কবি জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন অবজ্ঞা, অপ্রাপ্তি আর অশান্তির ভেতর দিয়েই গেছেন। চারপাশের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের ভেতরে থেকেও আশ্চর্য শক্তিতে কবিতার ঘোরে নিজের কাছেই নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন। সফলতা-অসফলতা কিংবা সামাজিকতার বহুরঙে না-জড়িয়ে ক্রমাগত লিখে গেছেন। নিজের পকেটের টাকায় কাব্যগ্রন্থ বের করেছেন। সেই গ্রন্থ বিক্রিও হয়নি, পাঠক কিংবা সমালোচকের দৃষ্টিতেও আসেনি। চাকরিতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র একজন ব্যর্থ মানুষ। ক্লাসের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে। ক্লাসে ছাত্ররা কাগজ গোল্লা বানিয়ে তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারত, ব্যঙ্গ করে নাম উচ্চারণ করতো। সজনীকান্ত দাসের কুৎসাকলমে নিয়মিত ছিল তাঁর নাম। শোনা যায়, শুধু সহকর্মী নয়, সহকর্মীর স্ত্রীরা পর্যন্ত তাঁর কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করতো। সেই ব্যঙ্গ-রসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে নৌকাভ্রমণে কবি মাঝপথে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জীবনে বারবার চাকরি হারিয়েছেন। চাকরির জন্য কত জায়গায় যে ছোটাছুটি করেছেন! বিশুদ্ধ চাকরি তাঁর কপালে জোটেনি। কর্মহীন থাকার যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তিনি এখানে সেখানে ছোটাছুটি করেছেন। শুধু টাকার জন্য রাত জেগে দিস্তার পর দিস্তা নোটবই লিখেছেন। চাকরি খুঁজতে গিয়ে রাইটার্স বিল্ডিঙে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। কলেজ থেকে কিংবা অন্যত্র কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হলে তাঁর নামটিই সবার আগে এসেছে। ছাতার বাঁট বিক্রি থেকে জীবন বিমা—বিচিত্র জীবিকার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কলকাতার নাগরিকেরা, তাঁর বন্ধুরা কিংবা কুৎসারটনাকারীরা তাঁকে চাকুরি কথা দেয়নি। ১৪ অক্টোবর আহত হয়ে যখন মৃত্যুপথযাত্রী, হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছেন—এই সংবাদ শোনার পরও সাথে সাথে স্ত্রী তাঁকে দেখতে আসেননি। মাল্যবান উপন্যাসটাই যেন তাঁর সাংসারিক আত্মজীবনী। কিন্তু জীবন নিয়ে প্রকাশ্যে আফসোস কিংবা প্রতিবাদ লিখেননি। একটা নীরব নির্জনতার ভেতরে আত্মজীবনকে, অনুভব আর কল্পনাকে অনবরত লিখে গেছেন কবি। পৃথিবীর রগড়ে নির্বাক আর শান্ত থেকে গেছেন। শান্ত থাকতে থাকতে পৃথিবীর এক মন্থরতর সন্ধ্যায় গতিহীন যানের নিচে চলে গেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবনানন্দ দাশ কি পেলেন? কবিতা লিখতে এসে এসব পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলানো যায় না। লিখতে লিখতে মানুষকে, সময়কে যেভাবে আবিষ্কার করেছেন—এই শান্তি পৃথিবীতে আর কার কপালে জুটবে? শুধু বাংলা ভাষায় নয়, পৃথিবীতেও নিজের সময়ে বিচরণকালে জীবনানন্দ দাশের মতো অবহেলিত কবি আর নেই। অন্যদের এই হেলায় কবির মগ্নতায় কোনো রেখাপাত ঘটেনি? ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ২৫০৭টি কবিতা ও ৪০০০ পৃষ্ঠার অপ্রকাশিত ডায়েরি রেখে পৃথিবীর মগ্নতর কবি বিদায় নিয়েছেন। অন্যদের হেলার দিকে তাকিয়ে থাকলে এইসব আয়োজন কীভাবে সম্ভব হতো? কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।
আজ বাইশ অক্টোবরে এই মহৎ কবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করে। কবিকে নিয়ে তাদের লেখা ১২টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। জীবনানন্দকে জানাবোঝার এই আয়োজন চলতেই থাকবে। মানুষ জীবানানন্দ, কবি জীবনানন্দ, লেখক জীবনানন্দ বাংলার সারস্বত সমাজের জন্য এক গভীরতর আশীর্বাদ।
২২.১০.২০২৫
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে জীবনানন্দ দাশ
- জীবন জানাবোঝার এই অনাড়ম্বর আয়োজন || সরোজ মোস্তফা - October 23, 2025
- রকিব হাসান : অকাল প্রস্থান - October 16, 2025
- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এক সাহিত্যিক ও সমাজশিক্ষক || সরোজ মোস্তফা - October 13, 2025
COMMENTS