অঞ্জনের খোঁজাখুঁজি || সৈয়দ ফারহাদ

অঞ্জনের খোঁজাখুঁজি || সৈয়দ ফারহাদ

অঞ্জন দত্ত ‘নাগরিক লোকগান’-কে একটি প্রতিষ্ঠিত ধারা হিসেবে দাঁড় করানোর জন্যে ব্যান্ডসংগীতের এই চলমান আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। গৎবাঁধা বাংলা আধুনিক গান থেকে বেরিয়ে খুঁজে ফিরছেন নিজের পরিচয়, শেকড়বাকড়। তিনি পরম মমতায় ছুঁতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছোট-ছোট সুখদুঃখগুলো। ‘আনন্দভুবন’-এ দেয়া এই একান্ত সাক্ষাৎকারে আমরাও তেমনি মমতায় ছুঁতে চেয়েছি অঞ্জনের নিজের শেকড় খুঁজবার প্রয়াসটাকে।

আধুনিক বাংলা গানের সমকালীন ধারা নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাইব।

অঞ্জন : সুমনের গানের নতুন ধারাটা সুমন জনপ্রিয় করতে পেরেছেন। তার আগে, আমি অন্তত যতটুকু জানি, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ বলে একটি দল প্রথম গৎ ভেঙে এ-ধরনের কাজ করেছে। তারও আগে কাজ হয়েছে, সলিলবাবু করেছেন, অন্যরাও করেছেন, কিন্তু বাংলা গানের ‘চিন্তা’টা আমার মনে হয়, ’৯০-তে এসে ’৯০-এর মতন হলো। আধুনিক কবিতার জায়গায় গেল। তার আগে আধুনিক কবিতার সাথে বাংলা গানের সম্পর্ক ছিল না। তখনো বাংলা আধুনিক গানের ভালো গায়ক ছিলেন, সুরকার ছিলেন, কিন্তু গানটা আধুনিক ছিল না। আমাদের সাহিত্য আধুনিক, সিনেমা আধুনিক, থিয়েটার আধুনিক… অর্থাৎ আমি সুনীল গাঙ্গুলির উপন্যাস পড়ছি, আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতা পড়ছি, আমি সত্যজিৎ রায়ের ছবি বা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা দেখছি, আমি ‘বহুরূপী’ ‘নান্দীকার’-এর নাটক দেখছি, কিন্তু গানটা, সেই চিন্তায় সে-জায়গায় ছিলোনা। সংগীতটা অনেক পরে আধুনিক হয়েছে। সচেতন যে কবিতা, সেই চরিত্র পেয়েছে। এখন এগুলো খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে।

এখনকার আধুনিক বাংলা গানে সমকালীন সমাজের কথা থাকতে হবে, থাকতে হবে কাব্যময়তা — এটাকে কি আপনি এসেনশিয়্যাল মনে করেন?

অঞ্জন : হ্যাঁ — মানে, চিন্তাটা অনেক আধুনিক। যেমন — ধরুন, ‘নবান্ন’ হবার আগে থেকে যেটা ঘটেছিল আমাদের থিয়েটারে, সেটা সে-সময়ের জন্য ঠিক আছে। এই ঊনিশ শতকের থিয়েটারের মাপে সেটা অনেক বড় থিয়েটার ছিল, গিরিশ ঘোষের থিয়েটার, তখনকার দিনের জন্য ঠিক ছিল। কিন্তু ‘নবান্ন’ হবার পর প্রথম সেটা সমকালীন হলো। আধুনিক গানের ব্যাপারটা ঠিক সে-রকম, আমাদের গানে এই আধুনিক, সমকালীন এই চিন্তাটা এখন এসেছে — সুমনের গান আমাদের বাংলা গানকে সেই আধুনিকতা দিয়েছে। আর কাব্যময়তা অবশ্যই একটা এসেনশিয়্যাল কোয়ালিটি, তবে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমার তা-ই মনে হয়, চিন্তাটা আধুনিক হওয়া দরকার।

ইন্সট্রুমেন্ট বাজানোর স্টাইল বা কৌশল এবং অন্যান্য যান্ত্রিক বা কারিগরি সৌকর্যনির্ভর ব্যান্ডগুলোও কি যথেষ্ট আধুনিক?

অঞ্জন : আধুনিকতা তো শুধু ইন্সট্রুমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন বা গায়কীতে নয় — এখনকার যে জীবন, তাকে কথায় ও সুরে পিকচারাইজ করা, তুলে ধরাটাও আধুনিক চিন্তা — আমি কথা ও সুরের আধুনিকতার কথা বলছি। আমরা যারা গান করছি, আমরা আজকের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছি।

এই ধারাটি কি ‍সুমন চট্টোপাধ্যায় এস্টাবলিশ্ করেছেন?

অঞ্জন : সুমন এটাকে জনপ্রিয় করেছেন। আধুনিক গান তো এখানে সুমনের আগেও ছিল। এখানে আজম খান তো গেয়েছিলেন, লাকী আখান্দও গেয়েছিলেন।

ওদের গান (আজম, লাকী) ও সুমনের গানের মধ্যে ভেদটা কোথায়?

অঞ্জন : আমি শুনেছি ওদের গান, যদিও ‍খুব কম শুনেছি — আমি মনে করি ওদের গানও আমরা যে গান গাইছি, তারই একটি ধারার মতো। একটা লোক গিটার বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইছেন, সেই তার একটা তো ধারা আছে। এই পারফর্মেন্স … আজম খান কথা বলছেন, গান গাইছেন, গিটার বাজিয়ে, তিনি স্টেডিয়্যামে গ্রোগ্রাম করছেন, ডেফিনিটলি আজম খান বাংলা গানের একটা ধারা তৈরি করেছেন, এটা একটা ধাপ।

বাংলা গান কি চরিত্রের দিক থেকে অনেক বেশি আবেগী?

অঞ্জন : এখনো বাংলা গান অনেক সফ্ট, সেটা এই ধারার জন্য। আগে যে-ধারাটা ছিল এ-ই যে সলো আর্টিস্টরা নিজেরাই গান লিখে সুর দিয়ে নিজেই গাইছেন, যেমন আজম খানের ব্যাপারটা — তার আগের গানগুলোয় কিন্তু পৌরুষের অভাব ছিল।

ষাট হতে আশির দশক পর্যন্ত, — ব্যান্ডসংগীত ছাড়া, — আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন?

অঞ্জন : তখন যারা গাইতেন তারা ভালো ভোকালিস্ট ছিলেন। তারা গানের কথা নিয়েও চিন্তা করতেন না। তাদের যে-গান দেয়া হতো, তারা তা-ই গাইতেন এবং সেই আবেগের যে-রকম সুর হতো তারা তেমন করেই গাইতেন। আলাদাভাবে বা এখনকার আধুনিক বাংলা গানের যে এক্সপ্রেশ্যান সেভাবে গাননি। যতীনবাবু সলিলবাবুর কথা ও সুর, মান্না দে-র কণ্ঠ, সবই ভালো, সলিল চৌধুরী কিছুটা নতুন, আধুনিক ধারা আনবার চেষ্টা করেছেন।

ইদানীং বাংলা গানের লিরিকে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমাদের আধুনিক বাংলা গান এখন প্রায়ই সমাজসচেতন; বক্তব্যপ্রধান গান হচ্ছে। কবিতার মতো গানও তো এখন বিভিন্ন স্বাদ ও মেজাজের হচ্ছে।

অঞ্জন : মিলেমিশে আছে, আমার মনে হয়, আলাদা আলাদা না। আমি অনেকের গানই শুনেছি। অসম্ভব ভালো প্রেমের গান আছে, আবার ‍খুব সমকালীন বা আজকের সময়ের প্রব্লেমগুলো নিয়েও গান আছে, আলাদাভাবে আমি দেখিনি। বেশি রাজনৈতিক কি না আমি দেখিনি। … আমি রিলেট করি, মাকসুদের গানের সঙ্গে, আমি পার্সোনালি খুব রিলেট করতে পারি। আমার অসুবিধা হয় না কোনো।

আপনার নিজের গানকে আপনি কি বলবেন? এটা কি জীবনমুখী গান না সমাজসচেতন গণসংগীত?

অঞ্জন : আমি ‘নাগরিক লোকগান’ গাই। আর পলিটিক্যাল ফ্লেভার তো চলে আসবেই, আজকার কমেন্টস্ তো অটোম্যাটিক্যালি চলে আসে। সমাজ তো খুব বেশি ইম্পর্টেন্ট — ডেফিনিটলি ইম্পর্টেন্ট — আর জীবনমুখী বলা ওটা তো একটা লেবেল দেয়া হয়েছে। নচিকেতার ক্যাসেটে এ-ধরনের লেবেল প্রথম রাখা হয়। কিছু করার নেই। আমি এ নিয়ে কোনো ইয়ে —  [সমস্যা] দেখি না — আমি আছি আমার গান নিয়ে। … আমার গান জীবনমুখী কি না জানি না, … আবার কেউ বললে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই যে, কেউ যদি বলে, নগরবাউল, কেউ জীবনমুখী, কেউ আধুনিক বাংলা গান, কেউ নগরপল্লিগীতি … যেটাই হোক …

আপনার কি মনে হয় না যে এভাবে ধীরে-ধীরে একটা টার্ম তৈরি করার চেষ্টা চলছে — নগরবাউলই বলি আর নাগরিক লোকগানই বলি, এটাকে একটা ধারা হিসেবে দাঁড় করার জন্যে?

অঞ্জন : হ্যাঁ, তা তো বটেই, কিন্তু প্রত্যেকেই কনশাসলি কেন করছি তার কারণ, আধুনিক বাংলা গানের যে যুগটা ছিল, এই যেমন হেমন্ত, মান্না দে — তাদের চেয়ে আমরা আলাদা। অথচ আমরাও আধুনিক বাংলা গানই করছি। কাজেই এ-ধরনের টার্মটা আসলে ওই ধারার একটা আইডেন্টিটি। কারণ সেই আগের ট্রেন্ডটা এখনো চলছে তো, যেমন ধরুন, হৈমন্তী শুক্লা — এখনো গাইছেন। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করবার জন্যই এই ধরনের টার্ম ব্যবহার করা।

Anjan-Dutt-3অনেকেই ব্যান্ডসংগীতের চড়া মেজাজের সুর ও আওয়াজ পছন্দ করেন না। অনেকে এর সাথে জড়িত শিল্পী ও ভক্তদের নেতিবাচক প্রভাব ও জীবনযাপনের ওপর কটুক্তিও করেন। অনেকেই বলে থাকেন যে, ব্যান্ডসংগীত এক-ধরনের অপসংস্কৃতি। এ-ব্যাপারে আপনার কি মতামত?

