খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একটা কবিতাবইয়ের নাম তিন রমণীর ক্বাসিদা। সেই প্রথম ক্বাসিদা শব্দের সাথে পরিচয় আমার। আমি তখন নবম শ্রেণী।
ক্বাসিদার সবচে সুন্দর প্রকাশ পেলাম বিশ বাইশ বছর পর। আচমকা যখন গুলবাহার শুনলাম।
গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত কমসে কম ১০ বার শুনলাম। যতবার শুনলাম ততবার বিস্মিত হলাম, গানের গায়কী, সুরের সাথে সাথে বাজনা পর্যন্ত। মানে, এত অসাধারণ কম্পোজিশন! হা হয়ে যাওয়ার মতন। আর গানের কথা আমি বলব, গত বিশ বা ত্রিশ বছরে বাংলাদেশে যত গান গাওয়া হয়েছে, যত গান লেখা হয়েছে, তন্মধ্যে এ অধম যত গান শুনেছে, এই গানই শ্রেষ্ঠ। এই গুলবাহারের সাথে হয়তো রাখা যায় জেমস্ (জিকির সহ আরও অনেক গান), শিরোনামহীন আর অর্ণবের কিছু গান। মেঘদলের কিছু গানও তূরীয়। সঞ্জীব চৌধুরীর গানের কথা না বললেও অন্যায় হবে আমার।
যা বলছিলাম, ঈশান মজুমদারের লেখা এই গান। ইউটিউব থেকে নেয়া এই ইনফো। গানটা গেয়েছেনও তিনি। কণ্ঠে তার আভাস-এর তুহিন, মেঘদল-এর শিবুদা অথবা জেমসের ভেলকি না থাকাই যেন অন্য রকম ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। অন্যতর ক্লাসিক সে-ব্যঞ্জনা। কিন্তু ‘গুলবাহার’ গানের গল্পের যে চিরন্তন আবেদন, পুরান ঢাকা্র যে জীবন, লালবাজারের গলির মোড়ের পানদোকানের খরিদ্দার জনৈক এক বাকের আলীর আদুরে কন্যাকে নিয়ে যে ক্লাসিক ক্বাসিদা গড়েছেন ঈশান, তা আমার শ্রোতাজীবনের এক অলৌকিক ঘটনা। এক চূড়ান্ত ইউনিক ঘটনা। আমার মনে হয়, শুধু আমার শ্রোতাজীবনের জন্য নয় শুধু কোটি বাংলাভাষাভাষী মানুষের জন্য এক অলৌকিক ঘটনা। ইউনিক ঘটনা। কবির সুমনের তোমাকে চাই -এর মতো অবিস্মরণীয় ঘটনা বলতে চাই আমি এ গানকে, বাংলাদেশি গানের ইতিহাসে।

০২
গানটা শুরুই হয় গুলবাহারের বাবার পরিচয় প্রকাশের মাধ্যমে। মহল্লার পানদোকানের নিয়মত খরিদ্দার তিনি। নাম বাকের আলী। তার কন্যা গুলবাহার। সে অতীব রূপসী, ভঙ্গি তার কারসাজি মাখানো। মানে সে এক রহস্যনারী। তার পুরুষের কাছে। যে কারণে, প্রেমে পাগল পুরুষ নিজেকে আটকাতে পারে না। প্রেমের দরখাস্ত করে বসে সে। কার কাছে? হোসনে আর গুলবাহারের প্রতি এ নিবেদন।
তারপরের যে বর্ণনা তা প্রেমের ক্বাসিদা। প্রেম চলাকালীন প্রেমিকের নাভিশ্বাস অবস্থা হয় তারই বর্ণনা। কিন্তু এই বর্ণনায় লেখক অসাধারণ শব্দপ্রয়োগ করেছেন। অসাধারণ দক্ষতায় মুক্তোদানার মতো গড়েছেন তার ক্বাসিদা। যে কারণে কথাগুলো শুধু প্রেমে আটকে থাকে না। তা বরং পুরান ঢাকার শত বছরের জীবনযাপন, ঐতিহ্য ও তার ব্যবহারিক ভাষার কাছাকাছি চলে আসে। এখানেই এ গানের সাফল্য। এখানেই এ গান তুঙ্গস্পর্শী।
একটু উদাহারণ টেনে দেখাই ক্বাসিদালেখকের মুনশিয়ানা :
চালাক চতুর ভঙ্গিমাখা
কারসাজি তার বেজায় খুব
নাস্তানাবুদ হয়ে শেষে
প্রেমদরিয়ায় দিলাম ডুব
দরখাস্ত আদানপ্রদান
আদর-সোহাগ রাগ-অভিমান
পথেঘাটে ইনতেজার
হোসনে আরা গুলবাহার!
মুসাফিরি দিশেহারা
বান্ধা প্রেমের কাফেলায়
কেচ্ছা গজল মেহফিলে
হাঙ্গামা মাতে জলসায়
হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে
ঘায়েল করে এ আমারে
করলো প্রেমের ইশতাহার
হোসনে আরা গুলবাহার
খোশমেজাজি মন তাহার
নাজির হলো ঘুম আমার
নাম ছিল তার গুলবাহার
দেখতে ভারি চমৎকার
তুলনা যে হয় না তার
হোসনে আরা গুলবাহার

মনে হচ্ছে না, আপনি পুরান ঢাকার কোনো কাওয়ালি গানের আসর বা শায়েরির মজলিশে বসে, আপনিও হোসনে আরা গুলবাহারের প্রেমে মজেছেন! আর ভাবছেন, শামসুর রাহমাানের মাতুয়াইলা রাতের কথা। কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা কোনো গল্পের কথা। যেখানে পুরান ঢাকার গলিঘুপচির ভিতর দিয়া উঁকি দেয়া চাঁদও ভাষা পেয়ে যাচ্ছে।
আস্তা লা ভিস্তা, ঈশান! আপনার সংগীতজীবন আমাদের জন্য অহঙ্কারের কারণ হোক।
গানের লিঙ্ক : গুলবাহার
০৬ জুলাই ২০২৫
গান শুনি কিস্তিগুলা
বিজয় আহমেদ রচনারাশি
- ১১ হাইকু মাৎসু বাশো || বিজয় আহমেদ - July 21, 2025
- গুলবাহারের ক্বাসিদা || বিজয় আহমেদ - July 11, 2025
- শহীদ কাদরীর দেশে || বিজয় আহমেদ - April 13, 2025

COMMENTS