যবে থেকে আমাদের পড়াপড়ির শুরু, বই এবং প্রেমে, অদ্ভুত একটা কাণ্ড সংঘটিত হচ্ছিল আমাদের চারপাশে। এখন ভাবতেই কী রকম লাগে যেন, তখন তা ছিল নৈমিত্তিক রোজরেগ্যুলার কারবার। একজন কবি, যাকে আমরা আবাল্যকৈশোর এসেছি জেনে কেবলই বিশুদ্ধ অর্থধৃত কবি হিশেবে, একের পরে এক গল্প ও উপন্যাস আবিষ্কার ও প্রকাশ হচ্ছিল তাঁর। বাংলা ভাষার সাহিত্যিকরা হা হয়ে দেখছিলেন নিশ্চয় যে একজন সত্যিকারের লেখক কতটা না-ছেপেও রচনা করে যেতে পারে তার খাতার পর খাতার সাহিত্যের সংসার।
নব্বইয়ের দশকের কথা। নাইন্টিফোর থেকে, ব্যক্তিগত নব্বই আমার ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে এই ইয়ার থেকে, এই জিনিশ লক্ষ করে আসছিলাম। দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক সাপ্লিমেন্টপাতায়, পাক্ষিকগুলায়, সেই কবির গল্প ও উপন্যাস আবিষ্কারসংবাদ নিয়মিত বেরোতে থাকে। এবং, শুধু খবরই নয়, সেইগুলা ছাপাও হতে শুরু করে। এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল সত্ত্বেও গোগ্রাসে সেসব পড়তে থাকি আমরা। ভারতীয় বাংলা বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক উভয় ধারার কাগজে সেই গোল্ডেন ট্রেজার পাব্লিশ হতে থাকে।
কে সেই কবি? রিপ্লাই, জীবনানন্দ দাশ।
কবে বের হয়েছিল ভুলে গেছি, কিন্তু উল্লেখ-করা টাইমেরই আশেপাশে হবে, জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল আবদুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায়। অবসর প্রকাশনী বা প্রতীক থেকে। এক্স্যাক্ট মনে পড়ছে না। আমার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে সেই ঢাউশ বইটাই দীর্ঘদিন ব্যবহার করে গেছি। কিন্তু পড়ার সময় বানানবিভ্রাট ও বাক্যস্থিত/পঙক্তিধৃত পদব্যবহার নিয়া নানান কনফিউশন হতো, হয় এখনও। কনফিউশনগুলি ডিটেইলে বলা আপাতত দরকার মনে করছি না। ব্যাপারটা বানানের বা শব্দের শুধু নয়, এইটা বলতে পারি।
কিন্তু, তার আগে বলি, বহুদিন পর্যন্ত গদ্যের বই জীবনানন্দ বলতে একটাই ছিল। কবিতার কথা। তারপর একসময় ইন্ডিয়ার ‘বিভাব’ ও অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত বেরোতে থাকে অপ্রকাশিত জীবনানন্দ। প্রতিক্ষণ, দেশ, আনন্দবাজার প্রভৃতি ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলার শারদীয় ও নিয়মিত সংখ্যায় একে একে বেরোতে থাকে জীবনানন্দ দাশের গল্পের পর গল্প, কবিতাগুচ্ছের পর কবিতাগুচ্ছ, ও, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, উপন্যাসগুলো। শরীর শিহরি ওঠে, এখন ভাবলে, সেইসময়কার উপন্যাস পড়ার দুপুরবিকালরাত্রিগুলি!
জীবনানন্দের কথাসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার আবিষ্কার হবার আগে এবং পরে একই (প্রায়) ভাষা ব্যবহারকারী দুই বাংলা ল্যান্ডের কথাসাহিত্য নিয়া আলাপ দুই রকম না হয়া উপায় নাই। জীবনানন্দের কবিতা তাঁর জীবদ্দশায় যা পাঠকগোচরে এসেছিল, ওইটুকু দিয়াই নির্মিত আমাদের সাহিত্যের জীবনচেহারা। আরও পরে যেসব কবিতার পর কবিতা আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রধানত ভুমেন্দ্র গুহ সম্পাদনায়, সেসব কবিপ্রোফাইলে তেমন চেইঞ্জ আনে নাই। কিন্তু কথাসাহিত্য আবিষ্কারের পরে সেই কবিচেহারার পাশে একটা আদ্যোপান্ত প্রতিভাদীপ্ত কথাসাহিত্যিকচেহারা হাজির হলো কি না, তা বোধহয় তালাশ করা বাকি এখনও।
তবে এই কথাটা আমার প্রায়ই মনে হয়, জীবনানন্দকে (অনাবিষ্কৃত রইবার কারণে) বাদ রেখে যে-বিশাল সময় ব্যেপে বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধান বিবেচনাগুলি গৃহীত হয়েছে বেত্তাবিশারদপণ্ডিতদিগের সমাজে, চল্লিশ পঞ্চাশ ষাইট সত্তইর আশি হিসাবে রেখে একটা বিশাল সময়খণ্ড জুড়ে, সেগুলি রিভিজিট করা দরকার বোধহয়। দেখা যাবে, এমন অনেক সিদ্ধান্ত অলরেডি গৃহীত হয়েছে যেগুলি জীবনানন্দ বিবেচনায় নেবার পরে অসার প্রতিপন্ন হয়ে যেতে পারে। এই কাজটা, বাংলা আখ্যানসাহিত্যে এই জীবনানন্দ গ্রহণপূর্বক পুনর্বিবেচনার কাজটা, বহুকাল ধরে বাকি।
কিন্তু উপন্যাস পড়েছি তিনচাইরটা মাত্র। তুলনায় জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প পড়েছি বেশি। বাংলাবাজারের গতিধারা প্রকাশনী থেকে একটা গাট্টা সাইজের গল্পসমগ্র বেরিয়েছিল। উৎপাদন ও দাম দুই দিকেই ছিল সস্তা। মার্জিন অতি চিলতে। হরফগুলি গিজিগিজি। শতাধিক গল্পের সমাহার দেখেছি সেখানে। পড়েছি অল্পই, উপন্যাসের তুলনায় অনেক যদিও। উপন্যাসগুলার নাম ইয়াদ আছে। কারুবাসনা, মাল্যবান, সুতীর্থ। মনে পড়ছে না আর। তবে এটুকু যথেষ্ট, যদি কারো অভীপ্সা থাকে পুনর্বিবেচনার।
বলছিলাম কনফিউশনগুলি নিয়া। আলোচনার গলায় ডিটেইলে বলার দরকার নাই বলছিলাম। তবে সেটা আপাত পরিস্থিতি সাপেক্ষে। এই রিডিং কনফিউশনগুলি, জীবনানন্দ দাশের লেখা পাঠকালীন বিভ্রাটগুলি, কী কী ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় কোথায় কোথায় ঘটে, এই সিচুয়েশন কীভাবে সামলায় পাঠক, ডিল করে কেমন প্রকারে, এসব নিয়া আলোচনা আলাদা জায়গায় হতে পারে। এখানে কেবল কনফিউশনগুলি যে হয়, জীবনানন্দ পড়ার সময়, লেখকের বিচিত্র প্রবণতার সাক্ষি বহন করে এমনকি টাইপোগুলোও, এই কথাটুকু বলে রাখলাম।
অবসরে ফেইসবুকে নানা পাব্লিকেশনের পেইজে উঁকি দিয়া কাভার দেখতে দেখতে একসময় প্রতিক্ষণ প্রকাশনীর মাল্যবান উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির মূল-অনুসারী সটীক পাঠ বিজ্ঞাপনটায় চউখ যায়। ইমেইজের সঙ্গে দেয়া আলোচনাভাষ্য পড়ি। জীবনানন্দ পড়তে যেয়ে যে-কনফিউশনগুলি হয় সেসবের মধ্যে একটি বিশেষ কোনো যতিচিহ্ন বা বানান বা শব্দ লেখকের অভিপ্রায়ে না সম্পাদনার অনবধানতায় থেকে গেল, এই রকমের কনফিউশনে হামেশা পড়তে হয়। প্রতিক্ষণের এই সংস্করণে তেমন কিছু কনফিউশন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অ্যাড্রেস করা হয়েছে মনে হলো।
যদিও, বলা বাহুল্য, বইটা আমি পড়ি নাই। বিজ্ঞাপনটাই। কিন্তু, বোঝা তো যায়, বইটি কেমন হবে, পড়ে দেখবার আগ্রহও জাগায়। মাল্যবান উপন্যাস তো পড়া আছে, নাই শুধু সটীক প্রতিক্ষণ সংস্করণটা। আমি বরং প্রকাশনীপেইজ থেকে অ্যাডভার্টের রিটেন টেক্সটটুকু কপি দিয়ে এনে এইখানে পেইস্ট করে রাখি :
[] ‘কী’ ছাপিয়ে ‘কেন’-র কাছে []
জীবনানন্দের ১২৫ বছরে আমাদের প্রধান কাজ ছিল জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির মূল অনুসরণ করে তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটির একটি নির্ভুল পাঠনির্মাণ। এ-কাজ আমরা প্রায় এক বছর ধরে যথাসাধ্য নিষ্ঠ শ্রমে শেষ করে পাঠকসমক্ষে উপস্থাপিত করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবে, পূর্বতন পাঠগুলির ভুলগুলিকে সযত্নে শুধরে নেওয়ার সময়ে আমরা যদি শুধুমাত্র সেই ভুলের তালিকায় আবদ্ধ হয়ে থাকতাম, শুধু ভুলগুলির নিচেই নিম্নরেখ এঁকে চলতাম—তাহলে এই ২০২৫-এ এসেও জীবনানন্দকে নতুন করে নিবিড় পাঠ আর হত কোথায়? প্রতিক্ষণ-এর এই সংস্করণটিতে আমরা সেই মূল্য সংযোজনটুকুই করতে চেয়েছি, যাতে আক্ষরিক ভুলগুলিকে অতিক্রম করে উপন্যাসকারের অস্থিরতা, ব্যস্তচিত্ততা, অভ্যাস, স্খলন এবং ব্যত্যয়গুলিও পাঠক ধরতে পারেন; ‘কী’ ছাপিয়ে ‘কেন’-ও প্রণিধানযোগ্য হয়।
যেমন ধরুন, গুলো/গুণো, এলাম/এলুম, লেবু/নেবু এগুলিকে পাণ্ডুলিপি-অনুসারে নির্ভুলভাবে পাঠোদ্ধার করাটা জরুরি কাজ বটে; ততটাই জরুরি এই ব্যবহারগুলিকে বুঝতে চাওয়া। ‘পূর্ববঙ্গীয় হলেও লক্ষণীয়ভাবে জীবনানন্দ যে কলকাতার লব্জ রপ্ত করতে চেষ্টা করছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে, এবং এই উপন্যাসেও বিবিধ স্থানে, চোখে পড়ে। যেমন—“একটা বড় পিরিচে নুন, নেবু, কাঁচালঙ্কা”—এই একটি মাত্র ছাড়া পাণ্ডুলিপির আর সর্বত্র ‘লেবু’ লিখেছেন। সাধারণভাবে ‘গুলো’ লিখলেও ‘গুণো’ লিখেছেন দু-বার। পাণ্ডুলিপিতে বেশ কয়েকবার ‘পাঁঠা’ শব্দটিকে ‘পাঁটা’ লেখা হয়েছে। পুরো উপন্যাসে তিন বার ‘এলাম’ এবং তিন বার ‘এলুম’ লিখেছেন তিনি। মাল্যবানের বয়ানে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পাই, ‘দেখতে এলাম তোমরা কি করছ।’ সপ্তম পরিচ্ছেদে মাল্যবানের বয়ানেই পাই, ‘ম্যাটিনিতে অনেক দিন পরে এলাম—’ কিন্তু চতুর্দশ পরিচ্ছেদে মাল্যবান বলে, ‘না, তা না, এম্নি কথাবার্ত্তা বলতে এলুম।’ বিংশ পরিচ্ছেদে বিপিন ঘোষের কথায় পাই, ‘⋯পয়মন্তদের মুখ দেখতে চলে এলুম তাই—’ পশ্চিমবঙ্গীয় বিপিন ঘোষের ভাষার চলন অনুযায়ী ‘এলুম’ স্বাভাবিক হলেও মাল্যবানের ভাষার চলনে ‘এলাম’-ই হওয়ার কথা। সিংহভাগ ক্ষেত্রে মাল্যবান ও উৎপলার জবানিতে ‘বলেছিলাম’, ‘ভাবছিলাম’, ‘ডেকেছিলাম’ ইত্যাদি চোখে পড়লেও কয়েকটি ক্ষেত্রে ‘দেখেছিলুম’, ‘দেখছিলুম’, ‘দেখলুম’, ‘পড়েছিলুম’ পাওয়া যায়। পড়াশোনার বিস্তার, টানা কলকাতা-বাস ও সঙ্গ-অভ্যাসে প্রমিত শব্দ ব্যবহারের কারণ বোঝা গেলেও এ-ধরনের ‘খাস ঘটি’ কথার টান বরিশালের মানুষটির পক্ষে কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিকই বটে! কলকাতার শীলিত বৃত্তে নিজের ‘বাঙাল উচ্চারণ’ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন কি জীবনানন্দ?’
[পাঠ সম্পাদকের নিরীক্ষা । মাল্যবান]
মাল্যবান । জীবনানন্দ দাশ
পাণ্ডুলিপির মূল-অনুসারী সটীক পাঠ
প্রকাশনা : প্রতিক্ষণ । মুদ্রিত মূল্য : ৩৭৫ টাকা (ভারতীয়)
আপাতত, উপরের উদ্ধৃত অংশটুকু পড়ে সেরে, এই রচনায় দাঁড়ি টানব।
সুবিনয় ইসলাম ২০২৫ অগাস্ট
সুবিনয় ইসলাম রচনারাশি
- অক্টোবর নয় || তুহিন কান্তি দাস - October 9, 2025
- মায়ের চরণে মেমোয়ার - October 7, 2025
- সাধুসঙ্গ ও সাধনসংগীত || বিমান তালুকদার - October 3, 2025
COMMENTS