অঞ্জন : আমার মনে হয়, অপসংস্কৃতি হচ্ছে, যেটার মধ্যে কোনো কালচার নেই। মানে সাব-কালচারাল। অসম্ভব স্থূল, … ভালগার, চিপ, ক্রুড একটা জিনিস, … কিন্তু আমি এখানে যে-গান শুনেছি, আমার কাছে অসম্ভব উন্নতমানের মনে হয়। আমার মনে হয় যে, অ্যাজ অ্যা মিউজিশিয়্যান — এরা অসম্ভব ভালো, অসম্ভব বড়মাপের মিউজিশিয়্যান এবং তাদের লেখা, কথা, গান, অনেক বেশি আধুনিক। এখন, আধুনিকতা যদি অপসংস্কৃতি হয়, তাহলে তো সেটা অন্য প্রশ্ন। আমরা ক্রমশই আধুনিক হচ্ছি। আমরা এক্সপোজড্ হচ্ছি, আমরা অনেক চ্যানেল দেখছি, অনেক বেশি জানছি, এটা-ওটা, হাজারটা ইনফ্লুয়েন্স কাজ করছে। আমরা কি সেই ইনফ্লুয়েন্সগুলো অস্বীকার করব টোটালি, না অন্ধ হয়ে থাকব, আমরা নড়বোনা-চড়বোনা, রাবীন্দ্রিক যুগের মানুষ তাই আমরা ওইভাবেই সাবেকী থাকব, না আমরা এসব অ্যাবজরভ্ করে নিয়ে, আমাদের জায়গা থেকে দাঁড়াব? আমার মনে হয়, আমরা সেটা অ্যাবজরভ করে নিয়ে আমাদের মতো করে নিচ্ছি — এটাই আমাদের সার্থকতা; এবং এখানে ব্যান্ডসংগীতে চড়া মেজাজের গান হতেই পারে, আজকের যুগের সাথে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে, এরকম হতেই পারে। আমার তো খুব গর্ব, ধরুন কলকাতাতে এ-ধরনের গান শুরু হবার পর, এখনকার জেনারেশনের ছেলেরা হিন্দি পপ্ বা সিনেমার গানের চাইতে এসব গান বেশি শোনে। এটা আমার কাছে অনেক গর্বের যে, তার বাংলাদেশের ব্যান্ডের গান শোনে, ব্যান্ডের গান বাজিয়ে তারা নাচছে, আমার কাছে মনে হয়, এটা একটা বড় পাওয়া। এটা হারনো নয়। এটা পাওয়া। ব্যাপারটা শুধু এটাই না যে — ঠিক আছে, আগে হিন্দি গান বাজিয়ে নাচত, এখন বাংলা ব্যান্ডের গান শুনে নাচছে, বাংলা গান হিন্দি গানের জায়গা নিয়েছে, তা নয় — আমি মনে করি, আসলে এই যুবসমাজ, এই তরুণরা আধুনিক হচ্ছে তো, তাদের মতন করে [গানের ভাষা] তারা পাচ্ছিল না কিছু , যেটা পেয়েছে সেটা হলো, এই ব্যান্ডসংগীত — এই ব্যান্ডসংগীতই তাদের জায়গা, তাদের মেজাজ, তাদের ভাবনা, তাদের ভাঙা, তাদের এগোনো, … আমি কখনোই সেটাকে অপসংস্কৃতি বলব না।

আপনার ওপর বব ডিলানের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে কি?

অঞ্জন : হ্যাঁ, আছে। ওনার কবিতা তো অসম্ভব পাওয়ারফুল। বব ডিলান তো আসলে কবি, গায়কের চাইতে বেশি কবি।

আপনার গানে নিজের রুট বা শেকড়বাকড় খুঁজবার একটা ব্যাপার আছে। আপনি কি আসলেই আপনার গানে আপনার শেকড় খুঁজছেন?

অঞ্জন : হ্যাঁ। কারণ আমিও খানিকটা রুটলেস। আমি সাবেক বাঙালি সমাজের সাথে যুক্ত ছিলাম না। আর গানেও আমি সেটাকে রিলেট করি বেশি, … একটা গল্প যখন লিখি তখন সেই গল্পটা থেকে একটা জায়গায় পৌঁছুনো, যেখানে আমি দর্শক-শ্রোতার সাথে রিলেট করব, আর এভাবেই আমার চারপাশের জগতের সঙ্গে রিলেট করতে পারব।

সেই রুটটা কোথায় খুঁজছেন? সেটা ক্যারেক্টারের মধ্যে, নাকি তার যন্ত্রণাকে নিজের মধ্যে ফুটিয়ে —

অঞ্জন : না, আমি ঠিক সেইভাবে না — আমি শুধু তার যন্ত্রণাকে, দুঃখটাকে বোঝবার চেষ্টা করছি আর-কি। তার হারানোটা, সে হারাচ্ছে কোথায়, বেসিক্যালি এইগুলো …

ব্যাপারটা কি এ-রকম যে, আপনি যখন আপনার লিরিকে একটা গল্প সাজাচ্ছেন তখন সেই ক্যারেক্টার ও ঘটনার ভেতর দিয়েই নির্দেশ করছেন আপনার রুটটা কোথায়?

অঞ্জন : হ্যাঁ, অনেকটা তা-ই।

আপনার অভিনয়সৌকর্যের চেয়ে বরঞ্চ বাংলা আধুনিক গানের বদৌলতেই আপনি সাধারণ মানুষের বেশি কাছে আসতে পেরেছেন — এ-কথা তো মানেন?

অঞ্জন : হ্যাঁ, ডেফিনিটলি।

আপনি তো শ্রুতিনাটক ‘ভালোবাসা’-য় আবৃত্তি করলেন। আপনি অভিনয় করছেন, চিত্রনাট্য লিখছেন, নির্দেশনা ইত্যাদি করছেন — গানও গাইছেন, সুর করছেন, লিখছেন। তো এতকিছুর ভেতর, আপনি কোন পরিচয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন?

অঞ্জন : আমি প্রাইমারিলি নিজেকে একজন অভিনেতা বলে মনে করি। আমি গানেও অভিনয় করছি একটু। যে-কারণে দেখবেন, আমার গানে সবসময় কিছু না কিছু চরিত্র হচ্ছি। গান লিখেও আমি একটা গল্প লেখার চেষ্টা করি আর-কি। গল্পটা কাকে নিয়ে হবে, তার বয়স কত, ছেলেটা কি করে, (ধরুন) ছেলেটা কসাইয়ের দোকানে কাজ করে — কি রকম দেখতে তাকে, আমি যে ছেলেটা হব, আম কি তাকে চিনি? নামটা কি হবে? সমস্ত ঠিক রেখে, ওই জায়গা থেকে আমি গান করি। সেটা হরিপদ হতে পারে, আলীবাবা হতে পারে, যে-কোনো একটা হতে পারে। আমি এই মানুষগুলো নিয়ে গান গাই, যেটাকে আমি ‘নাগরিক লোকগান’ বলছিলাম — এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমি যেভাবে গাই, তাতে করে আমিও খানিকটা করে অভিনেয়ের মধ্য দিয়ে যাই। কিন্তু যেহেতু গান আমাকে অনেককিছু দিয়েছে, সেটা আমি করে যাবই আর-কি। তাছাড়াও আমি সিনেমায় ডিরেকশন শুরু করেছি। তো আমি চাইব সেটা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে, যতটুকু সম্ভব।

মূলত আপনি তো একজন অভিনেতা — কার সিনেমা আপনার প্রিয়?

অঞ্জন : আমি আসলে বড় হয়েছি হলিউডের সিনেমা দেখে, সেই ষাটের দশকের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি। হিচকক আমার অত্যন্ত প্রিয় পরিচালক। আমি জাপানিজ্ ছবিও দেখেছি, কুরোসাওয়ার ছবিও আমার খুব প্রিয়। তবে হিচককই আমার ফেভারিট। আমি ইউরোপের ছবি খুব কম দেখেছি।

আপনি তো মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন — এদের ছবিতে অভিনয় করেছেন; তো, বাংলা সিনেমা সম্পর্কে আপনার কি মতামত?

অঞ্জন : বাংলা সিনেমার অবস্থা আসলে আমার মনে হয় — তেমন ভালো না, আমি এখানকার অবস্থা ঠিক বলতে পারব না, মানে কে কেমন কাজ করছেন, ব্যবসাটা কেমন চলছে। তবে ভালো ছবির খবর এখান থেকেও খুব কম পাই। ওখানে যে ছবি হচ্ছে, কতটুকু দর্শক দেখছে, গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি? কে দেখছে? ওখানে ছবিতে শহুরে ব্যাপারটা নেই, শহুরে মেজাজটা নেই, ছবি করতে হচ্ছে এক্কেবারে গ্রামের কথা বলে, (গ্রামের) কোনো ঘটনা নিয়ে এবং খুব করুণ একটা কাহিনিটাহিনি নিয়ে কোনোরকমে খুব সস্তা একটা ছবি করা হচ্ছে। ছবির যে একটা গুণগত মান বা  টেকনোলজিক্যাল ব্যাপার আছে তা নেই — আমি বলছি টালিগঞ্জের অবস্থা। ষাটের দশকেও একটা ধারা ছিল, তখন মেইনস্ট্রিম ছবি হতো। অজয় কর, আশীষ সেন … প্রচুর ডিরেক্টর ছিলেন তখন — আমি অবশ্য তাদের কথা বলছি না, আমি বলছি মেইনস্ট্রিমের কথা। যারা মেইনস্ট্রিমের ছবি করেছেন, তাদের মধ্যেও কিন্তু অসম্ভব ভালো ডিরেক্টর ছিলেন। তখনও ভালো-ভালো সব ছবি হয়েছে। সেই সময়কার (সিনেমা) এখনও দেখলে মনে হয়, ওতে ভালোমাপের কাহিনি আছে, গল্প আছে, ভালো ডিরেক্টর আছে, শিল্পী আছে, এখন কিন্তু সেই ধারাটি নেই। একটা প্যারালাল সিনেমা ম্যুভমেন্ট পূর্ববাংলায় শুরু হয়েছিলো — সেটা কিন্তু ভালো ডিরেক্টরাইজেশন পাওয়ার পর থেকে, যেমন মৃণাল সেন। কিন্তু সেইসব ছবি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন বা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি, একটা জায়গাতেই আটকে আছে। ভালো ছবি হয়েছে, অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার মতো ছবি। আমি সেই ধারাটি ধরে রেখেছি। আমি কখনো কমার্শিয়্যাল ছবিতে অভিনয় করিনি, আমি নিজে আইডেন্টিফাই করতে পারি না। কিন্তু…, একটা ওয়েভ-এর মতো হয়েছিলো হিন্দিতে শ্যাম বেনেগাল প্রমুখেরা যখন এলেন, কলকাতাতেও শুরু হলো সেটা। ভারতীয় ছবিতে এই ম্যুভমেন্টের একটা ইম্প্যাক্ট ছিল, কিন্তু তারপর তার কোনো ভবিষ্যৎ রইল না সে-অর্থে কোনো। আমার মনে হয় না যে, এই ম্যুভমেন্টন্টা খুব জোরালো কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, কোনোমতে টিকে আছে আর-কি।

এখন টালিগঞ্জে যেসব সিনেমা তৈরি হচ্ছে, তার গুণগত মান কেমন? এখন কি …

অঞ্জন : সেটা তো … আজকাল খুব খারাপ অবস্থা … এরা যারা ছবি করছেন মোটামুটি গভর্নমেন্টের টাকায়, সেগুলোও খুব-একটা ব্যবসা করতে পারছে না।  … ব্যবসাটা মূল নয়, কিন্তু ছবিটা তো দেখাতে হবে। দর্শক তৈরি করতে পারছে না, দর্শক তৈরি হচ্ছে না।

সেটা দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার অভাব নাকি মানসিকতা বা রুচির অভাব?

অঞ্জন : না, এই দুদিকের ছবির দুটো প্রব্লেম আছে। একটা হলো যে, সো-কল্ড সমাজসচেতন, মেইনস্ট্রিমের ছবি নিয়ে, একেবারে চিন্তাই করছে না। অখাদ্যর মতো, গল্প খারাপ, টেকনিক্যালি খারাপ, আর এই যে ‘ভালো ছবি করা’ বললেন, তা এতই দুর্বোধ্য, এতই সেটা মুষ্টিমেয় লোকের জন্য যে, তাদের মধ্যে একটা বিশাল ফাঁক হয়ে গেছে। মানে, (এ ‍দুয়ের মাঝখানে) কোথাও একটা মাঝামাঝি জায়গায় আসতে হবে। আমার মনে হয়, যারা ভালো ছবি করছেন, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব — তাদের কিন্তু খানিকটা তাদের জায়গা থেকে একটু সরে ভাবতে হবে দর্শকের কথা, দর্শক বাড়ানোর কথা। ভাবতে হবে দর্শকের (মনের) ওপর ছাপ ফেলার জায়গাটা। কোথাও গিয়ে টালিগঞ্জকে ইগ্নোর করে। ঠিক আছে টালিগঞ্জে খারাপ ছবি হচ্ছে, আমি ওখানে ছবি বানাবো না, আমি আমার মতো ছবি বানাবো — তো এটা তো ভালো কথা। কিন্তু কোথাও গিয়ে একটা মাঝামাঝি জায়গায় আসতে হবে তো। তাদের দায়িত্ব নিয়ে মেইনস্ট্রিম ছবিতে কাজ করতে হবে। আমার মনে হয়, প্রয়োজনে সেটার জন্য খানিকটা যদি কম্প্রোমাইজ করতে হয়, সেটা করা উচিত এই মুহূর্তেই। হৃষিকেশ মুখার্জি, গুলজার — তাঁদের সময় একটা ট্রেন্ড ছিল এ-রকম, অথবা বাংলা ছবির কথাও বলতে পারি, অজয় কর, আশীষ সেন (তাঁদের সময়েও) ভালো গান ছিল, ভালো অভিনয় ছিল, ভালো গল্প ছিল — সাহিত্যনির্ভর ছিল সেটা। সেই ধারাটাকে ধরে রাখতে না-পারলে, একেবারে বড় মুশকিল।

আপনি এপার বাংলার সিনেমা দেখেছেন?

অঞ্জন : হ্যাঁ, আমি দু-ধরনের ছবিই দেখেছি। আমি বিটিভিতে দেখেছি, ভিডিওতেও দেখেছি দু-একটা, আমাদের বাংলা কমার্শিয়াল ছবি টেকনিক্যালি হয়তো একটু বেটার — কিন্তু ওই গানটানের সিনগুলো দেখে বোঝা যায়, পয়সাকড়ি একটু বেশি খরচ হয়েছে আর-কি — কিন্তু সেইরকমভাবে আমাকে নাড়া দেয়নি। চিন্তাভাবনার জায়গা থেকে নাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের গান যতটা দিয়েছিল।

এটা কি এজন্য যে, ছবিগুলো শৈল্পিক মান বিচারে উন্নত ছিল না?

অঞ্জন : হ্যাঁ, আর তানভীর মোকাম্মেলের ছবিও আমি দেখেছি। ওর সঙ্গে (তানভীর) ছিলাম আমি আমেরিকায়, ওর সাথে পরিচয় ওখানে। আমি জানি না সেটা (তানভীরের সিনেমা) কতটা সার্থক। আমার মনে হয়েছে, খুব বেশি লোক এগুলো দেখতে পায় না। বাংলাদেশের ছবি (সিনেমা) সম্পর্কে আসলে আমি ঠিক জানি না, তবে শুনেছি যে, এখানে বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে।

9053e4f94ec146454bd11e21aff7e2e1-Untitled-2

মানুষ অভিনেতা অঞ্জন দত্তের চাইতে গায়ক অঞ্জন দত্তকেই বেশি চেনে। এজন্য কি আপনার কোনো অভিমান আছে বা আক্ষেপ?

অঞ্জন : অভিমান — না, … অভিমান বলাটা ভুল হবে। কারণ আমি দর্শকদেরও দোষ দিতে পারি না, কেননা সে-ছবিগুলো দর্শকদের কাছে পৌঁছেনি। আমি একেবারে কমার্শিয়াল ছবির জগতের সাথে নিজেকে মেলাতে পারিনি। কেননা, একটা গাছের ধারে গান গেয়ে, নেচে ছবি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে-রকম … আমি স্টার হওয়ার কথা ভাবিনি। আমি ছোটবেলা থেকে ভালো-ভালো ছবি দেখে বড় হয়েছি। আমি যেসব ছবি করেছি, যাদের সাথে করেছি, সেগুলো রিলিজ পায়নি। লন্ডনে বা অমুক-তমুক জায়গায়, বিদেশে রিলিজ হয়েছে। বিদেশে বরঞ্চ গেছি অনেক। বিদেশে অ্যাওয়ার্ড-ট্যাওয়ার্ড পেয়েছি। কিন্তু আমার দেশের দর্শক আমাকে চেনে না সেই হিসেবে। অথচ আমার গান তারা জানে। সেইটা একটা আক্ষেপ — হ্যাঁ, আক্ষেপ বলতে পারেন। আমার মনে হয়, গান যদি এত পপুলার হতে পারে তাহলে সিনেমা কেন হবে না? এটাই আমার একটা আক্ষেপ বলতে পারেন।

ওসব ছবির শিল্পমান যথেষ্টই ছিল কিন্তু দর্শক তা হয় দেখবার সুযোগ পায়নি কিংবা গ্রহণ করতে পারেনি। আর এই গ্রহণ করতে না পারার কারণ হিসেবে কি কখনো আপনার মনে হয়েছে যে, আমাদের দর্শক (বাংলা ছায়াছবির দর্শক) সিনেমার ব্যাপারে যথেষ্ট আধুনিক বা শিক্ষিত নয়?

অঞ্জন : কিছুটা। কিন্তু দর্শকদের কথা ভেবেও তো করবার আছে। এমন গান লিখলে তো হবে না যা শ্রোতা শুনছে না — তখন একটা সাংঘাতিক …

শুনছে না — সেটা কি এজন্য যে, সে ভেবে বসতে পারে যা সে দেখছে বা শুনছে তা তার সংস্কৃতির বাইরে থেকে এসেছে?

অঞ্জন : হ্যাঁ, হয়তো কম্যুনিকেট করতে পারছে না।

হঠাৎ গানে আসবার পেছনে আপনার কি কোনো যন্ত্রণা কাজ করেছিল?

অঞ্জন : হ্যাঁ। আমি অনেকদিন ধরে অভিনয় করছি, কিন্তু কিছু হচ্ছে না। কোথাও পৌঁছুতে পারছি না। আমি ছবি করে যাচ্ছি, অনেকগুলো সিনেমায় অভিনয় করলাম, থিয়েটারের কাজ, ডিরেকশনের কাজ, কিন্তু আমার মনে হয়েছে কোথাও রিচ করতে পারছি না। আমার তো দেশের মানুষকে দেখাতে হবে, কি করছি না করছি। সেইজন্যই আমার সুমনের গান শুনে মনে হলো, অনেকদিন ধরেই তো আমি গান লিখছি, গাইছি — তো, সেই ফিলিংস থেকেই আমি গাইতে শুরু করি। এটা একটা রিলেট করবার ব্যাপার। আমার একটা-কিছু তো করতে হবে। আসলে আমরা এমন একটা প্রফেশনে আছি যে, আমি তো ফিরে গিয়ে চাকরি করতে পারব না। তো এটাকে একটা যন্ত্রণাও বলতে পারেন।  দর্শকদের কাছে না পৌঁছুতে পারার যন্ত্রণা বলতে পারেন।

আপনার কি মনে হয়েছে, এ-ধরনের যন্ত্রণা প্রকাশের জন্য গানই যথার্থ মাধ্যম?

অঞ্জন : হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক সহজেই কম্যুনিকেট করা যায়।

বাংলাদেশে আসা নিয়ে কোনো গান লেখার ইচ্ছে কি আছে?

অঞ্জন : হ্যাঁ, আছে।

এখানকার দর্শক-শ্রোতাদের কি আপনার কাছে কিছুটা অ্যাগ্রেসিভ মনে হয়েছে?

অঞ্জন : না, আমি এখনো ফেস করিনি সেটা। আমার খুব ইচ্ছে আছে যে বড় জায়গায়, স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান করার। অন্য ব্যান্ডের সাথে আমি সেটা এক্সপেরিয়্যান্স করতে চাচ্ছি। হলের মধ্যে সংরক্ষিত ছোট জায়গা, একটু-আধটু লোক, হয়তো হাজারখানেক হবে। এখানে, এই সিগারেট খাবেন না, এটা করবেন না, সেটা চলবে না, এসব আর কি। একটা বড় জায়গায় অনুষ্ঠান করে, আমি রিলেট করতে চাই। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন লাগে, দেখতে চাই, আমার এখনো সেই থ্রিল পাওয়া হয়নি। এখানকার দর্শক-শ্রোতাদের বরং আমার অসম্ভব আবেগপ্রবণ মনে হয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার রেখে-ঢেকে কথা বলতে হয়নি কখনো, ভেবে বলতে হবে, এটা করো, ওটা করো, এটা বললে ভুল হবে — এসব করতে হয়নি আর-কি। যখন যা বলছি, তা অত্যান্ত সহজ-স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করছে, নিতে পারছে — এটা খুব ভালো লেগেছে আমার, চালাকি করতে হচ্ছে না … এই যে শ্রোতা আর শিল্পীর ভেতরে একটা চালাকি আছে … এখানে সেটা নেই, একেবারে নেই বলে আমার মনে হয়। এটা কিন্তু একটা অসম্ভব পজিটিভ ব্যাপার।

একজন শিল্পীর কি সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে?

অঞ্জন : একেবারেই কোনো ডিস্ট্যান্স রাখা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। (কোনো দূরত্ব) একেবারেই না-রাখা উচিত।

আপনার গানে দার্জিলিং-এর কথা বারবার এসেছে …

অঞ্জন : হ্যাঁ … আমি দার্জিলিং-এ বড় হয়েছি আর-কি। অনেকদিন ছিলাম। কলকাতায় এসেছি অনেক পরে। ফলে স্বভাবতই দার্জিলিং-এর কথা আমার গানে উঠে এসেছে বারবার, সেই মানুষগুলো আছে, মেজাজটা আছে।

কোনো প্রেমঘটিত কারণও কি এর সাথে জড়িত?

