of the revolution
A new sun will rise from the top of the mountains,
A happy life will sprout from the horizons of the struggle,
The happy days of my country are surely coming
May 1, May 1, the celebration day of workers,
Of peoples advancing on the glorious road of the revolution
Don’t let people get deceived and silenced,
Educate the masses for them to take what’s their right,
The bright days are in our hands
May 1, May 1, the celebration day of workers,
Of peoples advancing on the glorious road of the revolution
The loud voices of nations are shattering the earth and the sky,
The callus fist of peoples hits like a sledgehammer,
Glorious wave of revolution swashes over our world
The day will come when tyrants will go away,
Melting away like paper on the glorious road of the revolution.
(৪)
One morning I woke up
Goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
one morning I woke up
and I found the invader.
Oh partisan take me away
goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
oh partisan take me away
that I’m feeling like dying
And if I die as a partisan.
goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
and if I die as a partisan
you must bury me
You will bury me over there, on the mountain
goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
you will bury me over there on the mountain
under the shadow of a wonderful flower
And all the people passing by
goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
and all the people passing by
will say “what a wonderful flower!”
And this is the flower of the partisan
goodbye my Beautiful, goodbye my Beautiful,
goodbye my Beautiful, goodbye
dead for our freedom
and this is the flower of the partisan
dead for our freedom.
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS