‘লোকভাষা’ শব্দটি বাংলাসাহিত্যে বেশদিন হয় চালু হয়েছে। তবে শব্দটির ব্যবহার সুনির্দিষ্ট নয়। অনেকেই মনে করেন লোকভাষা মানে গেঁয়ো বা আমজনতার ভাষা। যেখানে লোকভাষার বেশকিছু ভালো উদাহরণ রয়েছে। যেমন — মন্ত্র, ব্রতকথা, বিয়ের ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, ইডিয়ম ইত্যাদি। একটা বিষয় জানা দরকার যে লোকভাষা মানেই লোকসাহিত্য নয় কিন্তু লোকসাহিত্য মানেই লোকভাষা। লোকভাষা অনেকক্ষেত্রে লোকাচার সম্পৃক্ত, লোকভাষা অপরিবর্তনীয় যা গোষ্ঠীর স্মৃতিনির্ভর ও ঐতিহ্যবাহী। বিশেষ করে ভাটিময়াল লোকভাষার অপেক্ষাকৃত উর্বর স্থান। কেননা ভাটিময়াল লোকসংস্কৃতির সজীব মেদিনী। তাই আচারঘনিষ্ঠ এই লোকালয়ে লোকভাষার প্রয়োগ অধিক ও মনোমুগ্ধকর। যেখানে মনের ভাব প্রকাশে লোকভাষার যাদুকরী শক্তি আছে অতুলনীয়। তবে আচারবহিষ্ঠ লোকালয়ে লোকভাষার চেয়ে জনভাষার অধিক প্রচলন থাকে। আজকের এ-গ্রন্থটি ভাটিময়াল নির্ভরতারই কিঞ্চিৎ প্রয়াস। যেখানে কাব্যগুণের পাশাপাশি শব্দগুলো রসের ভাঁজে ভাঁজে বুনে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। বলতে গেলে, শব্দের জন্য কবিতা হয়েছে কবিতার জন্য শব্দ নয়। যার নাভিস্থান ভাটিময়াল ও লোকভাষাগোষ্ঠীর কাব্যআঙিনা।
সৌদামণি দাশ। সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর থানার নগদাপাড়া গ্রামের জেলেবধু। স্বামীর অকালমৃত্যুর পর নিঃস্ব হয়ে একমাত্র ছেলে সুরেন্দ্র দাশকে নিয়ে রাইয়তভিটায় ঘর বানিয়ে মাধুকরী করে জীবন চালাতে শুরু করেন। গাঁয়ের ছোট-বড়ো সকলেই তাঁকে ‘সুইরার মা’ এবং তাঁর ছেলেকে ‘সুইরা মাঝি’ বলে ডাকত। সময় ও বিষয় উপযোগী ‘সিমিস্যা’ শোনার জন্য সকলেই সৌদামণিকে ‘রসের বিনোদিনী’ মনে করতেন। ভাটিগাঁয়ের দুয়ারে দুয়ারে একমুষ্টি চালের জন্য তিনি জীবনঘনিষ্ঠ ‘বচন’ বিলাতেন গিরস্ত বধুদের কল্যাণে। বলতেন —
সুখ কর’অ গ সোনাবউ
খোদায় ত’রে দিছে,
আমারও আ’ছিল এমন দিন
খোদায় কাইড়া নিছে।
কখনও কখনও গিরস্তঘরের ‘আনাজপাতি’ কুটে দিতেন তিনি। মাধুকরীর সুবাদে এগ্রামে-ওগ্রামে ঘুরে পাওয়া গিরস্ত বউদের বাবার বাড়ির ও আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর তাঁর মুখে শুনতে বধুগণ ব্যাকুল হয়ে আদর করে বসতে দিতেন পিঁড়ি। কিন্তু আসনে বসার অভ্যাস তাঁর ছিল না। অবলীলায় মাটিতে বসেই কথার ডালা খুলতেন। খবর আদানপ্রদানের পাশাপাশি গেঁয়ো শব্দে বোনা ছড়া ও কথায় প্রাণ ভরিয়ে তুলতেন সকলের। নিজের শত দুঃখের মাঝেও মায়ার হাসি বিলাতেন অন্যের লাগি। হাসতে হাসতে বলতেন —
মুক্ক-সুক্ক মানুষ আমি, হুঞ্জি-হাট্টা নাই,
রঙের ময়ালে কথা বেঁচ্ছিয়া খাই।
গ্রামীণ জনজীবনের কথা ― শব্দ-রসে মালা গেঁথে সৌদামণি দাশ যে পদমাল্য রচনা করতেন তা স্মরণে ও স্মৃতিতে চাষবাস করেও এখন আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। মূলত তাঁর ‘লোকভাষা’ ও ‘জনভাষা’ ব্যবহারের যাদুই আমার শৈশবে এ-বিষয়ে ভালোলাগার বীজ বপন করেছিল। তাই এ-গ্রন্থটি রচিত হয়েছে লোকভাষা ও জনভাষার বিশেষ ব্যবহারে। যেখানে একজন সৌদামণির মতো পদকর্তার কাব্যশক্তির প্রভাব রয়েছে আমার কাব্যমননে দায়বদ্ধতার মেদি হিসেবে। তিনি যদিও শতবছর বেঁচে ছিলেন কিন্তু আমি কেবল তাঁর জীবদ্দশায় শেষকালে অল্প আয়ুর প্রতিবেশিই হতে পেরেছিলাম। হাড়লেপ্টানো চামড়ায় ভাঁজ-পড়া দেহটি তাঁর অনাহারের সাক্ষী হিসেবেই আমি কেবল দেখেছি। তাঁর কথা যত শুনেছি, বলা আমার তত হয়নি। একদিন এক-সুযোগে বলেছিলাম —
এই’তা (সিমিস্যা, ছড়া) আপনে ক্যামনে হিখ’ছইন?
তিনি হাসতে হাসতে উত্তরে বলেছিলেন —
বাপু —
আমার’অ একটা কথা
ব্যাঙের’অ একটা মাথা।
মুখে মুখে গাতি লাইন,
আন্ধাগুন্দা দড়ং বাইন!
শেষ লাইনটি অর্থাৎ ‘আন্ধাগুন্দা দড়ং বাইন’ আমি বুঝি নাই। তাই এ-বিষয়ের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন —
আরে বাপু!
দড়ং বাইন দেখছ’অ না?
ফাঁক-ফাঁক বাইন একচালা
অইয়া যায় দড়ং চায়-চালা!
এইতাও’ত এইতাই―
কইলেই’ত মিলে
মজা পায় হগলে।
তাঁর এ-কথাগুলো আজও ভুলতে পারিনি। গ্রন্থের নাম এরই সূত্র ধরে ‘দড়ং’ রাখা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, — তাঁর মাঝে এই শব্দভাণ্ডার ও পদরচনার শক্তি কীভাবে হলো? কার সান্ন্যিধ্যে ‘কথাপাঠ’ শুনে শুনে শ্রবণশক্তি বলে আজও অ-পুঁথিয়া ‘গাঁয়ের কবি’ হয়ে আছেন তিনি ভাটির ময়ালে? যা আমাকে একটি গ্রন্থ রচনায় বাধ্য করেছে? যে লোকভাষা, জনভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রতি ভালোলাগা সকলেরই আছে। এ নিয়ে অনেক কাজও হয়েছে, কিন্তু কিছু শব্দ ও তার প্রয়োগ এবং কার্যক্ষমতা এখনও মাতৃদুধের মতো আমাদের শিশুকাল গড়ে তুলে অদ্যাবধি ক্রিয়া করে। যার ঋণ স্বীকার করা এখন কেবলি মাতৃদায়ের অঞ্জলির মতো। এমনি কিছু ‘শব্দ’ কিছু লোকভাবনা নিয়ে আজকের কবিতার আসর ‘দড়ং’। যেখানে কবিতাগুলো ‘দড়ং বাইনের’ মতো সহজ এবং তার ডালপালা তেমনি ফাঁক ফাঁক হয়ে মেলেছে। যা হয়তো নমস্য কবিদের কাছে ‘অ-কবিতা’ হয়ে যেতে পারে কিন্তু লোকমানসে তা ‘কবিতা’ হিশেবে ঠিকানা করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস। দড়ং কাব্যপুথিটি পাঠ করতে সবিনয় তাগিদ রইল।
COMMENTS