এবার জমল খেলা! না। আমার কাছে খেলা জমার কিছু নেই। আমার কাছে মানুষের কোনো ভালোবাসাই অস্বাভাবিক মনে হয় না। ভালোবাসার, ঘর বেছে নেয়ার কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, শ্রেণি নেই (যদিও শ্রেণি-ডিঙানোই সবচাইতে কঠিন কাজ মনে হয় আমার কাছে), বয়স তো অবশ্যই নেই। জমল খেলা। মানুষ আরেকখান, যারে বলে জব্বর, বিষয় পাইল। কথা বলার। কথা তো নয়- খিস্তিখেউড়। বেচারি শীলা! এবার দেখবা পুরুষতন্ত্র কত প্রকার আর কেমন কেমন! দেখবা তোমার পয়গম্বর বাবা-কাকা-কাকিরা (বাবা তো বেঁচে নেই যদিও) আসলে বাংলাদেশেরই মানুষ। আর অবশ্যই পুরুষ। সবাই। পুরুষতান্ত্রিক। তুমিও তো তা-ই। তাহলে এর শিকার তুমি হলেই-বা আমি আশ্চর্যের কিছু হব কেন!
সে এক ঘটনা বটে পৃথিবীতে! যখন মারা গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। শাওনকে বিয়ে করাটাও একটা ঘটনা আছিল বটে। তবে মৃত্যুটাই হুমায়ূন আহমেদের জীবনে সবচেয়ে আলোকিত ঘটনা। সে কী মৃত্যু! যার তিন-চারশ থেকে চার-পাঁচটার বেশি বই আমি পড়িনি, পড়তে ইচ্ছে করেনি, সে-আমার গায়েও কেমন জ্বর উঠে গিয়েছিল টিভি দেখতে দেখতে। আহা রে মিডিয়া! মানুষের মন-মগজের তাপমাত্রা বাড়ানো কমানোতে তোর জুড়ি নেই! হ্যাঁ, সেই বিয়ের পরে — হুমায়ূন যে-সমস্যা ফেস করেছিলেন আর শাওন যে-সমস্যা ফেস করেছিলেন দুটোর চরিত্র ভিন্ন। মানুষ — মোদ্দা কথায় আপামর মানুষ — পছন্দ করেনি কাজটা — এর মানে হলো, হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে মানুষ এটা প্রত্যাশা করেনি (দেশের মানুষ যে কী প্রত্যাশা করে আর করে না — তারা চায়, এমনকি আপনি আপনার বউয়ের সাথে সঙ্গমে যাওয়ার সময়ও তাদের অনুমতি নিয়ে যাবেন!), আর শাওনের ক্ষেত্রে? সবাই ভেবেছে খারাপ মেয়ে। ধ্যান ভঙ্গ করেছে এক তারকা লেখকের। তো ধ্যানই যদি ভেঙে যায়, আমি সেটাকে ধ্যানীর সমস্যাই মনে করি! কিন্তু হলো কী — যা হয় সবসময় — দোষ শাওনের! সে-দোষ সে-অভিযোগ থেকে রেহাই বেচারি তার স্বামীকে হারানোর যন্ত্রণার সময়ও পায়নি। যেন সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সবাই। সেই পুরনো কেচ্ছা আবার আসলো — শাওনকে বিয়ে করার বিষয়টা ছাড়া হুমায়ূন তো আসলেই এক অমানবিক কিংবদন্তি! আর তাই দেখেছি, বড় বড় মানুষের (তথাকথিত) সংকীর্ণতা প্রকাশিত হতে এসব মুহূর্তে। এসব সংকীর্ণ প্রতিক্রিয়া আর আচরণ দোররা মারার চেয়ে কম ভয়ংকর নয়।
মনে পড়ে। কত মানুষকে দেখলাম সে-সময় কত সংকীর্ণ হয়ে উঠতে! এই তো আমাদের সমস্যা, আমাদের প্রগতির নমুনা — আমরা প্রগতির চর্চা করি, এবং মাঝে মাঝে আমাদের সুবিধামতো! সে হারিয়েছে তার স্বামী। পৃথিবীর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আর আপনি সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী অথবা ‘পরিজন’ এমনই নির্লজ্জভাবে শাওনকে উপেক্ষা আর অপমান করতে লাগলেন — মনে হলো — সেই যে, এই ডাইনিই নষ্ট করেছে আমার প্রবাদপ্রতিম ভাইকে, দেবরকে, লেখককে! অথচ কী উচিত ছিল? উচিত ছিল — হুমায়ূনের মৃত্যুর পর, শাওনের পাশে দাঁড়ানো। এই কাজটাই ছিল স্বাভাবিক/প্রগতির। তা কী আর হয়? হয়েছে সবসময়? কোনোসময়? বাস্তব তার উল্টোটা ছিল, তাই না? আমাকে তো এক সাংবাদিক পারলে আক্রমণই করে বসেন — তিনি নিশ্চিত, হুমায়ূনকে মেরেছেন শাওন! আমি বলেছিলাম, তাও যদি সত্য হয়, আপনার এত লাগছে কেন? এই-লাগাটা আর কিছুই নয় — নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ফর্ম বদলায়, পুরুষতন্ত্র বদলায় না।
