যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য : এক আলোকবর্তিকা || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য : এক আলোকবর্তিকা || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য বাংলার অন্যতম কৃতীসন্তান। বাংলা সাহিত্যসেবায় তাঁর অবদান সবার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের সিঙেরকাছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রী যামিনীকান্ত ভট্টাচার্য, মাতা মোক্ষদা দেবী।

ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেটের বন্দরবাজারস্থ দুর্গাকুমার পাঠশালাতে। তিনি দুর্গাকুমার পাঠশালা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সিলেট সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন পড়াশোনার পর শিলং-এ তাঁর কাকার কাছে চলে যান। সেখান থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে একই কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাশ করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতায় অধ্যাপক হিশেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি যেসব ঐতিহ্যবাহী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ ও গৌহাটি কটন কলেজ। তবে অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহনের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় হচ্ছে — তিনি একজন সাহিত্যিক ও গবেষক। মুরারিচাঁদ কলেজে অধ্যাপনার সময় তিনি ‘শ্রীহট্র সাহিত্য পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হন, উক্ত পরিষদের মুখপত্রের প্রধান সম্পাদক এবং সংগঠকও ছিলেন। সিলেটের লুপ্তসাহিত্য ও পুঁথিসাহিত্যের সংগ্রাহকের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যই ছিলেন প্রথম পথপ্রদর্শক।

ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য একজন নিবেদিত সাহিত্যসাধক ছিলেন। তিনি গবেষণামূলক সাহিত্যকর্ম সম্পাদন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসন্ধানে অবদানের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ নামক যে-গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে, তাতে ১৬২ জন কবির ৯৪৩টি গান সংকলিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এঁদের মধ্যে কেবল সিলেটি কবির সংখ্যাই হচ্ছে ৬৪। এই ৬৪ জন কবির রচিত গানের ৩৬১টি যতীন্দ্রমোহন নিজে সংগ্রহ করেছিলেন।

ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য আজীবন সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলা সাহিত্যের লুপ্তপ্রায় দুষ্প্রাপ্য পুঁথিপত্র, গ্রন্থ ও সাময়িকপত্রের বিপুল ভান্ডার গড়ে তোলেন। এই বিপুল ভান্ডার বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর অধীনে ‘যতীন্দ্রমোহন সংগ্রহশালা’ হিশেবে খ্যাত। তিনি সিলেট অঞ্চলের ভট্টসংগীত সংগ্রহ করে বই আকারে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। ‘শ্রীহট্রের ভট্টসংগীত’ নামক বইয়ে সিলেট বিভাগের ১৬ জন কবির নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানজনক ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অভিধান-গ্রন্থের পরিচয় শীর্ষক গবেষণার জন্য গ্রিফিথ মেমোরিয়াল প্রাইজ লাভ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বাঙ্গালার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ শীর্ষক গবেষণাকর্মের জন্য খুন্তাস্তা আক্তার বানু সুহরাওয়ার্দী স্বর্ণপদক এবং ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক লাভ করেন।  তাঁর সংগৃহীত পুঁথি অবলম্বনে মুনীন্দ্রকুমার ঘোষ সঞ্জয় গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিশেবে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। দু-বছর পর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে গৌহাটি কটন কলেজে বদলি হয়ে চলে যান। অতঃপর ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে অবসর নেন।

তিনি ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণাধর্মী লেখা ও কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতা কর্তৃক তাঁর ‘বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ (প্রথমখণ্ড) প্রকাশিত হয়। এছাড়া শ্রীহট্রবাসী সম্পাদিত সংবাদপত্র এবং শ্রীহট্র সাহিত্য পরিষদের রক্ষিত বাংলা পুঁথির তালিকা শীর্ষক দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে তাঁর।

যতীন্দ্রমোহন ভট্রাচার্য রচিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থ/সংকলসমূহ হচ্ছে — ‘শ্রীহট্রবাসী সম্পাদিত এবং শ্রীহট্ট ও কাছাড় হইতে প্রকাশিত সংবাদপত্র’ (১৯৪২), ‘কেতকা দাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল’ ১ম খণ্ড (১৯৪৪), ‘দ্বিজসুন্দরের বৈদ্যনাথ মঙ্গল’ (সম্পাদনা ১৯৫১), ‘কৃষ্ণচন্দ্র শিরোমণি রচিত পুরাণ বোধোদ্দীপনী’ (সম্পাদনা ১৯৪৭), ও ‘গোপাল ঠাকুরের পদাবলী’ (সম্পাদনা ১৯৪৪), স্বদেশপ্রেমিক রমাকান্ত রায়’ (যুগ্মভাবে সম্পাদনা, ১৯৫০), বাঙ্গালার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ (১৯৪৯, ২য় সংস্করণ ১৯৬২), রায়শেখরের পদাবলী’ (সম্পাদনা ১৯৫৫), ‘আসাম বুরুঞ্জি’ (সম্পাদনা ১৯৬২), ‘রামনবমী নাটক’ (সম্পাদনা ১৯৬৫), ‘বাংলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়’ (১৯৭০), পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’ (১৯৭০), ‘মোক্ষদা সংগ্রহের বাংলা পুঁথির তালিকা’ ১ম খণ্ড (১৯৭৪), ‘এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত বিবরণাত্মক সারিবদ্ধ বাংলা পুঁথির তালিকা’ ১ম খণ্ড (১৯৭৭), ‘বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ ১ম খণ্ড (১৯৭৮), বাউলকবি রাধারমণ গীতিসংগ্রহ’ (বিজনকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে সম্পাদনা, ১৯৮২), ‘অনসীয়া পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ (১৯৮৯), বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থাদির তালিকা ১ম খণ্ড ১৭৪৩-১৮৫২’ (১৯৯০), ‘মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থের পঞ্জি’ (১৯৯৩), ‘A Descriptive Catalogue of the Bengali Manuscripts in a Tabular Form’ (১৯৭৭), ‘A Descriptive Catalogue of the Sanskrit Manuscripts in a Tabular Form’, ‘অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি’ (১৪০২)’ প্রভৃতি ।

ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হলেও তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি ও গবেষণাকর্ম আজও আমাদের উৎসাহ জোগায়। ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্রাচার্য ছাত্রাবস্থায় সাহিত্যসাধনায় সক্রিয় ছিলেন। মরহুম জাতীয় অধ্যাপক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সহপাঠী হিশেবে তিনি এমসি কলেজের ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছিলেন (যৌথভাবে)। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জ্ঞানসাধক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সফলতা ও সম্মানের চূড়ায় উঠতে পেরেছিলেন কেবল তাঁর মহৎ কর্মপ্রচেষ্টার ফলে। প্রাচীন পুঁথিপত্র যাবতীয় বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা ইত্যাদির সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রকাশনা সহ গবেষণাধর্মী ৩০টির অধিক গ্রন্থপ্রণেতা হিশেবে অধ্যাপক ড. যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান পুরুষ হিশেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই পরলোকগমন করেন। অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য জীবনের ৮৫ বছর ধৈর্য, অধ্যাবসায়, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও পরম নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার গুণে তাঁর মহৎকর্ম সৃষ্টিতে কিংবদন্তি হিশেবে চিরভাস্বর হয়ে আছেন গোটা উপমহাদেশের ভেতর। বাংলার সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ক্ষণজন্মা এই কীর্তিমান পুরুষ চিরকাল এক আলোকবর্তিকা হিশেবে বাংলাভাষী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।


মোহাম্মদ জায়েদ আলী রচনারাশি

COMMENTS

error: