মোশাররফ করিমের জন্য আধাকিস্তি || মাকসুদুল হক

মোশাররফ করিমের জন্য আধাকিস্তি || মাকসুদুল হক

মোশাররফ করিম (Mosharraf Karim) ভদ্রলোকটিকে আমি একেবারে পছন্দ করি না। উনার সাথে আমার পরিচয় নেই, এবং জীবনে একবারও সামনাসামনি দেখা বা কথা হয়নি। অপছন্দ করার কারণ? উনার বুদ্ধিহীনতা।

কোনো-একটা নাটকে ‘ফইন্নির ফুত’ গালিটা চালু করে দিয়ে উনি বেশ ‘হিরো’ বনে গেলেন। করিম মানেই এই নিম্নরুচির গালি। একটিবারও চিন্তা করলেন না যে ‘ফিক’ শব্দ থেকে ‘ফকির’ শব্দটি এসেছে। ইহার অর্থ গভীর জ্ঞানের অন্বেষণকারী। মুলত পীর, আউলিয়া, কামেল পুরুষ বা ওয়ালিয়াৎপ্রাপ্ত সিদ্ধপুরুষদের এই টাইটেল দেয়া হয়। করিম যেটা করল তা এই মহাপুরুষ ও মহারথীদের রাতারাতি ‘ভিখারি’ বানিয়ে দিলেন। এ নিয়ে আমি আগেও লিখেছি এবং কুষ্টিয়ায় গতবছরের দোল পূর্ণিমার সময় এ নিয়ে বাহাস হয়েছিল সাধকদের মধ্যে অনেক।

যেহেতু বাউল-ফকিরগণের বিশ্বাসের জায়গায় কোনো প্রতিবাদের স্থান নেই বা আমরা মানববন্ধনটন্ধন ইত্যাদির মতো গোমূর্খ কর্মসুচিতে বিশ্বাসী নই। আমাদের কেবল একটা পথ খোলা থাকে। মন থেকে অভিশাপ দেয়া — আর তা কেবল আমি নই হাজারো বাউল, ফকির, দরবেশ সহ সাধারণ মানুষ দিয়েছে, অন্তর থেকে ও চোখের পানি দিয়ে ভাসিয়ে। এমন কান্না আমি খুব কমই দেখেছি। ফইন্নির ফুত গালি যে সরাসরি ফকিরদের দেয়া হচ্ছে না, এ যে আমাদের শ্যামেক গুরু ফকির লালন শাহকেও উদ্দেশ্য করে গালি, খিস্তি ও নোংরামি করা হচ্ছে তা হতদরিদ্র বাউলরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না, বরদাশত করতে পারেনি। আমরা এও ধরে নিয়েছি যে করিম হয়তো-বা নাটকনির্মাতার ইচ্ছায় এই গালিটা চালু করল; তবে তাকে আমি জানি উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী এবং রুচিবান একজন মানুষ হিশেবে। উনি কি একবারও তার মগজ খাটালেন না এই বিষয়ে?

নাকি একটা চালু গালি শুরু করে তা ভাইরাল করে দেবার দরুণ টিআরপিতেও, তথা জনপ্রিয়তার কারণে তার টাকাপয়সা বাড়বে সে-আশায় আমাদের প্রাণপ্রিয় সাঁইজিকে গালি দিতে উনি কোনো কার্পণ্য করেননি?

jago bangladesh Mosharraf Karim
এখন এক ভারতীয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান খুবই নিম্নমানের নকল করতে গিয়ে খাইসেন একটা বেসাইজের ধরা। কিসু বিকিনি, বুরখা, হিজাব পরা না-পরা নিয়ে এক তাণ্ডব শুরু হয়েছে। মোল্লাহতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত জেহাদ বহু পুরনো এবং সম্বল হিশেবে মনে করি আমাদের বাউলফকিরি পরম্পরা আমার পথচলা ও লড়াইয়ের একমাত্র কমরেড এবং সহযোদ্ধা। এ-লড়াই বহু পুরনো এবং চলছে ও চলবে সময়ের শেষ অব্দি। করিম (Mosharraf Karim) না-জেনে না-বুঝে এ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং ঠিকই অনেক বড় ধরনের বিপদে পড়েছেন বটে। ইতিমধ্যে সে ক্ষমা-চাওয়ার পর্বটাও সেরে ফেলেছে ফেইসবুকের স্ট্যাটাসের কল্যাণে। তবে ক্ষমা চাচ্ছে কাকে গোমূর্খ? তোমার জাতভাই গোমূর্খ মোল্লাহদের কাছ থেকে? ঠিকই যে এ ‘মানিকে মানিক চেনে’ খেলা — তা তুমি না-বুঝলেও তামাম বাংলাদেশের জনগণ বোঝে ও জানে। তোমার হয়তো টিআরপি কিছু হলেও বাড়বে, তবু জেনে রেখো এ ‘আগুন নিয়ে খেলা’ — তাতে তোমার জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মোল্লাহগণ তোমাকে ছেড়ে দেবে না সহজে।

jago bangladesh Mosharraf Karim
তথাপি আমার সমর্পণ সমর্থন তোমার জন্যই রইল, তবে একটি শর্তে। অনতিবিলম্ব তুমি সকল বাউল, ফকির, দরবেশ, কামেল পুরুষ ও ওয়ালিয়াৎপ্রাপ্ত পুরুষদের কাছে ক্ষমা চাও। বিশেষ করে ফকির লালন সাঁইজির ধাম তথা মাজারে গিয়ে লুটিয়ে পড়ো ভক্তি, সেজদা, সাজুদ করো। তুমি ফকিরের অভিশাপ কি তা জানো না। এই যে ঝামেলায় পড়েছ তার অর্থ তোমার উপরে অভিশাপকাজ শুরু হয়ে গেছে। এখনই তোমার হুঁশ আসার উত্তম সময়।

‘সময় গেলে সাধন হবে না’ …

জয় গুরু [আলেক সাঁই] …

জয় বাংলা!

ফেসবুকস্পেসে স্ট্যাটাস আকারে উল্লিখিত রচনাটা পাব্লিশের পরে লেখকের সংযোজন

গেল দিনের আমার দেয়া স্ট্যাটাসের পর কয়েকটা লাইন অ্যাড করছি। মোশাররফ করিমের পক্ষ-বিপক্ষ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমি তাকে পছন্দ করি কি করি না, তাতে করিম তথা সমগ্র বাংলাদেশের তার ভক্তকুলের কারো কিছুই আসে যায় না। সব কথার শেষ কথা উনি একজন প্রোফেশন্যাল, এবং পরিচালক মহোদয় ডায়ালগ যেভাবে দিতে বলবেন, বা ভাঁড়ামি করতে বলবেন, বা অভিনয় করতে বলবেন তা উনি করতে বাধ্য; কারণ নাটকের শ্যুটিং ও অভিনয় করাটা আমার জানামতে উনার পেশা।

তবু এই ডিবেটে মানুষের কমেন্টগুলো পড়ে মনে হচ্ছে নাটক চলাকালীন উনি করছিলেন চাকুরি। তার মানে উনি একজন গ্লোরিফায়েড চাকর এবং ঠিক বান্দর নাচের মতো উনি নাচতে বাধ্য। না মানলে প্রযোজক মহোদয় উনার পবিত্র পাছা মুবারকে বেত দিয়ে মারবেন না, মারবেন লাথি তার পেটে অর্থাৎ তাহার রিজিককে। সব যুক্তি বুঝলাম ও মানলাম; তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :

১। মোশাররফ করিমকে যদি বলা হতো ‘ফইন্নির পুত’ না বলে ‘খা***কির পুত’ বা ‘মা***গির পুত’ বা তোর ‘মা-বোইনরে চু***’ বলতে, তখনও কি তিনি একই উৎসাহ উদ্দীপনায় গালিগুলো দিতেন যেমনটি উনি দিতেছেন ‘ফইন্নির পুত’-এর ক্ষেত্রে? যদি উত্তর হয় না, আমার পাল্টা প্রশ্ন হবে : কেন না? এমন কি সমস্যা উপরের গালিগুলোতে? কি কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে পাব্লিকলি এসব গালি দেয়া হয় না? কি কারণে করিম বা তার প্রয়োজক সুস্থ মাথায় বেছে নিলেন ফইন্নিরপুত গালিটিকে?

২। খুব অবাক লাগল যে বিষয়টা তা হলো, আমারই পরিচিত বেশ ক-জন নারীবাদী বন্ধুবান্ধব করিমকে প্রাণঢালা সমর্থন দিয়েছেন ইতিমধ্যে। ভাবখানা এমন যে আমিই তাকে scape goating করছি, যেন উনি innocent victim of circumstances! তবে ভাববার বিষয় হচ্ছে যে প্রত্যেকটি অশ্লীল বাংলা গালি যে কেবল নারীজাতির দিকে টার্গেট করা হয় সেটা নারীবাদীগণ তাদের তীব্র ‘করিমপ্রেমের’ কারণে বিলকুল ভুইল্যা গেলেন। আমি যে-বিষয়ে গোঁয়ারের মতো গোঁ ধরে থাকব এবং serious exception নিয়েছি তা হলো, ফইন্নিরপুত দিয়ে কেবল ফকির লালন শাহকে গালি ও অপমান করা হয়নি, মূলত এবং অত্যন্ত জোরালোভাবে বলতে চাই গালিটা দেয়া হয়েছে তার পবিত্র মাতা জটানি ফকিরানি মতিজান মাকে সরাসরি। আমাদের নারীবাদীগণ যতই করিমের জন্য মায়াকান্না করুক, আমার স্পষ্ট কথা : সাঁইজির কাছে ক্ষমা না-চাওয়া অব্দি natural law তাকে ক্ষমা করবে না। ইন-ফ্যাক্ট তাকে ছারখার করে ফেলবে। পিরিয়ড।

সাঁইজিকে অপমান করে আমার জানামতে কেউ পার পায়নি। অনেক নামই নেয়া যেতে পারে, তবে আমি শুধু নেব মরহুম কবি ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের নাম। উনি যখন জনপ্রিয়তার সবচাইতে উঁচু স্তরে ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনা। ভোরের কাগজের সাব-এডিটোরিয়্যালে স্থান পেয়েছিল তার এক সাক্ষাৎকার। ক্যাপশন ছিল : “লালন ফকির একটা পাগল ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না।” সাক্ষাৎকারটা পড়ে আমি নীরবে কেঁদেছিলাম। বিষয়টা নিয়া আমি ছেঁউড়িয়ার তখনকার সবচাইতে প্রবীণ সাধক মরহুম হিরু শাহের সাথে আলাপ করেছিলাম। বৃদ্ধ এই সাধক কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন আমাকে : “দেখো কি হয়।” হুমায়ুন আজাদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। বাকিটা ইতিহাস …

জয় গুরু আলেক সাঁই!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you