জঁ-লুক গদারের আনন্দযাত্রা || আহমদ মিনহাজ

জঁ-লুক গদারের আনন্দযাত্রা || আহমদ মিনহাজ

সমাজের তলানিতে পড়ে থাকা পরাজিত ওরফে হারুপার্টির লোকজনের সিনেমা দেখার অভ্যাসে জঁ-লুক গদার যদি আচমকা ঢুকে পড়েন সেক্ষেত্রে ঘটনা কী দাঁড়ায় তার সম্ভাব্য নকশা রস-পরিহাসে রঙিন বয়ানের সাহায্যে অ্যাডিউ গদার (Goodbye Godard) দর্শকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ওড়িয়া ভাষায় মুক্তি প্রাপ্ত ছবিতে তরুণ বাঙালি পরিচালক অমর্ত্য ভট্টাচার্য সেইসব লোকের জীবনে গদারকে ঢুকতে বাধ্য করেছেন যারা কস্মিননকালে তাঁর ছবি দেখেনি। ফরেইন শব্দটির সঙ্গে চিনপরিচয়ের সুবাদে ফরাসি দেশের নাম কানে এলেও গদারের নামধাম তারা বাপের জন্মে শোনেনি। আনন্দ নামের পর্ন-আসক্ত (Porn Addict) এক প্রৌঢ়ের ঘাড়ে চেপে ফরাসি সিনেমাকার একদিন উড়িষ্যার গণ্ডগ্রামে ঢুকে পড়েন। দূর ভারতবর্ষের অজপাড়াগাঁয়ে তাঁর এই আকস্মিক অনুপ্রবেশের গল্পটি গড়পড়তা দর্শক ছবি দেখে বুঝতে পারেন সে-রকম ভাষায় পরিচালক ক্যামেরায় ধারণ করেছেন।

ছবির প্রারম্ভে উড়িষ্যার অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকা বুড্ডা আনন্দের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় ঘটে। বিনোদন বলতে নীলছবির জগৎখানাকে এতদিন সে বুঝে এসেছে। মাঝবয়সী স্ত্রী ও পড়ালেখা জানা একমাত্র কন্যার ঘেন্না, বিরক্তির তোয়াক্কা না করে প্রায় রাত্তিরে নীলছবির আসর বসায় ঘরে। গুটিকতক গাঁওয়াল ভাই আসরে তার নিত্য সঙ্গী হয়। তো এরকম এক রাত্তিরে দোকান থেকে ভাড়া করা নীলছবি দেখতে বসে আচমকা গদার সায়েব আনন্দের জীবনে প্রবেশ করেন। গ্রামে ডিভিডি ভাড়া খাটানোর ব্যবসায় নিয়োজিত দোকানি বুড়ো আনন্দকে তার এই নীলছবি দেখার বাতিকের জন্য খাইস্টা বুড়া নামে অহরহ পুকারে। আনন্দ ওসব গায়ে মাখে না। তার কাছে নীলছবি হচ্ছে সেই মাদক যা ভিতরের সকল জ্বালা-যন্ত্রণার আগুন নিভিয়ে মনকে শান্ত করে। নীলছবি ভাড়া খাটানোর ব্যবসায় পুলিশি কড়াকড়ি হঠাৎ তীব্র হলে দোকানি ‘নেও আনন্দ করো’ বলে একখানা ফরাসি মাল তাকে মাগনা গছিয়ে দিয়েছিল। কাহিনি অতঃপর ফরাসি ওই মাল দেখার সুতো ধরে উপসংহারে মোড় নিতে থাকে।

বলা প্রয়োজন, আনন্দের পর্ন-আসক্তির কাহিনি দর্শক মূলত তার কন্যা শিল্পার জবানিতে পর্দায় অভিনীত হতে দেখে। উচ্চশিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে থিতু শিল্পার সঙ্গে গাঁয়ের সাদাসিধে ছেলে জো-র ভাব ছিল। ছেলেটিকে ফুসলিয়ে দেহমিলনে বাধ্য করেছে এরকম কানকথা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন। মাথাগরম উঠতি বয়সী ছোকরাদের উল্টাপাল্টা সাক্ষ্যকে সত্য ভেবে গ্রামপঞ্চায়েত জো-কে ছাড় দিলেও শিল্পার ওপর খড়গহস্ত হয়ে উঠেন। ফুটবল খেলার মাঠে তাকে চাবুকপেটা নতুবা গ্রাম ছাড়ার রায় ঠুকে বসেন তারা। নীলছবির আসরে আনন্দের নিয়মিত সঙ্গী জগা ও হরিদেব পঞ্চায়েতের সদস্য হলে কী হবে গ্রামের সংস্কারে ঘা দিয়ে বসা শিল্পাকে এরচেয়ে কম শাস্তি দিতে অপারগ বলে জানায়। উচ্চশিক্ষার জন্য শিল্পার শহরে গমনের দিন ততদিনে ঘনিয়ে এসেছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সেটা ত্বরিত হয়। জগা ও হরিদেব অবশ্য পরে খবর নিয়ে জানতে পারে শিল্পার ঘটনায় সত্যের ভাগ অধিক ছিল না। নিজেদের ভুলের জন্য আনন্দের কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে তারা ঝামেলা মিটিয়ে নেয়। শহরে থিতু শিল্পার ওদিকে ছবি বানাতে ইচ্ছুক যুবক পাবলোর সঙ্গে চিনপরিচয় বেশ জমে ওঠে। ছবির জন্য মোক্ষম প্লটের তালাশে থাকা পাবলোর কাছে বাপের গদার-দর্শনের গল্পটি সে একটু-একটু করে বলতে আরম্ভ করে।

সে যা-হোক, ওই রাত্তিরে নীলছবি দেখতে বসা গাঁওয়াল ভাইলোগ অচিরে বুঝতে পারে দোকানি আনন্দকে ভুল ডিভিডি গছিয়ে দিয়েছে। ভুল করে গছানো ছবিখানা বলাবাহুল্য গদারের ব্রেথলেস  ছিল। ছবিটি দেখতে বসে সকলের বিরক্তি চরমে পৌঁছায়। গলতি ঢাকতে গাঁওয়াল ভাইদের ধৈর্য ধরার উপদেশ খয়রাত করে আনন্দ। সঙ্গীরা কী আর সহজে নিরস্ত হয়! সব ফুর্তি মাটি করে দিয়েছে টাইপের কথাবার্তা চলে ক্ষণিক। তাদের বকুনিকে পাত্তা না দিয়ে ছবিটি দেখবে বলে মনস্থ করে আনন্দ। এই প্রথম সে টের পায় ফুর্তির রসদ না থাকলেও ছবিটি অন্যরকম! নায়ক-নায়িকা সারাক্ষণ বকবক করে যাচ্ছে কিংবা কাপড়টাপড় খুলে অ্যাকশনে না নামলেও তাদেরকে দেখতে মন্দ লাগছে না! ইন্টারেস্টিং কোনো বিষয়ে তারা বোধহয় আলাপ করছে। নিজের গলতিকে বুঝ দিতে সচেষ্ট আনন্দকে গাঁওয়াল ভাইরা এই সুযোগে আচ্ছা মতো ঝাড়ে : এইটা ফিলিম? গান নাই, নাচ নাই, ফাইটিং সিন নাই, প্রেমপিরতি কুছু নাই, আর এইটা ফিলিম?

সঙ্গীদের ঝাড়ির উত্তরে আনন্দ বোধ করি তার জীবনের সেরা উক্তিটি করে বসে :— এর জন্য এইটা ফিলিম। ইন্টারেস্টিং। ডাইরেক্টার নতুন কিছু করতে চাইছু মনে হয়। গদার স্বয়ং তার এই উক্তিকে বাহবা দিতেন নিশ্চয়। নিজের ছবি পর্ন  না পলিটিক্যাল  অথবা দুটোই ইত্যাদি নিয়ে ফরাসি সায়েব বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন জীবনে। দুটোর কোনো একটা অথবা একসঙ্গে দুটো যখন হয় তখন সিনেমা বিপ্লবের ভাষায় নিজেকে নিঃস্ব করে বলে উক্তি ঠুকেছেন বহুবার। ঠিক যেমন, নিজের দেহকে দেখতে পারাটা পর্নপলিটিক্যাল  দু-রকম অভিজ্ঞতা মানুষকে উপহার দেয় বলে ভাবতেন গদার। আনন্দের ‘ডাইরেক্টার নতুন কিছু করতে চাইছু’ উক্তিখানা সে-রকম বটে! এটা তাকে পর্ন থেকে বেরিয়ে অন্যরকম ছবির দিকে টানছে। অন্যরকম ছবিটি যদিও কামাচার ও ভালোবাসায় প্রভেদ করা কেন জটিল এরকম এক তর্কে মোড় নিতে গিয়ে মানুষের দেহকে দ্রষ্টব্য করেছিল একদিন।

ব্রেথলেস  তো সেই ছবি যেটি মানবদেহকে তদন্তের অধীন করে তুলেছিল। কথিত আধুনিক সমাজে মানুষের দেহ কীসের টানে চলে? অনুভূতির টানে ওটা চলে কি? ভালোবাসা কি দেহকে টেনে নিয়ে যায়? কামাচার কি নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে সেই চলায়? আজব এই মানবদেহের সত্বাধিকারী কি ব্যক্তি স্বয়ং? দেহ কি তাহলে সামাজিক একক? সত্ব নামক ব্যাপারখানা কি তবে রাজনীতি নিরপেক্ষ? নাকি রাজনৈতিক চর রূপে মানুষের ঘাড়ে চড়ে সে নাচে? আত্মা কি আজো দেহে বসত করছে? এই উপসংহারে কি তবে পৌঁছানো যায়, আধুনিক সমাজে দৌড়ের উপ্রে থাকা মানবদেহ আত্মাহীন, অনুভূতিহীন, ভালোবাসার নামগন্ধহীন জান্তব কামশক্তির ভাগাড়? দেহকে ভাবতে বসে ব্রেথলেস-এ গদার প্রশ্ন তুলেছিলেন : Is there a difference between eroticism and love? উত্তর বলাবাহুল্য মিলেছিল তাৎক্ষণিক : I don’t think so, because… eroticism is a form of love, and vice versa.

তো এ-রকম বকুনিভরা আজব একখানা ছবি উড়িষ্যার গণ্ডগ্রামে বসে মানবদেহকে নির্জলা কামশক্তির ভাগাড় ভাবতে অভ্যস্ত এক লোকের সামনে আচমকা হাজির হয়েছে। পর্ন দেখার সহজ নেশার বাইরে নতুন কিছু দেখতে তাকে চাপ দিচ্ছে। নাচ, গান, মারপিট আর প্রেম-পিরিতি বা শরীরী খেলায় জ্যান্ত ছবি তো বুড্ডা আনন্দ জীবনে কম দেখেনি! এই প্রথম বিপরীত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে। রসকষহীন একটা ছবি ‘ডাইরেক্টার নতুন কিছু করতে চাইছু’-র মতো উক্তি ছুঁড়তে তাকে বাধ্য করছে! দর্শককে নতুন কিছুর সম্মুখীন ও তাকে ভাবতে বাধ্য করার নাম হলো আবিষ্কার। একটি সিনেমায় দর্শক যখন ‘নতুন কিছু’ খুঁজে পায় তখন তাকে নির্বোধ বিনোদন নিতে ব্যস্ত ভাবার পরিসর সংকীর্ণ হয়ে আসে। আনন্দকে যেমন নির্বোধ ভাবা সম্ভব নয়। ব্রেথলেস-র মাথামুণ্ডু না বুঝলে কী হবে ‘নতুন কিছু’ রূপে ছবিটিকে শনাক্ত করতে সে কিন্তু ভুল করেনি। তার এই ক্ষমতার কথা ভাবলে ছবির কিচ্ছু বোঝেনি দাবি করাটা সত্যের অপলাপ হয়!


গদার এইবেলা আনন্দকে আরেক ধাপ কৌতূহলী করে তোলেন। তাঁর একাধিক ছবি সে যোগাড় করে। সাবটাইটেল বুঝতে ইংরেজি শেখার ভূত চাপে ঘাড়ে। কন্যার কাছে ধরে-ধরে ইংরেজি শিখতে শুরু করে আনন্দ। বাপ-বেটির সম্পর্কে এতদিন যে-দূরত্ব ছিল সেটা এই সুবাদে অনেকখানি হ্রাস পায়। বাপের প্রতি ভালোবাসা তীব্র না হলেও ঘেন্না কমতে থাকে। পর্ন-আসক্ত আনন্দ ক্রমশ গদার-আসক্ত দর্শকে মোড় নিতে শুরু করলে তারপর কী ঘটতে চলেছে এরকম এক কৌতূহল পরিচালক ছবিতে বেশ ভালোই জিইয়ে রাখতে পেরেছেন। ফরাসি সায়েব ফিল্মে কী বোঝাতে চাইছেন তার সব কুছ ঠাহর করতে না পারলেও আনন্দের কাছে সত্যটি বড়ো হয় সেখানে :

গদার সায়েব বিরাট ভাবুক লোক বটে! ছবিতে গুরুতর কথাবার্তা বলছে সে। মানুষকে মগজ খাটানোর কথা বলছে বোধহয়। মগজ না খাটালে কি আর জীবনে উন্নতি করা যায়! সে বা তার গ্রামের লোকগুলো তো ওই কিছু ভাবতে পারে না দেখে গরিব থেকে গেল জীবনভোর! গ্রামের উন্নতি চাইলে গদারকে তাই সকলের দেখা প্রয়োজন।

স্বরচিত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে পর্ন ছবির বাইরে অন্যরকম ছবির স্বাদকে আনন্দ তার দেহে জায়গা করে দেয়। গদারকে সে কতটা কী সংযোগ করতে পেরেছে সেই বিষয়টি এখানে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফরাসি সায়েব জীবনে প্রথম নিজের চারপাশকে অন্য চোখে দেখার সূত্রটি তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন;—সত্যটি এইবেলা জঁ-লুক গদারের ছবির গুরুত্বকে ছাপিয়ে যায়। আনন্দকে অগত্যা রাজনীতি-নিরপেক্ষ সত্তা ভাবা কঠিন করে তোলেন পরিচালক। গদারের যুক্তি মান্য করলে বুড্ডা আনন্দ আপদশির রাজনীতি বিজড়িত এক সত্তায় (Political Entity) বাঁক নিতেছে বলা যায়। মেয়ে শিল্পা উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যেতে চাইলে সে তাই আপত্তি ঠুকে বসে। গদারের ছবি দেখার সুবাদে তার মনে ধারণাটি ততদিনে দৃঢ়মূল হয়েছে যে আমেরিকা দেশটি সুবিধার নয়। মেয়েকে আমেরিকা যেতে মানা করে সে : No, You will not go America. Because…America has become naughty.

তার ছেলে যবে আমেরিকায় পাড়ি জমায় আনন্দ তখন নিছক সাদাসিধে লোক ছিল। পরিস্থিতি ইতোমধ্যে পাল্টে গেছে অনেকখানি। গদার সায়েব কোন ফাঁকে তার জীবনে ঢুকে সব গুবলেট করে দিয়েছেন। তার মধ্যে এক বুদ্ধিজীবীর জাগরণ ঘটতে চলেছে। গদারের বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-এ দাঁড়িয়ে আমেরিকাকে নির্ধারণের ক্ষমতা না থাকলেও দেশটি যে বদের হাড্ডি এটুকু ইতিহাসজ্ঞান সায়েবের ছবি থেকে সে মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছে। রস-পরিহাসে সোজাসরল গ্রাম্য জীবনকে অমর্ত্য বেছে নিলেও গদারকে উপজীব্য করে যেসব ঘটনা সেখানে ঘটে সেগুলোকে ছবির পাঞ্চলাইন বলা যায়। আনন্দের আমেরিকাকে পাজি ভাবতে পারা তার একটি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস  কি তবে এই গোস্বা থেকে কোনোপ্রকার ব্যাখ্যা ছাড়া অমর্ত্যর ছবিখানাকে গদারের দুর্বল অনুকরণ (A poor imitation of Godard) শিরোনামে পাঠকদের পাতে তুলে দিলেন? হতেও পারে।

