যতীন সরকারের মামার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে পরিবার সহ তিনি মুক্তাগাছার পারুলতলাতেই ছিলেন। নেত্রকোণার রামপুর থেকে পারুলতলা অনেক উন্নত। ১৯৪৭ সালের নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবসময়ে স্বাভাবিকভাবেই সর্বত্র অস্থিরতা ছিলে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তের দলিত হিন্দুরাও দেশ ছাড়ছে। আত্মীয়স্বজন, সহচর, পড়শিরাও বাড়িঘর রেখে প্রায় শূন্য হতে দেশ ছাড়ছে। অনিশ্চয়তাপূর্ণ এমন মুহূর্ত তাঁর কিশোর মনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সবাই যেখানে বলছে, ‘এদেশে থাকা যাবে না, এদেশ মুসলমানের।’ তিনি হয়তো এর বিপরীত কথাই শুনতে চাচ্ছিলেন। তখন হয়তো চারপাশে আশার সুর শুনতে চাইছিলেন। দেশ তো সবার; সেই কথাটাই শুনতে চাইছিলেন।
পূর্বপুরুষের মাটির দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের মালাউন পরিচয়ের চেয়ে মাটির পরিচয়ের কথাই ভাবছিলেন। স্বপ্ন ও শান্তি খুঁজতেছিলেন। তাঁকে শান্তি দিতে,—আগামী রাষ্ট্রের, সময় ও সমাজের বার্তা দিতে হাজির হলেন এক গ্রামীণ কবি। হাটে হাটে তিনি কবিতা বিক্রি করেন। তাঁর নাম কবি ইউনুস আলী। সাম্প্রদায়িক আচরণের বিপরীতে গ্রামীণ কৃষকসমাজ থেকে উঠে আসা এই কবি প্রচার করছেন সাম্যের কথা, মানুষের কথা। চারপাশে রক্তারক্তি লুণ্ঠন-দখল-বিতাড়নের বিপরীতে এই কবি নতুন একটি স্বপ্ন নিয়ে হাজির হলেন মুক্তাগাছার গাবতলী বাজারে। সমাজ নির্মাণে কবিদের মৌলিকত্ব কোথায়?—এই প্রশ্নের মীমাংসা করে দিলেন কবি ইউনুস আলী। যতীন সরকার তাঁর ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’-এ সেই কবিকে বর্ণনা করছেন এভাবে :
“একদিন গাবতলীর হাটে গিয়ে একটি জটলা দেখে এগিয়ে যাই। টিনের চোঙ মুখে লাগিয়ে একজন লোক সুর করে কবিতা আবৃত্তি করছেন। শুনলাম ইনিই কবি ইউনুস আলী। আবৃত্তি শেষ করে তিনি সকলকে তাঁর কবিতার বইটি কেনার জন্যে আহ্বান জানালেন। হুড়োহুড়ি করে সকলে বই কিনতে লাগল। আমিও এক কপি কিনলাম। দাম মাত্র একআনা। আট পৃষ্ঠার বই। নাম ‘পাকিস্তানের কবিতা’।
কবিতার শুরুতে আল্লাহ্ রসুলের বন্দনা, তারপরই পাকিস্তানের সৃষ্টিতে কবির অন্তহীন উল্লাসের প্রকাশ। এরপর দুটি লাইনে—
‘ঢাকায় রাজধানী হবে (২) উন্নতি হবে বাংলাদেশের ভাই।
হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকতে যেন পাই।’
একেবারে চমকে উঠলাম। গত দু-তিন মাস ধরে মামাবাড়িতে ও তার আশপাশে লোকজনের মুখে যে ধরনের কথা শুনে আসছি, এ তো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
পাকিস্তান হলেই যে হিন্দুদের এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, কবি তা মানতে রাজি নন। পাকিস্তান হলো, তাঁর মতে, পবিত্রস্থান। পবিত্র স্থানে কোনো মানুষ মানুষকে ঘৃণা করতে পারে না। আর যে দেশে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, এখন তা পারবে না কেন? কবি ইউনুস আলী একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন—
‘দেখ ফজর আলী ঠাকুরদাসের এক উঠাইন্যা বাড়ি।’
ফজর আলী আর ঠাকুরদাস—দুই ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দুটো পরিবার একই আঙিনায় বাস করে, তাদের ছেলেমেয়েরা পরস্পরের খেলার সাথী, ঈদ আর পূজায় তারা একই রকম আনন্দে মেতে ওঠে, একের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা অন্যের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এমন একটি লোভনীয় চিত্র উপস্থাপন করে হিন্দুদের দেশত্যাগকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছেন কবি ইউনুস আলী।
কবি ইউনুস আলীর নাম এখনো কেউ মনে রেখেছেন বলে মনে হয় না। তিনি মুক্তাগাছা অঞ্চলের মানুষ ছিলেন, তা জানি। কিন্তু এর বেশি কিছু জানি না। তিনি ছিলেন একজন কৃষক কবি। আবহমান বাংলার কৃষকের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি-ঐতিহ্যই তিনি বহন করছিলেন। কৃষকের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদের কোনো ঠাঁই কোনোদিনই ছিল না। পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকদের অবদানই সবচেয়ে বেশি—এ-কথা ঠিক। কিন্তু তারা সাম্প্রদায়িক চেতনা-তাড়িত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন—সে-কথা ঠিক নয়। জমিদার-মহাজনচক্রের হাতে শোষিত-নিষ্পেষিত হচ্ছিল যে-কৃষক, সে-কৃষকের সামনে পাকিস্তান আন্দোলন একটি অত্যন্ত মোহনীয় ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরেছিল। সে-ছবিই মুসলমান কৃষককে পাকিস্তান আন্দোলনে আকৃষ্ট করেছিল, কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় নয়।”
কবি ইউনুস আলীর কবিতা যতীন সরকার যখন শুনছেন তখন তাঁর বয়স এগারো বছর। এগারো বছরের একজন কিশোরের পক্ষে নিশ্চয়ই কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্ভব ছিল না, কিন্তু কবিতা পাঠের সুর, বর্ণনা, বক্তব্য এবং আবেদন তাঁর অস্থির-অনিশ্চিত মনকে শান্ত করেছিল। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং হিংসার বিপরীতে এই মানবিক কবি উৎসুক কিশোর মনেকে শান্তি দিয়েছিল। একজন কবির কণ্ঠে স্বপ্ন ও আশাবাদের প্রচারে তিনি স্বস্তি ও সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন।
কৃষক সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা এই কবিরাই যতীন সরকারের বিবেচনায় প্রাকৃতজনের কবি। এই কবিরাই সমাজকে শান্ত করে। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকৃত রূপকার কৃষক সমাজকে বাইরে রেখে মতলববাজ, স্বার্থবাদী মহাজনী গোষ্ঠী, গ্রাম্য টাউটদের বিরুদ্ধে এই কবি মূলত প্রাকৃতজনের ভাষ্যটাই প্রকাশ ও প্রচার করেছেন।
আমার মনে হয় যতীন সরকার সারাজীবন যে মূলধারার কবি এবং কবিতার কথা বলেছেন, কবি ইউনুস আলী সেই মূলধারার কবি। এরা মানবিক সত্য ও সুবচন প্রচার করে। এরা ক্ষমতা ও মতলববাজকে প্রশ্ন করে। জনগণের ভাষায় জনগনকে সজাগ করে। কবি ইউনুস আলী যতীন সরকারকে সজাগ করেছে। সমাজকে মাটির প্রতি দায়বদ্ধ ও প্রাকৃত করেছে। মুক্তাগাছার গাবতলী বাজারে চুঙা ফুঁকিয়ে যে সত্য ও স্বপ্ন প্রচার করেছিল গ্রামীণ হাটুরে কবি, যতীন সরকার সেই সত্যকে সারাজীবন বহন করেছেন। তিনি বলেছেন, “ইউনুস আলীর কবিতা আমার কৈশোরিক চৈতন্যে যে-সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিল, তার সুবাসে এখনো আমি উজ্জীবিত হই।”
গানপারে যতীন সরকার
গানপারে সরোজ মোস্তফা
- ইউনুস আলীরা যতীন সরকারের কবি || সরোজ মোস্তফা - August 17, 2025
- কবিতার সাথে বিচরণ কবির সাথে বিচরণ - August 1, 2025
- গাঙডুবি : আবহমান জীবনের দৃষ্টি ও ধারণা - August 1, 2025
COMMENTS