অঞ্জন : সবই। আসলে আমি ওখানে বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম। আমাকে মানুষ করেছে আমার টিচাররাই। আমি যা, যতটুকু হয়েছি — তা আমার টিচারদের কারণেই হতে পেরেছি। আমার বন্ধুরা, ওদের ভালোবাসায়, সবকিছু ওখানেই তৈরি হয়েছে। আমি অনেক পরিণত বয়সে কলকাতায় এসেছি। তখন আর কি ছাপ পড়বে, মনে যা ছাপ পড়ার তা আগেই পড়ে গেছে।

আপনি কি মনে করেন যে, আপনি ছেলেমানুষ?

অঞ্জন : ভীষণভাবে।

আপনি তো বলেছিলেন আপনি একটু ‘ক্যাবলা’ও! …

অঞ্জন : ও … সেটা তো … আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম। আমি অসম্ভব ছেলেমানুষ এবং আমি সেটা (ছেলেমানুষীটা) হারাতে ভয় পাই। কারণ এক নম্বর, আমি বেসিক্যালি খুব ইমোশনাল, এটা আমি জানি আমার বুদ্ধি দিয়ে যতটা না বিচার করি, আমার ইমোশন দিয়ে বেশি করি এবং আমি তরুণদের সঙ্গে বেশি রিলেট করি। আমার গান তাদের জন্যই লেখা এবং তারাই আমার ফ্যান। আমি যদি সেটা হারিয়ে ফেলি (তো কিছু রইলো না) । আমার কোনো ওজন তো তৈরি করি না আমি, নিজের এই ওজন বা ভার যেখান থেকে কথা বললে একটা মানে হবে। সেটা আমি তৈরি করার দিকে যাইনি কখনোই। খুব ব্যক্তিগত, খুব পার্সোনাল জায়গা থেকে আমি দেখেছি পৃথিবীকে, রিলেট করেছি আমার যা বলার। সুমনের গান বা সুমন যা (বলতে চায়) ওজন আছে তার, ভার আছে একটা। তার গান একটা কবিতা, আমার গান কবিতাই না। আমার গান — একটা গান শুধু। সে-রকম টিকে থাকার মতো নয়। আমাকে ভালো ভালো গান ক্রমশ লিখে যেতে হবে বা আমাকে কন্টিন্যুয়াসলি গান লিখতে হবে। আমার গান টিকবে না, সুমনের গান টিকে যাবে। (ওর গান) লোকে একটা কবিতার বই হিসেবেও পড়তে পারে, সে-জায়গায়, আমি যদি আমার ছেলেমানুষীটা হারিয়ে ফেলি, তো আমার আর অন্য কিছু নেই ধরে রাখার মতো। আমাকে এজন্যই (ছেলমানুষী) ধরে রাখতে হবে, ভয়ও হয়।

sm_anjan_dutta_996198474

সেটা ধরে রাখবার ইচ্ছে কি আরো এইজন্যে যে, ছেলেমানুষী থেকেই হয়তো প্রেম জন্মায়?

অঞ্জন : হতে পারে … হয়তো। আমি বলতে পারব না।

আমি আসলে বলতে চাইছিলাম, ছেলেমানুষী নিষ্পাপ বলেই কি প্রেম সুন্দর?

অঞ্জন : হতে পারে। মানে — আসলে আমার কাছে আগে মানুষ, তারপরে অন্যকিছু। মানুষ বা তাদের ছেলেমানুষী, ছোট-ছোট দুঃখসুখ, ছোট-ছোট প্রেম, ভালোবাসা, বাঁচা, স্বপ্ন … এগুলো আমাকে অ্যাট্রাক্ট করে।

প্রেম কি ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত ইম্পর্টেন্ট কিছু? আপনার গানে কিন্তু প্রেমের প্রসঙ্গ এসেছে বারবার।

অঞ্জন : হ্যাঁ, অবশ্যই এবং সবসময়। প্রেমকে আমি খুব পিওর একটা জায়গা থেকে দেখি। আমি মনে করি, মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব মানে কোনো রেস্ট্রিকশন নেই। বাবা-ছেলের সম্পর্কের মধ্যে আছে। একটা ডিম্যান্ড আছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে, বন্ধুত্বের মধ্যে তা নেই। একটা ছেলের সাথে ছেলের বা মেয়ের সাথে মেয়ের বা ছেলে-মেয়ের যে বন্ধুত্ব হয়, সেটা ডিভাইনাল সম্পর্ক বলেই আমার মনে হয়।

সাক্ষাৎকারধারণ ও গ্রন্থন : সৈয়দ ফারহাদ

[অঞ্জন দত্ত ইন্ডিয়ান বাংলা গানে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত জনপ্রিয় সংগীতকার ও শিল্পী। নিজের গানের কথা, সুর ও সংগীতায়োজন নিজে করেন। নিজেই গিটার আর স্যাক্সোফোন বাজিয়ে গেয়ে থাকেন অন্যান্য বাদ্যযোজনার সঙ্গে। অ্যালবাম রয়েছে দশটিরও অধিক। নিজের গানের একক অ্যালবাম। মূলত অভিনেতাই ছিলেন, ‘মেরা নাম জোকার’ ম্যুভিতে শিশুশিল্পী হিশেবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে অভিনয়ক্যারিয়ার শুরু অঞ্জনের, মৃণাল সেন প্রমুখ অন্যধারা ছায়াছবিনির্মাতাদের প্রোজেক্টগুলোতে এবং বাদল সরকার প্রমুখের মতো প্রথিতযশা নাট্যরচয়িতাদের কাজের সঙ্গেই ছিল অঞ্জন দত্তের আগাগোড়া যুক্ততা। বাংলা গানে এলেন হুট করেই এবং পেলেন প্রভূত শ্রোতাপ্রিয়তা। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক অঞ্জন দত্ত ১৯৫৮ সনের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ছন্দা দত্ত পেশায় স্কুলশিক্ষিকা এবং একমাত্র সন্তান নীল দত্ত মিউজিশিয়্যান হিশেবে ক্যারিয়ার শুরু করে ব্যাপক গ্রাহ্য পশ্চিমবঙ্গের সিনেমাপাড়ায়। অঞ্জন নিজেও গত দুইদশকের মধ্যে সিনেমা বানানোয় ব্যস্ত হয়েছেন এবং বানিয়ে চলেছেন একের পর এক বাণিজ্যিক বাংলা ছায়াছবি। নিজের ছবিতে এবং অন্যের ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি কালেভদ্রে প্লেব্যাক ছাড়া গানে এখন অঞ্জন দত্ত গরহাজির বললেও হয়।

এই সাক্ষাৎকারটা পাক্কা দুই দশক আগেকার। সে-বছর বাংলাদেশ ট্যুরে এসেছিলেন অঞ্জন। সম্ভবত ১৯৯৮ সনে, পয়লাবারের মতো, পরেও এসেছেন এক বা দুইবার। পয়লাবার এসে শো করেছেন কয়েকটা।  অ্যালবাম করেছেন অন্তত দুইটা, ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ নামে নিজের গানের একটা এবং শ্রুতিনাটকের একটা অ্যালবাম ‘ভালোবাসা’ বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পী নিমা রহমানের সঙ্গে। সেইবার অঞ্জনের সঙ্গে কলকাতার ব্যান্ড ‘পরশপাথর’ স্টেজ শেয়ার করেছিল। দুইটা অ্যালবামই, বিশেষত শ্রুতিনাটকেরটা, ভীষণ শ্রোতাগ্রাহ্য হয়েছিল অঞ্জনের অন্যান্য সংকলনের মতো বাংলাদেশে। এই সাক্ষাৎকার ধারণকালীন অঞ্জনের অ্যালবাম ছিল সাকুল্যে চারটা : ‘শুনতে কি চাও’, ‘পুরনো গিটার’, ‘ভালোবাসি তোমায়’ এবং ‘কেউ গান গায়’। এরপরের দুইদশকে ক্যারিয়ারে অ্যালবাম যুক্ত হয়েছে আরও অনেক, যুক্ত হয়েছে নিজের পরিচালিত ও প্রযোজিত ম্যুভি ইত্যাদি। কিন্তু অঞ্জনের মূল পরিচয়টা, বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্তত, বাংলা গানের শিল্পী হিশেবেই। ইন্টার্ভিয়্যুটাতে সেই বিষয়টাই স্পটলাইটে এসেছে। এবং এইটা আর-দশপাঁচ গড়পরতা সাক্ষাৎকার টাইপের জিনিশের চেয়ে বেশ-খানিকটা আলাদা। ফানি আইটেম নয়। বিস্তারিত। জরুরি কিছু প্রশ্ন ও উত্তরমালা আমাদের গোচর এড়াবে না এইটা পাঠকালে। এত বছর পরেও, অঞ্জনের সঙ্গে এত পহেচান হবার পরেও, পুনঃপত্রস্থ কথাচারিতাটা আজও উজ্জ্বলতর প্রসঙ্গসংলগ্ন। নতুন সময়ের বাংলা গান নিয়ে এইভাবে এই টোনে অঞ্জনকে বলিয়ে নিতে পেরেছিলেন সাক্ষাৎকারগ্রাহী, ঠিক পরের বছরগুলোতে এন্তার সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়ানোর পরেও অঞ্জনকে এখানে একেবারেই ছিমছাম সিরিয়াস পাওয়া যায় আজও। কাগুজে মুদ্রণে সেই পয়লাবারের পরে এই গুরুত্বপূর্ণ কথালোচনাটা আন্তর্জালিক পরিসরে এই পয়লা আর্কাইভড হচ্ছে। ‘গানপার’ থেকে এইধারা আয়োজন ও উদ্যোগ বজায় থাকবে ধারাবাহিকভাবে।

এইটা ছাপা হয়েছিল অনেককাল আগেই বন্ধ-হয়ে-যাওয়া  ‘আনন্দভুবন’ পাক্ষিকের তৃতীয় বর্ষশুরু সংখ্যায়। ‘সারেগারে’ শীর্ষক পত্রিকাভ্যন্তরস্থ সংগীতবিষয়ক অংশে। এটি গৃহীত হয়েছে ব্যক্তিক জনৈক সংগ্রাহকের সৌজন্যে। পত্রিকাসূত্র : আনন্দভুবন; বর্ষ ৩ সংখ্যা ১; ১৬ মে ১৯৯৮, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪০৫; সম্পাদক / গোলাম ফারুক; বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেড কর্তৃক ঢাকা থেকে প্রকাশিত। সৈয়দ ফারহাদ নিয়েছেন চমৎকার সাক্ষাৎকারটা। ‘গানপার’ থেকে আমরা সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর সাকিনপরিচয় সংগ্রহ করতে পারিনি বলে অনুমতি নেয়া সম্ভব হলো না। আশা করি ব্যাপারটা সানন্দ অনুমোদনের প্রশ্রয় পাবে সকলের। — গানপার] 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you