মার্কিন মুল্লুক সহ তামাম পশ্চিমা বিশ্ব যদি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে থাকে তবে তাকে ভালো বলার সঙ্গে সে কী কারণে পাজি সেটা বুঝতে পারা জরুরি বৈকি। রাজনীতি সচেতনার জন্ম এখান থেকেই হয়। আনন্দের মতো লোক যখন আমেরিকাকে পাজি-নচ্ছার বলে বুঝতে শিখে তখন সচেতনা সমাজের ওপরতলা থেকে নিচের দিকে চুঁইয়ে নামছে ধরা যায়। এতে করে রাতারাতি সব পাল্টে যায় না কিন্তু আনন্দের ন্যায় সমাজের তলানিতে বিচরণে বাধ্য লোকের চৈতন্যে ভাবতে শেখার ফুলকিটা হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে। সায়েবসুবোর দেশে জন্ম নেওয়া গদার কিংবা হাড়হাভাতে ভূবর্ষে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরে ঋত্বিক ঘটক এই একটি কথাই তো আওরে গেলেন জীবনভোর : ভাবো, ভাবতে শেখো, তবেই না নিজেকে চিনতে পারবে। বুঝতে পারবে তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো। কার হয়ে জীবন বরবাদ করে যাচ্ছো। আনন্দের একচিলতে উঠানে গদার এইবেলা ভাবতে শেখার বার্তা নিয়ে হাজির থাকেন।

গদার তাকে এতটাই উৎসাহী করে তোলেন যে গ্রামে তাঁর ছবি দেখানোর ভাবনা মাথায় জেঁকে বসে। গ্রামের লোক জীবনে প্রথম নাচা-গানা-মারপিট আর ঝাকানাকা প্রেম-পিরিতি ও পর্নগন্ধি যৌনরসে বোঝাই সিনেমার বাইরে রসকষহীন অবোধ্য ছবি দেখার বিড়ম্বনায় পতিত হয়। আনন্দ ও গাঁওয়াল ভাই জগা লোকের হাতে পিটুনি খাবার ভয়ে ছবি দেখানোর সকল দায়িত্ব হাবাগোবা মূক যতিন আর টোটো নামে এক যুবকের ঘাড়ে চাপায়। মোক্ষম মুহূর্তে নিজের পিঠ বাঁচানোর ভাবনা কি তবে কাপুরুষের লক্ষণ? পাবলো যে-কারণে মন্তব্য ঠুকে বসে : তোমার বাপ একটা কাপুরুষ, এটা বলতেই হবে। বাপের আচরণকে শিল্পা অবশ্য কেউ নিখুঁত নয়   দাগিয়ে লঘু করতে  ত্রুটি করেনি।

শিল্পার বক্তব্য মিথ্যে এমন নয়। কথাটি তবু বলতেই হচ্ছে, আনন্দ ও জগার মেরুদণ্ডহীনতার কারণ বোঝার ক্ষেত্রে তার যুক্তি খুব একটা কাজে আসে না। দুজনের মেরুদণ্ডহীন আচরণকে পরিচালক ছবিতে যেভাবে দেখিয়েছেন একে চিরন্তন দ্বিধাজড়তা নামে চিহ্নিত করাই যৌক্তিক ছিল বোধহয়। অবাককরা ব্যাপার হলো পাবলো ও শিল্পা জরুরি এই প্রসঙ্গে বাড়তি দু-কথা যোগ করার পরিবর্তে অন্য আলাপে গমন করে! স্মরণ রাখা বেহতর, আনন্দের কাতারে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো লোকগুলো পরিবর্তনের জন্য তেতে উঠতে কালবিলম্ব করে না কিন্তু মোক্ষম সময় ঘনিয়ে এলে দ্বিধাজড়তা তাদের সত্তাকে গ্রাস করে ফেলে। সমাজ-পরিবর্তনের ঝাণ্ডা উড়ানো শিক্ষিত বিপ্লবীরাও এই ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি। পরিবর্তনের মহেন্দ্রক্ষণ নজদিক হলে তাদেরকে একই জড়তায় কাবু হতে দেখেছে মানুষ। কেউ নিখুঁত নয়;—শিল্পার এই বক্তব্যকে যে-কারণে সরলীকরণ ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। পরিচালক যদি এদিকটায় দৃষ্টি দিতেন তাহলে ছবির ভরকেন্দ্র আরো মজবুত হতো। যে-লঘু বয়ানে ঠেকনা দিয়ে দর্শককে গল্পটা বলা হয়েছে সেখানে দ্বিধাজড়তার মতো প্রসঙ্গ ছবির গতিকে বিব্রত ও গুরুগম্ভীর করে তুলবে ভেবে তিনি বোধ করি সেদিকে পা বাড়াননি।


ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনে বিভক্ত সমাজে যারা পরাজিত তাদেরকে দাবিয়ে রাখার অনেকগুলো গণ্য কারণের মধ্যে দ্বিধাজড়তা একটি। স্বয়ং গদার তাঁর ছবিতে এর কার্যকারণ বিচিত্র পথে বোঝার চেষ্টা করেছেন। ফরাসি সায়েবের কল্যাণে নিজের অবস্থানের দিকে তাকানোর শক্তি আনন্দের দেহে ঢুকলেও শক্তিটা এমন নয় যে বাকিদের দেহে সে ওটা ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। গ্রামবাসীর গদার-দর্শন যারপরনাই ব্যাপক হট্টগোল, আয়োজকদের গোষ্ঠী উদ্ধার আর ওদিকে হাবা যতিনকে গণধোলাইয়ের রঙ্গ-পরিহাসে ইতি টানতে বাধ্য হয়।

এটা পরাজয় সন্দেহ নেই। শেষ বয়সে নির্মিত ছবির একটি দ্য ইমেজ বুক-এ গদার উক্তি করেছিলেন : আমি গরিবের পক্ষে, কারণ তারা পরাজিত। ফরাসি সিনেমাকার উক্তি ছুড়ে খালাস হলেও অমর্ত্যর ছবি সারসত্যটি তুলে ধরেছে : পরাজিতরা কখনোই তাদের পক্ষে থাকা গদারকে নিতে পারবে না। ঋত্বিক-মৃণালকে তারা নিতে পারেনি। গদারকেও পারবে না। পরাজিতদের বিশ্বে এঁনারা হলেন সেই মনুমেন্ট যাকে ছুঁতে গেলে আলোকায়নের প্রয়োজন অন্তিম হয়। আলোকায়নের আলো আবার ঐতিহাসিকভাবে সমাজের একটা স্তর অবধি পৌঁছায় ও সেখানে নিজেকে গুম করে। আলোটা চুঁইয়ে পড়ে না তাদের স্তরে যাদেরকে গদার পরাজিত বা Defeated  বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁর ছবিতে।

আনন্দ এখন নিজের সাধ্য মোতাবেক গদারকে দেহে একীভূত করলেও তার স্তরের বাকিরা এর বাইরে পড়ে থাকে। ক্ষমতা ও শ্রেণিরাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বাইরে পড়ে থাকার গণ্য কারণ হয় সেখানে। এইসব প্যাঁচরহস্যের জট ছবির পর ছবিতে খোলার চেষ্টা করেছেন গদার। পরিতাপের বিষয় হলো পেজগিভরা মানবসমাজের বিচিত্র জট খুলতে সদা তৎপর সিনেমাকারকে সমাজের তলানিতে সুগম, সহজ করা সম্ভব হয়নি। কোন সড়ক ধরে যাত্রা করলে আনন্দের স্তরে পড়ে থাকা লোকগুলোর কাছে তিনি পৌঁছতে পারেন সেটা তাঁর নিজের কাছেও অজানা ছিল মনে হয়। সড়কটি হয়তো ছিলই না কোনোদিন! গদার যে-কারণে সেটা খুঁজে পাননি। এমন হতে পারে, কিছু দূর যাওয়ার পর সড়কটি নিখোঁজ দেখে যাত্রায় ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি!

মনে পড়ছে এখন, মাও সে-তুংয়ের চীনা লাইন বা বিখ্যাত রেড বুক  হাতে নিয়ে শ্রেণিশত্রু খতমের লাইনটাকে একদা গোনায় নিয়েছিলেন গদার। মার্ক্সবাদের অন্ধিসন্ধি বিষয়ক আলাপ তাঁর ছবিগুলোয় আকছার চোখে পড়ে। সেই গদারকে জীবনের পড়ন্ত বেলায় দর্শক বলতে শুনছে :

সমাজতন্ত্র কি কভু জিন্দা ছিল? যদি থাকে তবে সেটা ওই একবার, বিরতিসহ ৪৫ মিনিটে ভাগ করা খেলার সময় জুড়ে। বুদাপেস্ট থেকে আসা হোনভেদ সেদিন ইংল্যান্ডকে ৬৩ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা যার যার মতো খেলছিল আর হাঙ্গেরি খেলছিল সকলে মিলে। [দ্রষ্টব্য : নোতরে মিউজিক : জঁলুক গদার, ২০০৪]

সকলে মিলে জানপ্রাণ লড়িয়ে খেলার ভাষা যখন সমাজে অবলুপ্ত হয় তখন ভাবতে শেখার সড়ক মুছে যায়। তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আনন্দের গদারবীক্ষণে অমর্ত্য এইসব মাথাভারী প্রসঙ্গকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। পরিচালক এড়িয়ে গেলেও কাহিনিকে এমনভাবে বুনোট করা হয়েছে যে পরাজিতদের পক্ষে থাকা গদারকে সংযোগ করতে না পারার সমস্যা নিয়ে দর্শক মাথা ঘামাতে বাধ্য হয়। অ্যাডিউ গদার-র নির্মাণশৈলী এদিক থেকে মৌলিক। এই প্রথম কোনো ছবি নিজস্ব স্থানকালের পরিসরে ফরাসি সিনেমাকারের ভবিতব্য নিয়ে ভাবনা করেছে। কেবল এর জন্য একখানা স্যালুট তিনি দাবি করতেই পারেন।