এমনকী আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বরাও শাওনের প্রতি যে-আচরণ প্রদর্শন করেছিলেন সেটা মারাত্মকভাবে পুরুষতান্ত্রিক ছিল। সেসব ঘনঘটা অবশ্য আমাদের মানুষ চিনতে সহায়তা করে। আরেকটু নিকটে যেয়ে। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমাদের নারী-বিষয়ক ধারণাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের টিভিচ্যানেলের সিরিয়ালগুলো। তাই, নারীরাও এখানে নারীর বিপক্ষে দাঁড়ায়। যেমন শীলা বা অন্যরা দাঁড়িয়েছিল শাওনের বিপক্ষে, মোটেই হুমায়ুনের বিপক্ষে নয়।
আপনি বলবেন প্রগতি কী? প্রগতি হলো মানুষের প্রকৃতির পক্ষে ঘটনার সমন্বয়সাধন। প্রেমে পড়া, সম্পর্কে জড়ানো অবশ্যই মানবিক বিষয়।স্বাভাবিক বিষয়। মানুষের প্রকৃতিরই অংশ। সেটার সমন্বয়সাধন আমি আপনি কবে কীভাবে করেছি? মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত পছন্দকে নিয়ে আমরা যে খিস্তিখেউড় করি এটা আসলে সমাজের অভ্যন্তরীণ তন্ত্রেরই প্রতিফলন। ওই যে, এ-কারণেই, একটু আগে যা উল্লেখ করলাম — ভারতীয় পণ্যসিরিয়ালগুলোর ব্যাপক চাহিদা উপমহাদেশে। এর বাইরে যারা আছেন বলে মনে করেন, দাবি করেন — তারা যে কতটা আছেন , তা বোঝা যায় সমাজে জটিল আর আমরা-যা-প্রত্যাশা-করি-না সেরকম কিছু ঘটে গেলে। হোক না তা ‘প্রেসিপিটাস ম্যারেজ’, ওটা তো ব্যক্তির চয়েস। আগে করেছিলেন বাবা, এখন করেছে মেয়ে — তা নয়। আগের মেয়েটাও কোনো বাবা-মার মেয়ে ছিলেন, আর এখনকার বাবাটাও কোনো ছেলে-মেয়ের বাবা! শুধু দৃষ্টির পক্ষপাতের পার্থক্য। কিন্তু, তা তো নয়, তা হবে না — আপনি ফেসবুকের স্ট্যাটাস-কমেন্টগুলো পড়েন, এবং সেখানে নিশ্চয়ই আপনারা অনেকেই ইতিমধ্যে আপনাদের গালাগালি শুরুও করে দিয়েছেন। নিজেকে চেনানোর এ-সুযোগ হাতছড়া কেন করবেন, বলেন?
যা-ই হোক, এটাও ঝড় তুলবে। তুলেছে। যাবে আরও কয়েকদিন। নিশ্চিত জেনে রাখুন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না — না সাধারণের, না শীলার, না তার ভাইবোন না তার বাবা-কাকার। আগেরটার দোষ পড়েছিল শাওনের ওপর। এখন, সম্ভবত, আরো বিভক্ত অ্যাটিচুড দেখা যাবে — যারা আসিফ নজরুল পছন্দ করেন তারা এখন খুশিই হবেন মনে হয়, আবার বিপক্ষ গ্রুপ গালিগালাজ করবে আসিফ নজরুলকে। এভাবেই আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চাকে ডিফাইন করি বাংলাদেশে। যখন যেভাবে সুবিধা হয়!
আর হ্যাঁ, এবং হ্যাঁ অবশ্যই, দোষ যাবে শীলার ওপরও। একটু পার্থক্য — কিন্তু একই দোষ, যে-দোষে শাওন অভিযুক্ত হয়েছিলেন! হ্যাঁ, এতটা তিক্ত হবে না। তবু, এতসব বায়োস্কোপের মধ্যেও যার কোনো মুক্তি নেই, তার নাম ‘নারী’; আলোচনার কেন্দ্রেই থাকবে নারী, নারীর মুক্তি নেই — মেয়ে, বউ, মা — যা-ই হোক। তার কোনো ‘নিজস্ব ঘর’ থাকতে নেই। বঙ্গদেশে কার্যতই সতিত্ব শব্দটির কোনো পুংলিঙ্গ নেই।
রচনাকাল / ২৬ ডিসেম্বর ২০১৩
COMMENTS