এক গ্লাস জোছনা
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে…
পুরনো দিনের জেমস্। মনে আছে এই কাব্যভাষা আর নাগরিক বৈরাগ্যবোধ আমাদের শৈশবে চমকে দিয়েছিল। গানের ডালির অলস দুপুর আর হেমন্তের মন্থর ঘোরলাগা সুরকেও পেরিয়ে আমরা তখন এই কর্কশ অথচ মধুর স্বরের আহ্বানে ছুটে গিয়েছিলাম।
ঢাকা শহরটা তখন আরেক রকম, কিছুটা সেফিয়া টোনের মতো পুরনো। আমরা রকের ঝাঁঝালো চিৎকার শুনি কখনো স্কুলমাঠে কখনো পাড়ার ফাংশানে। এদিকে ক্যাসেটপ্লেয়ারের টিডিকের ফিতা কখনো চলছে কখনো বলপেন দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গিঁট খুলে আবার চালু করছি। আর কখনো দড়াম এক চাপড় পড়ছে ট্রানজিস্টারে।

ফ্রাইডে ইভনিং তখন পাড়ায় পাড়ায় ডিস্কো, রক, হুল্লোড়। মস্তানেরা মাথায় ব্যান্ডেনা বেঁধে পায়ে বুট পরে চালাচ্ছে এক্সএল হোন্ডা। আমরা এ-রকম সময়ের ভেতর জেমসকে আলাদা করেছিলাম, যে তার উদাত্ত আহ্বান দুখিনি মায়ের কথা বলছে। তার দুখের গাথা গাইছে গলায় গামছা দিয়ে। পায়ে সু পরনে ঢোলা পাঞ্জাবি আর চোঙা জিন্স। এক জিদ্দি আর একরোখা কিছুটা মাটিমুখি হয়ে গাইছে ‘একলা ঘরে এলে বন্ধু আদিম গ্রন্থ হাতে, শোনাও বন্ধু কাব্য তোমার এই রাতে, ঠিক আছে ঠিইইক আছে’…। এইসব আমাদের নাগরিক কবিতার প্রথম পাঠ।
আমরা সেইসব কথামালায় নিজেদের অস্থির সময়সূচি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে পড়ার সেই সুবর্ণ মুহূর্তে। কারণ ঘুড়িরা তখন আকাশগামী বাহনের মতো। যেসব বন্ধুরা আজ আর গান শোনে না লিরিক নিয়েও ভাবে না তারাও তখন মাথা নুয়ে ভাবতে বসেছিল এইসব গানের মর্ম। আমরা পেরিয়ে এসেছি সেই ভ্যাগাবন্ড সময়। কাঠের ডান্ডা দিয়ে গিটার বানিয়ে মাথায় পট্টি পেঁচিয়ে কানাগলির মুখে তারস্বর চিৎকার। সেখানেই বার্থ অফ বাংলা রক।
আমাদের স্কুলের খাতায় খাতায় লিখিত ইশতেহারের মতো জেমসের গানের বাণী। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজের তারুণ্য ছুঁয়েছিল যখন তখন এসব গান আমাদের কাছে আরও তাৎপর্যময় হয়ে উঠল। একটু জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান নজরুল রবীন্দ্র পাঠের সূচনা হলো। বাংলা রকের ভাব অভাব ভেতরে দানা বাঁধতে লাগল। সেখানে উঁকি দিলো, ‘ওই যে গুলিস্তান, হাওয়ায় ভেসে আসছে হঠাৎ আজম খানের গান’… সুমন চাটুজ্জের কথাসুরগান।

আমরা দুই বাংলা দুই ভাব কিঞ্চিৎ অনুভব করি। কিন্তু মহীন এসে আবার এলোমেলো করে দেয়। কার্তিকের জোছনার প্রান্তর থেকে লালমোহন সাহা স্ট্রিটের অন্ধকার আকাশ অব্দি। আমরা গামছা গলায় জেমসের কাছে ফিরে যাই তার পৌরুষ তার অ্যাঙ্গার তার দুর্বিনীত ভঙ্গির আড়ালে এক মায়াবী পর্দার মতো দুলতে-থাকা দুখিনি মায়ের গাথায়।
জেমস্ তখন ‘হেই মিস্টার ট্যাম্বোরিন ম্যান’, এই শহরের নাগরিক বৈরাগী। তার গানের কথারা ফুলের মতো ফুটছে, গরম ভাতের গন্ধের মতো ফুটছে। আর মানুষেরা আকাশমুখী হয়ে একজন তারকার চিৎকারে সংহতি প্রকাশ করছে। কারণ এই সামষ্টিক আর্তনাদ মানুষকে সেদিন জাগিয়ে রেখেছিল গানের অপারে।
১৮ মার্চ ২০২৫
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
টুকটাক সদালাপ সমস্ত
- টুকটাক সদালাপ ২৩ - October 16, 2025
- বিদায় কাচভাঙা রাতের গল্পকার || শিবু কুমার শীল - October 12, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২২ - October 1, 2025

COMMENTS