গ্রামবাসীকে গদারের ছবি দেখিয়ে তাদের আক্কেলজ্ঞান বৃদ্ধির উদ্যোগে পরাভূত আনন্দ অতঃপর অমর্ত্যর ছবিতে গৌণ হওয়ার নিয়তিটা মেনে নেয়। গল্পকে এগিয়ে নিতে পরিচালক শিক্ষিত দর্শকের ভীষণ প্রিয় Twist বা বাঁকবদল ব্যাপারখানাকে ছবিতে আমদানি করেন। আনন্দের গদার-আসক্তি নিয়ে পাবলোর সঙ্গে আলাপে লিপ্ত থাকার ছলে শিল্পার নিজের গল্প ক্রমশ ছবিতে জায়গা জুড়তে থাকে। কাল্পনিক ও বাস্তবের বিভ্রম বিষয়ে গদার তাঁর ছবিতে যত কথা বলেছেন সেগুলো এখন ওই দুজনকে দিয়ে পরখ করান অমর্ত্য। ছবির উপসংহার ঘনিয়ে আসার প্রাকক্ষণে শিল্পা জানায় গ্রামের সোজাসরল ছেলে জো কাছে কুমারিত্ব হারানোর কাহিনিটি মিথ্যা ছিল। পাবলোর ছবিতে নতুন গল্প ও চরিত্র আমদানির ভাবনা থেকে ওটা সে বানিয়ে বলেছে। ধানখেতের পাশে খড়ের গাদায় কুমারিত্ব হারানোর কাহিনি মিথ্যা হতে পারে কিন্তু জো নামের চরিত্রটি (Character) মিথ্যা নয়। শিল্পার কথায় পাবলো যেন ধপ করে বিভ্রান্তির কূয়োয় গিয়ে পড়ে! শিল্পা সত্য না মিথ্যা বলছে সে—কথা ভেবে হয়রান হয় সে। তাকে প্রশ্ন ঠোকে : তার মানে তুমি বলতে চাইছো জোর গপ্পোটা আষাঢ়ে? প্রশ্নের জবাবে শিল্পা যেন-বা জঁ-লুক গদারকে আওড়ায় ক্ষণিক : গল্প কাল্পনিক হতে পারে কিন্তু চরিত্রটি তা নয়।

গদারীয় পরিহাস মিশিয়ে করা শিল্পার উত্তর পাবলোর জন্য ফাঁদে পরিণত হয়। কাল্পনিক থেকে বাস্তবকে পৃথক ভাবার অবকাশ সেই ফাঁদে পা দিয়ে অবলুপ্ত হতে থাকে। যে-ছবিটি সে বানাতে চাইছে সেখানে শিল্পার কুমারিত্ব হারানোর গল্প ভীষণ চার্মিং ছিল তার জন্য। ভারতীয় দর্শককে ওটা বিবাহ বহিভূর্ত যৌনমিলনের ব্যাপারে সমাজ যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন সেগুলোকে গোপনে ভগ্ন হতে দেখার সুখ দিয়ে যায়। শিল্পার কথা অনুযায়ী তার কুমারিত্ব হারানোর ঘটনা কাল্পনিক হলে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের রোমাঞ্চ পর্দায় দেখিয়ে বাজিমাত করার যে-ভাবনা পাবলোর মনে ঝড় তুলছিল সেটা আর চনমনে থাকছে না। ওদিকে মুখে ব্যাপার না বললেও গ্রামের এলেবেলে এক ছোকরার কাছে কুমারিত্ব খোয়ানো পাবলোকে ঈর্ষাতুর করে খানিক, যেহেতু শিল্পার দেহকে ততক্ষণে নিজের সম্পত্তি বলে ভাবতে শুরু করেছিল সে! তাকে যদি কুমারিত্ব হারাতে হয় তবে সেটা পাবলোকে দিয়ে ঘটা সমীচীন, জো  কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে নয়! হবু ছবিকারের মনোগহিনে এ-রকম এক বাসনা যে বেশ অকাট্য হয়ে উঠেছে সেটা ছবি দেখতে বসে দর্শক টের পায় বৈকি। ছবির মধ্যে এইসব দুটানা গদারকে বেশ মনে করিয়েও যায়।

নারীকে যে-জায়গা থেকে তিনি এক-সময় পাঠ করেছেন অমর্ত্যর ছবি সেই ফেমিনিজমকে এখানে নকল (Imitate) করেছে। পাবলোর সঙ্গে দেহমিলনের প্রাক মুহূর্তে শিল্পা জানিয়ে দেয় তাকে ভালোবেসে নিজের দেহ সে ভোগ করতে দিচ্ছে না। পাবলো ওটা মনে-মনে চাইছিল বলে দিতে রাজি হয়েছে। দেহ থেকে প্লেজার  শোষণ করার হক নারী, পুরুষ উভয়ের জন্য সমান গণ্য হওয়া উচিত। শিল্পা যদিও প্লেজার  চাইছে কি না পাবলো সেটা যাচাইয়ের কথা একবারও ভাবেনি। তা-সত্ত্বেও পাবলোর মনে চাগিয়ে ওঠা প্লেজার  নামক কুখ্যাত বাসনা অপূর্ণ থাকুক এটা সে চাইছে না। অর্থ কিন্তু এই নয় তাকে ভালোবেসে নিজের দেহে ঢুকতে দিচ্ছে সে। যদি তাই হতো তাহলে কনডম পরার জন্য জোর খাটানোর প্রয়োজন হতো না। পেট বাঁধার ভয়ে অতটা নয় বরং নিজের দেহকে পাবলোর থেকে আড়াল করতে তাকে কনডম পরতে জোরাজুরি করছে শিল্পা। মিলন শেষ হলে এরকম এক পুরুষকে নারীর জীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে কনডম কাজে দেয়! শিল্পা এক্ষণে মোক্ষম সংলাপখানাই ঝাড়ে : The thin sheet of rubber called the condom kept you away. How I love the condom.

