ইচ্ছেশ্রাবণ ৬ || বিধান সাহা

ইচ্ছেশ্রাবণ ৬ || বিধান সাহা

ঐশ্বরিক আলস্য পেয়ে বসেছে। স্বপ্ন দেখা পেয়ে বসেছে।

আমার যখন যা হয় তখন তা ঝড়ের বেগে হয়। আলস্যও তেমন। যখন পেয়ে বসে তখন আমিই রাজা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমনটা বহুদিন পরে হলো। বছর বারো তো হবেই!

প্রকাণ্ড একটা স্পেস তৈরি হয় বুকের ভেতর। ভীষণ গতির এক চৌকস ম্যাজিশিয়ান যেন আঙুলের কোমল ইশারায় শান্ত করে দিচ্ছে চরাচর। সম্রাটীয় গর্বে যেন জয় করে চলেছে রাজ্যের পর রাজ্য।

যেন আমিই সয়ম্ভু! বৃষ্টি, সে-ও আমি। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া পাতা, সে-ও আমি। আকাশ, মাটি, জল, আগুন, বায়ু — সবই এই আমি।  বায়ুশাসিত এক ভ্যাকুয়ামে খেলা দেখিয়ে চলেছি আপন মহিমায়।

গতকাল দুপুরের খাবার শেষে ভাতঘুমের আশায় শুয়ে ছিলাম। একটা চমৎকার কল্পনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল : রাজশাহীর তাপসী-রাবেয়া হলের সামনে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি ও-পাশের পুকুরের দিকে। কী দারুণ সবুজ চারপাশে! গিয়ে, চুপচাপ বসে, তাকিয়ে দেখি ওপারের বৃক্ষবাগানটা তুষারে ঢেকে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, পুকুরের ওইপারে অন্য একটা দেশ। শৈশবে দেখা কোনো ভিউকার্ডের মতো রোমাঞ্চকর! আর বাগানটার ওইপাশ দিয়ে চলে গেছে একটা বিরহী রেললাইন। মনে হলো, এই গরমে ওপারে তুষারপাতের ফলে একটা শীতল বাতাস এসে মিশে যাচ্ছে। পুকুরের জল কী দারুণ স্থির! ভাবতেই ভেতরে একটা প্রশান্তির স্রোত বয়ে গেল।

আমি সেই শান্তিটুকু নষ্ট না করার লোভে আর লিখতে বসি নাই!

আমার আজকাল এমন হয়। খুব হয়। জীবন যখন নিজের কাছেই অচেনা হয়ে ওঠে তখন সকলের কী হয় আমার জানা নেই, কিন্তু আমি অস্থির হয়ে উঠি। মনে হয়, এই মুহূর্তেই আমাকে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করে উঠতে হবে। তখন নিরুপায় হয়ে আমি শান্তি খুঁজি সব জায়গায়। বুঝতে পারি যে জীবন অনাকাঙ্ক্ষার বেড়াজালে আটকে পড়েছে। এই জাল ছিন্ন করতে হবে। করতেই হবে।

আমি জানি, একদিন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমি জানি, একদিন হয়তো পৃথিবীর দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু তার আগে এই অসমাপ্ত লেখাটা শেষ করে উঠতে হবে।

শেষ যেবার রাজশাহী গিয়েছিলাম, তাপসী-রাবেয়ার সেই পুকুরের পাশে বসে মনে হয়েছিল, তুষারে-ঢেকে-যাওয়া বাগান থেকে হাল্কা একটা হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। মনে হয়েছিল, বাগানের ওপারের রেললাইন ধরে, অসংখ্য শান্ত আর কেতাবী লোকজন নিয়ে নীরবে একটা রেল কু-ঝিক-ঝিক আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে দূরের কোনো ইস্টিশানে। আমি চোখ বন্ধ করে সেই কু-ঝিক-ঝিক সুর আর তুষারঠাণ্ডায় আচ্ছন্ন হতে থাকি।

ঠিক তখনই হঠাৎ একটা ফোনের রিঙটোনে সম্বিৎ ফিরে পাই। দেখি পাশেই এক অভিমানী মেয়ে। মুখ আশ্চর্য মেঘকালো করে বসে আছে। সেই মুখটাই ছিল পৃথিবীর আশ্চর্যতম অভিমানী মুখ!

সম্ভবত মেয়েটার প্রেমিকের আসার কথা ছিল। না-আসায় তার মনখারাপ হয়েছে। তার মুখের সেই বিষণ্নতা, অভিমানে কেঁপে ওঠা ঠোঁট, রাগে গজ গজ করতে করতে আনমনে ঘাস টেনে ছেঁড়া, এসব এখনও খুব মনে পড়ে।

কোন ডালে পাতা তুই, কোন ডাল তুই ও-পাতার!

প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you