ইচ্ছেশ্রাবণ ৩ || বিধান সাহা

ইচ্ছেশ্রাবণ ৩ || বিধান সাহা

অকারণ বসে আছি। ভররাত জেগে থেকে একটু আগেই ঘুমাতে গেল একজন। দূরে কোথাও শব্দ হচ্ছে। একজন গতকাল বিগত স্মৃতিকে উসকে দিয়েছিল। সেই থেকে মনখারাপের মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে বেলা। বারান্দায় রোদ এসে পড়েছিল একটু আগে। এখন বৃষ্টি। যে-জীবনে বৃষ্টি আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে উঠত, আজ সেই বৃষ্টিকেই মনে হলো দস্যু। মনে হলো, পৃথিবীর ছাদ ফুটো হয়ে গেছে। কিংবা, পৃথিবী নিজেই কেঁদে যাচ্ছে অবিরাম। তবু মাঝে মাঝে মানুষের দস্যিপনা যেমন ভালো লাগে, আমারও তেমন ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, অবিরাম ভিজে যাওয়া কাঠমালতির ওই পাতা কিংবা ফুলটা আমি। কাঠমালতি ফুল দেখলেই আমার মনে হয় এটা একটা ভুল ফুল। নাম কাঠমালতি অথচ কী শুভ্র, কী নরম! জগতে ভুল কী? সঠিক কী? একা একা ভালোবেসে ব্যর্থ হওয়া ভুল? ছয় বছরের প্রেমিক, নাকি ষোলো বছর একান্তে ভালোবেসে যাওয়া মানুষ? লাভ ম্যারেজ নাকি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ? মালোপাড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এসব জিজ্ঞাসা শুনে নিধুকাকা বলেছিল — ‘বুঝলি বাবু, ভুল বলে কিছু নেই, জীবনের দিকে সবই একেকটি পদক্ষেপ মাত্র!’

এই যে বিয়ে; এর আনুষ্ঠানিকতাকে ব্যাপক একটা উৎসব বলেই মনে হয় আমার। ফলে উৎসবকে আরো বেশি উৎসবমুখর করে তুলতে পারাটাও নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর মতোই অ্যান্টিপ্যারালাল।

ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন — ‘বিবাহ কি আজো আর তেমন ঘটনা?’ আমার তো ঘটনাই মনে হয়।

০২.
এটা ভালো হয়েছে যে বিয়েটা অন্তত প্রেমের না। আমাদের মফস্বল এলাকায়, একটু অনুন্নত মানসিকতার অভিভাবকেরা এখনও প্রেমের বিয়েকে একটা ‘সম্মানহীন ব্যাপার’ বলে মনে করেন। তখন দেখা যেত, মেয়ের মা গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। বাবা কথাও বলছেন না। মেয়ের বোন ও বোনজামাই ‘অগত্যা মধুসূদন’ টাইপের আচরণ করছেন, আর ভাই-ভাইবউ রেগেমেগে বাড়ি ছেড়েছেন। তার চেয়ে এটা ভালো, যে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ক্ষেত্রে আপনি বাঘ হয়েই হরিণ শিকারে যেতে পারবেন।

০৩.
জি, একধরনের মেয়ে আপনি আপনার চারপাশে বহু দেখতে পাবেন। হাইলি এডুকেটেড, স্মার্ট এবং দূর থেকে যাদেরকে খুবই পার্সোনালিটি সম্পন্ন মনে হবে। কিন্তু কাছে গেলে, ক্রমাগত মিশতে মিশতে আপনি বুঝতে পারবেন কাশবন দূর থেকেই কেন ঘন মনে হয়। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে হয়তো আবিষ্কার করবেন ইনডিসিশনে ভোগা মানুষ হিসেবে। এই বলবে লাল পছন্দ; পরক্ষণেই বলবে, উঁহু, নীল। কিংবা যখন দেখবে যে নিজেরই ফাঁদে সে প্রকৃতই আটকা পড়ে যাচ্ছে, তখন বাবা-মা’র দোহাই দিয়ে পুরনো দিনের গান ছেড়ে দেবে। বনবেড়াল ও বাঘ দেখতে প্রায় একই রকম। আপনাকে জাস্ট আবিষ্কার করতে হবে কেনবেড়ালকে বাঘের মাসি বলা হয়।

০৪.
বিয়ে উপলক্ষ্যে একটি স্মারক টিকেট উন্মোচন, কয়েকটি নিবেদিত কবিতা পাঠ, শুভদৃষ্টির সময় সকলের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কন্যাকে আলগোছে চোখ মেরে ততোধিক বিস্মিত করে দেয়া — এসবই অপত্য স্নেহের মতো পরিকল্পনায় থাকছে। এর বাইরে বন্ধু ও বন্ধুনীদের রসিকতার বিপরীতে চৌকশ উত্তরের পাশাপাশি, ‘কাজরা মোহাব্বতওয়ালা, আখিও মে এসা ঢালা…’ গানটা চলতে পারে। গোঁফ দেখিয়ে শিকারী বেড়াল চেনানোর এর চেয়ে সহজ পদ্ধতি আর কী-ইবা আছে! তবে এসব ক্ষেত্রে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন যে, ওই ভিড়ের ভেতরও গোপনে গোপনে কেউ ইস্কাপনের টেক্কা আর কেউ হরতনের বিবি সেজে বসে আছে! যদি থাকে বন্ধুর মন গাঙ সাঁতরাইতে কতক্ষণ লাগে, গোঁসাই?

০৫.
বেশ কয়েকবার বেড়ালের প্রসঙ্গ চলে এসেছে। অথচ আমি ডাকাতের কথাও বলতে চেয়েছিলাম। সেই ডাকাত, সকলকিছু লুট করে নেয়ার সাপেক্ষেই যে ক্রমশ নায়ক হয়ে ওঠে। যার তেজে ও তর্জমায় ঝড় ওঠে, অন্ধকার হয়ে যায় চারপাশ। ডাকাত সম্পর্কে আমার যা ধারণা, এখানে তা প্রযোজ্য নয়। ডাকাত এখানে সাধকের প্রতিনিধি। শরীর ও শীৎকারের। প্রসঙ্গক্রমে এখানেও এসে পড়তে পারে নদীর কথা, অনভিজ্ঞ পথিকের কথা। গন্তব্য নির্দিষ্ট থাকলে পথ একটা মামুলি অনুঘটক মাত্র! এবং শোনো, জগতের সকল পথই একইসাথে বন্ধুর এবং রহস্যময়! তবু চেনা পথ ভুলে গেলে আমরা অন্ধকারে পড়ে যাই। হা-হুতাশ করি। এবং ঠিক তখনই আক্ষেপের সাথে মনে হতে পারে, জীবন মানেই জি বাংলা! এই যে আলো, আকাশ, মানুষের মুখরতা… সম্ভবত মানুষই একমাত্র প্রাণী যে শব্দ করে হাসতে পারে। সেই হাসির শব্দে উঠোন জুড়ে জ্যোৎস্না ভেসে যায়।

এত-যে আলোকসজ্জা, মুহুর্মুহু মঙ্গলধ্বনি, অবারিত আনন্দ-স্রোত… শোনো, আমি পেয়ে গেছি সুবর্ণগোলক! পেয়ে গেছি, জিয়নকুয়ো — বিশল্যকরণী। গোপনে জেনেছি, শ্রী মানে সুন্দর!

আজ থেকে তবে বিদায় হে বিষণ্নতা, বিদায় উড়াল-মেঘ, সবুজপাখি, সূর্যতপা। বিদায় এপ্রিলের দুপুর। বিদায় তেরোই জুন — ফেব্রুয়ারির কুড়ি। শহুরে সার্টালিন, বিদায়। বিদায় প্রিয়তম শহর — পদ্মার তীর। বিদায় হে অহেতু আকাঙ্ক্ষা। বিদায় গোপন ক্ষত — শোনো, জীবন নানাভাবেই মিস্ট্রিক! ওগো গুঞ্জরিয়া পাখি, বাঘ ও বকের গল্প আমি ভুলে গেছি। ওগো নিমিলিত বায়ু, জানি না স্বার্থের ভেতর কীভাবে উঁকি দেয় ব্যাংক ও বীমার জীবন! ক্ষমা করো। আমাকে ক্ষমা করো হে বিষণ্ন-বরফ! আত্মজাকে এখনও মাতৃ জ্ঞান করি! ক্ষমা করো লাল কৃষ্ণচূড়া — সুধাময়ী। ক্ষমা করো দুপুরের রোদ। আমার অনেক অনেক ব্যর্থতায় প্রলেপ লাগানো কাননবালা — ক্ষমা করো। ক্ষমা করো রেহনুমা — আমার হীরামন পাখি!

হৃদয়ের টাটকা শিমুল নিয়ে, আজ, এই যে, রক্তাক্ত আমি পথে নেমেছি। ওগো চিরজীবনের ছায়া, ওগো শ্রী, আমাকে গ্রহণ করো, গ্রহণ করো!

যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম!
যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম!!

প্রচ্ছদ : অসীম দাস

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you