কনডম পরিধান করায় পাবলো আদতে তার দেহে নয় বরং কনডমে নিজেকে নিঃসরণ করতে বাধ্য থাকছে। সুতরাং প্লেজার  নিতে উতলা পুরুষের অতিরিক্ত কিছু তাকে আর না ভাবলেও চলছে তার। জো সঙ্গে তফাতটা এখন পাবলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে শিল্পা! গ্রামে থাকার দিনে সাদাসিধে জো  কিছু পাওয়ার আশা না করে তাকে ভালোবেসেছিল। তার সঙ্গে মিলনে কনডমের প্রয়োজন পড়বে না। আড়ালটা সেখানে অবান্তর। শিল্পা এইবেলা পাবলোকে জানিয়ে দিতে দ্বিধা করে না, তার ছবিতে অভিনয় করা আর তাকে ভালোবাসতে পারা এক জিনিস হতে পারে না। গ্রামপঞ্চায়েতের লোকগুলোর সঙ্গে হবু সিনেমাকারের পার্থক্য নেই। তার কুমারিত্ব নিয়ে গ্রামের মাতবররা সন্দিহান ছিল। ঘটনাটি মিথ্যা বলার পর থেকে পাবলোও সত্য-মিথ্যার দোলাচলেই ভুগছে। শিল্পার কথার চেয়ে সামাজিক সংস্কার তার মনে ক্রমশ অটল হতে চলেছে। অহংসর্বস্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে যে-পুরুষ অহর্নিশ নিজের মধ্যে বহন করছে তার পক্ষে পর্ন  বানানো সম্ভব কিন্তু সিনেমা নয়।

ছবির এই জায়গাটি গদারকে স্মরণ করতে বাধ্য করে। নাম্বার টু  ছবির বয়ানে সান্দ্রার বর তাকে পরকীয়ায় লিপ্ত সন্দেহ করে খেপে উঠেছিল। প্রতিশোধ নিতে স্ত্রীকে পায়ুসঙ্গমের নামে রীতিমতো ধর্ষণ করে সে। তাদের ছোট্ট মেয়ে ভেনেসা সেটা দেখে ফেলায় বিপত্তিতে পড়ে দুজন। বাবা-মায়ের সম্পর্কের মাঝখানে এই বীভৎসতা ছোট্ট ভেনেসাকে জটিলতায় ফেলে দেয়। ধর্ষণতুল্য সঙ্গমের ধকল সান্দ্রার কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বরকে অচেনা ও বহিরাগত ভাবতে বাধ্য হয় সান্দ্রা। লোকটি যখন-তখন তার ঘরে ঢুকছে। প্রাতরাশ বা ডিনারের হুকুম দিচ্ছে। তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, সম্মতি, অসম্মতির মূল্য সেখানে নেই! সান্দ্রা তবু ছেলে-মেয়ের কথা ভেবে লোকটির অযাচিত অনুপ্রবেশকে না করতে পারছে না। একসঙ্গে সচল একাধিক টেলিভিশনের ফ্রেমে ঘটতে থাকা ঘটনা তুলে ধরে যে-ছবি তার একটায় ঢুকে নিজের দেহকে অবিরত খুঁজে ফিরে সে। ছবির অন্তে পৌঁছে ধর্ষণতুল্য পায়ুসঙ্গম ও কোষ্ঠকাঠিন্যর জটিলতায় গুম সান্দ্রা ফ্রান্সে নারী বলতে কী বোঝায় তার সারাংশ টানে। দর্শক তাকে বলতে শুনে :

My tissue is cracking. I feel like everything I say is shit. All that I do. All that should happen in the ass…happens elsewhere. In the ass…nothing’s happening. I do the cooking. It goes in, it goes down…but nothing comes out. I’m becoming shitting and a shit. Are there many women like that in France? SHIT… [দ্রষ্টব্য : নাম্বার টু : জঁলুক গদার, ১৯৭৫]

সান্দ্রা যেটি পারেনি অ্যাডিউ গদার-এ শিল্পা সেটা পেরেছে। নিজেকে মলখণ্ড ভাবার আগে পাবলোকে একহাত নিতে পেরেছিল সে। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে অটল সমাজে মলখণ্ডের নিয়তি অবশ্য এতে করে এড়ানো যায়নি। পাবলোর সঙ্গে তার আলাপ ও দেহমিলনের মুহূর্তগুলো সিনেমা অথবা পর্ন  হয়ে আনন্দের গ্রামে পৌঁছে যায়। পরিচালক ইচ্ছে করে একটা অস্পষ্টতা এখানে রেখে দিলেন মনে হচ্ছে। পাবলোর সঙ্গে শিল্পার আলাপ ও দেহমিলন সিনেমা নাকি ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপস সেটা ছবিতে পরিষ্কার নয়। ভারতীয় নীলছবি দেখার উত্তেজনায় গদার থেকে পুনরায় পর্নের জগতে ফিরে যাওয়া আনন্দের হাতে ওটা পৌঁছে যায়। আত্মজাকে অনাকাঙ্ক্ষিত দেহমিলনে লিপ্ত দেখার ধকল সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিতে বাধ্য হয় বেচারা। তার এই আত্মহনন গদারকে ফের প্রাসঙ্গিক করে গ্রামে। ফরাসি সায়েবকে গ্রামে ঢোকানোর অপরাধে আনন্দকে পাপী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাপী ঘোষণার দৃশ্যটি ছবিতে মোটেও যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। যৌক্তিক করতে কাহিনিতে সংযুক্তি প্রয়োজন ছিল। অমর্ত্যর ছবির খামতি বলতে এটুকুই।

খামতিকে অবশ্য অন্যদিক থেকে ভাবা সম্ভব। অনুমান করাই যায়, গদারের ছবি গ্রামবাসীর বিনোদিত হওয়ার সরল ছক তছনছ করে দিয়েছিল। ঝাকানাকা ছবি দেখতে বসে সায়েবের আজব ছবি দেখার ধকল তাদের মনে নিত্য বিরাজ করে। গদার নামধারী অনাবশ্যক উৎপাতকে তারা ভুলে থাকতে চায় কিন্তু সে তাদের ঘাড়ে চড়ে নাচে। ঝাকানাকা বিনোদন সেক্ষেত্রে গদার ওরফে গদরা ওরফে গডার্ড সায়েবের দোষে আগের মতো নির্জলা মন নিয়ে তারা উপভোগ করতে পারে না। কাহিনি তামাদি করতে গ্রামের কট্টর স্বভাব যুবক গদারকে স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক বলে ঢেরা পেটায় জনে-জনে :

গদার…গদরা…আরে ধুত্তোর গডার্ড…না গদার সায়েব…মুই গাঁওবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য অতিশয় ক্ষেতিকারক। গেরামে কেউ যদি তার নাম মুখে আনে সেইটা সে পাপ করছে বইলা ধরা হবে। কঠিন শাস্তি পাইতে হবে তাকে। [দ্রষ্টব্য : অ্যাডিউ গদার : অমর্ত্য ভট্টাচার্য, ২০২১]

পর্ন-আসক্ত থেকে গদার-আসক্তে রূপান্তরিত আনন্দ ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক গদারের মাঝখানে যা-কিছু অবশিষ্ট তার সবটাই বহাল তবিয়তে উড়িষ্যার গণ্ডগ্রামে বেঁচেবর্তে থাকে। অশিক্ষা ও সংস্কার বেঁচে থাকে। ঝাকানাকা বিনোদন বহাল থাকে যথারীতি। নীলছবি ও রাজনীতি আগের মতোই বিরাজ করেন গ্রামে।

গদার তাঁর সিনেমায় মৃত্যুকে একমাত্র অরাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বলে বুঝে নিয়েছিলেন। মরণের পর কোনোকিছু পেরোনোর থাকে না। নীরবতায় গুম হয় সবই। অ্যাডিউ গদার-এ অমর্ত্য ভট্টাচার্য ভারতীয় পন্থায় মৃত্যু-অভিলাষী গদারকে বোধ করি প্রতিহত করেন। মৃত আনন্দকে তিনি পুনরায় জাগিয়ে তোলেন। খরায় ফাটা খেত ধরে সে দুদ্দাড় ছোটে গদারের সঙ্গে দেখা করবে বলে। গদারের নাগাল পেতে ফ্রান্সে পা দিতে হয় না তাকে। ফরাসি সায়েব স্বয়ং তার সঙ্গে দেখা করতে গণ্ডগ্রামে পা রাখেন। খেতের কোণে কাকতাড়ুয়া এক গদারকে সে পেয়ে যায়। এই গদার বালাইনাশক। জীবিত গদারের চেয়ে অধিক কার্যকর। আনন্দ পরম আহলাদে তাঁকে নিয়ে ছেলেমানুষী উচ্ছাসে মেতে ওঠে। বাস্তবে নাই-বা হলো, কাল্পনিক এক বিশ্বে জীবিত জঁ-লুক গদার কাকতাড়ুয়ার বেশে পরাজিতদের সঙ্গে শরিক হতে মাটিতে নেমে আসেন।

বাস্তবে যাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনভোর কথা বলেছেন, তাদেরকে ‘ভাবো, ভাবতে শেখো’-র বার্তা দিতে ত্রুটি করেননি, এখন উড়িষ্যার গণ্ডগ্রামে কাকতাড়ুয়ার বেশে দাঁড়িয়ে থাকা বালাইনাশক গদারকে পরাজিতদের একজন আনন্দ দুচোখ ভরে দেখার সুখ মিটিয়ে নিতে থাকে। ছবির এই দৃশ্যকে সাবলাইম মানতে হয়। গদার ও আনন্দের মধ্যে যে-দূরত্ব বাস্তবিক ঘুচবার নয়, অলীক বাস্তবে গমন করলে সেই দূরত্বটি থাকে না, আর সিনেমা হয়ে ওঠে এমতো আধেয় যেটি মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। বাস্তবতাকে হত্যা করে কাল্পনিকের জাগরণকেই তো গদার একদিন বাস্তবে ফেরত যাওয়ার উপায় বলে মন্তব্য করেছিলেন। লা শিনোয়েজ-এ চরিত্রের মুখ দিয়ে চিরকালীন উক্তিটি বেরিয়ে এসেছিল : মানছি কাল্পনিক কিন্তু এটা আমায় বাস্তবে নিয়ে যাচ্ছে।


ধারণা করি গদার এখন বেঁচে থাকলে অমর্ত্যর ছবিখানা পছন্দ করতেন। ছবিটি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে নয় বরং আলিঙ্গনের বাসনা থেকে পর্দায় অবমুক্ত হয়েছে। তথাকথিত আর্টহাউজ  ছবির পথে না হেঁটে নিজ স্থানকালের অনুপাতে গদারকে শৈল্পিক উপায়ে প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব;—এই প্রমাণ নির্মাতা রেখেছেন। যে-গদার চিরকাল স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক রূপে পর্দায় হানা দিয়েছেন তাঁকে ছবিটি বুকে টানতে দ্বিধা করেনি। স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক গদার হলেন সেই বিষ যাকে দেহে টানতে পারলে বিষক্ষয় ঘটে। অমর্ত্যর আপাত লঘুচিত্ত বয়ানকে যারপরনাই সায়েবদের কথায় শির ঝুঁকিয়ে দুর্বল অনুকরণ ভেবে খারিজ করার পরিবর্তে শির উঁচা করে জঁ-লুক গদারের আনন্দযাত্রা হিসেবে আমলে নেওয়া প্রয়োজন।


গানপারে গদার
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: