নিশ্চিহ্ন পাখি নির্বংশ গাছ

নিশ্চিহ্ন পাখি নির্বংশ গাছ

গাছ না-থাকলে পাখি থাকে না জানতাম, পাখি না-থাকলে গাছ থাকে না জানতাম না। জানলাম একটা বই পড়ে। বেশ আগে পড়া বই, বছর-অনেক আগে, আমার সহকর্মী সত্যজিৎ চক্রবর্ত্তীর দূতিয়ালিতে। এই ভূমণ্ডলের হেন কোনো জন্তুজানোয়ার-কীটপতঙ্গ-তরুলতা নাই যা সত্যজিতের অবিদিত। সত্যজিতের এই জানাশোনা, আমি খেয়াল করে দেখেছি, জেন্যুয়িন ফ্যাসিনেশন থেকে উদ্ভূত ও সঞ্চালিত। সচরাচর লোকে তার চারপাশ চমকাবার অভিসন্ধি থেকে একটাকিছু জেনে চারপাশের আলোবাতাস আবিল করে তোলে সেই জ্ঞান যত্রতত্র ছিটিয়ে। এইটা আমি ছোট-সত্যজিতে দেখি নাই, বড়-সত্যজিতে ছিল/আছে কি না আমি জানি না। ভালো কোনো চলচ্চিত্রামোদী এ-বিষয়ে বলতে পারবেন। তো, কথা এখানে গাছ আর পাখির সম্পর্ক বিষয়ে। সেইসূত্রে এসেছে বইয়ের প্রসঙ্গ, বই পড়তে দিসিলেন যিনি তিনিও এলেন কথাবার্তার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। সত্যকীর্তন নয় এ-লেখা, এটি সম্পর্ককীর্তন।

একটি বিহঙ্গ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলে একটি বিশেষ জাতের গাছের বংশবৃদ্ধি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। সেই পাখিটির নাম জানতাম, পাখিটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও থোড়াসা জানতাম ছোটবেলা থেকে কবিতা পড়ে বখে গিয়েছিলাম বলে, কিন্তু গাছটির বিষয়ে বিলকুল জানতাম না বা এতদপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তার কিছুই বিলকুল জানতাম না। পাখির নাম ডোডো, সকলেই জানেন, গাছের নাম কালভেরিয়া মেজর। দুনিয়ায় কেবল মরিশাস দ্বীপে এই গাছ গুটিকতক রয়েছে। যে-কয়টা আছে, তাদের প্রত্যেকেরই বহোৎ উমর, একেবারে কম করে হলেও তিনশো বছরের জইফ বুজুর্গ গাছ তারা। আর এর চেয়ে কম বয়সের এ-প্রজাতিপরিবারের কোনো গাছ ভুবনে নাই।

জীববিজ্ঞানী ও উদ্ভিদতাত্ত্বিকেরা বিস্তর খুঁজে বের করেছেন কিছু গোমর। বহু বহু কাল আগে এই দ্বীপে ডোডো বলে একপ্রকার পাখি বাস করত। স্বভাবে খুব সাদাসিধা পাখি। নামে পাখি হলেও ডোডো উড়তে জানত না। তা, এমন উড়তে-অপারগ পাখি তো আরও আছে যেমন অস্ট্রিচ বা উটপাখি। কিংবা আমরা, মানুষ নামধেয় উড়াজাহাজেরা। যা-হোক, একসময় এই পাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে, কেন ও কোন কোন কারণে তা-ও অনুমেয় সকলেরই। ডারউইনের অন দি অরিজিন অফ স্পেসিজ-এর মোটাদাগের কথাগুলো তো আমরা জানিই, কিংবা তাঁর দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল  তো অল্পবিস্তর পড়েছি সকলেই। ইভোল্যুশন বাই ন্যাচারাল সিলেকশন  সংক্রান্ত যুক্তিতর্কগুলা জানে না এমন কোনো বাঙালির সাক্ষাৎ আমি আজও লভি নাই।

কিন্তু তর্ক করে বেফায়দা সময় খুন না-করি বরং, কথা বলি ডোডোপাখিহীন বাস্তবতায় ডোডোপাখি নিয়া। জানা যাচ্ছে, ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মরিশাস দ্বীপ পুরোপুরি ডোডোশূন্য হয়ে পড়ে। যদিও ওই হিসাব বের করার গ্রাউন্ড সম্পর্কে বইটিতে কিছুই নেই, আমারও প্রশ্ন জেগেছিল এ নিয়ে, বইটাও আজ আর হাতের কাছে নাই। না-থাকুক, কথা চালাই স্মৃতিডিজেলের শক্তিতে। এই কাজে আমাদের জুড়ি মেলা ভার, বাংলা সাহিত্যের আলাভোলা মাস্টার তার স্মৃতিযন্ত্রে ফেলে এমনকি অমীমাংসিত গাণিতিক সমীকরণও লহমায় মিলিয়ে ফেলতে পারে! কিছুই অসম্ভব নয়, বেঙ্গলির পক্ষে।

যাকগে, যা বলছিলাম। হ্যাঁ। নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে ডোডো, অল্প যে-কয়েকটা বাঁচতে পারত হয়তো, নির্বিচারে মেরে খেয়ে ফেলে মানুষ। মানুষ খুব উন্নত ও রোম্যান্টিক জাতি, নারীদেরকে সম্মান করে, এবং পাখিখেকো। অপ্রাসঙ্গিক, অতএব, টার্নিং লই। পৃথিবী থেকে একটা পাখি চিরতরে তার প্রজাতি সহ নিশ্চিহ্ন হয়া যাবে আর আমি প্রকৃতিস্থ ও প্রাসঙ্গিক থাকব, আপনারা ভাবলেন কী করে! এইবার এই প্যারার পরের প্যারায় চুম্বক কথাগুলো বলতে চলেছি, আপনারা আমার সঙ্গে থাকুন, তালিয়া বাজাবেন না প্লিজ! ওতে আমার কর্ণকুহরে সুড়সুড়ি লাগে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঠিক যে-সময়ে ডোডোপাখি মরিশাস দ্বীপ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল সে-সময় থেকেই কালভেরিয়া মেজর  নামের গাছটিরও নতুন কোনো চারা গজানো বন্ধ হয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ঘেঁটেঘুঁটে যেইটা জানতে পারলেন তা হলো এ-ই যে, কালভেরিয়া মেজর  গাছটির বীজের উপরিভাগ — উদ্ভিদবিদ্যায় পেরিকার্প  বলে যে-অংশটাকে — অত্যন্ত শক্ত এবং একমাত্র ডোডোপাখিরাই সেটি ভেঙে ফেলতে পারত ও গাছটির বংশবিস্তারে সহায়তা করত। ডোডো নাই, অতএব, কালভেরিয়া মেজর  ক্রমশ নির্বংশ হয়ে গেল। মরিশাস দ্বীপে গেলেই এখন কেবল গুটিকয় গাছ পরিদৃষ্ট হয় যাদের আর বীজ হয় না বা অন্য কোনোভাবে এদের পুনর্জন্ম শতচেষ্টাতেও বিজ্ঞানীরা সম্ভব করে তুলতে পারেন নাই। ‘প্রকৃতির ভারসাম্য’ ও ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রভৃতি ব্যাপার বোঝার ক্ষেত্রে এ এক প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।

তো, সম্পর্কের সমীকরণ এতদিন যা জানতাম — এখনো-নাম-অনুক্ত বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত — তা ছিল সীমিত জানা। জানতাম যে, গাছ না-থাকলে পাখি থাকবে না। আজ আমি জানি, পাখি না-থাকলে গাছ ও সমগ্র নিসর্গের বিকাশ বন্ধ হয়ে যাবে। এ-ও জানলাম যে, সম্পর্কের বিক্রিয়া আদৌ একমুখী নয়, সম্পর্ক সবসময় উভমুখী। পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে ছিলাম, মানে আমার তরুণ দিনগুলোর কথা বলছি, একটা গান খুব প্রিয় ছিল আমার। সেইসময় অনেক অনেক জাতবিজাতের গানের পাশাপাশি মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গান-এরও ভক্ত ছিলাম আমি ও আমার জেনারেশনের অনেকেই। এখনও আছি, আমি, বলা বাহুল্য। গৌতম চ্যাটার্জীর সেই দুর্ধর্ষ দলের একটা গানে এমন সম্পর্কের উভমুখী বিক্রিয়ার প্রমাণজ্ঞাপক নজির পেয়েছিলাম। গানের একটি জায়গা, যা রিফ্রেইন হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে পুরা গানে, এমন : “মহাচিন্তায় আছি বন্ধু রে / আমি চলে গেলে কী করে রবে / বন্ধু রে…”; ভেবে দেখুন, সবসময় আমরা শুনে অভ্যস্ত ‘তুমি নাই, তো আমি নাই’ … ‘তুমি ছাইড়া গেলে আমি মইরা যামু’ … ইত্যাদি প্রথানত পঙক্তিগীতি। কিন্তু আমি না-থাকলে তোমারে কে দেখবে … কার লগে এত মারামারি-কাটাকাটি করবা তুমি … কার বুকে হুল ফুটাবা … কার গলায় চুম্মা খায়া পিঠে বসাবা ছুরি … কার আর বারোটা বাজাবা আমি না-থাকি যদি … প্রিয়মানুষ নিয়া এইভাবে দুশ্চিন্তা বাংলাগানে এর আগে ছিল বলে আমার জানা নাই। হিন্দুস্তানি মৃগিব্যারামের মার্গীয় সংগীতে থাকলেও থাকতে পারে (ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়া হাসাহাসি সম্পূর্ণ নিষেধ, খবরদার!), সে-যা-হোক, এখানে গানের বিষয়ে বাগবিস্তার না-করি আর।

বইটার নাম জঙ্গলের ডায়েরি, লেখকের নাম কল্যাণ চক্রবর্তী, প্রকাশক ইন্ডিয়ার আনন্দ পাবলিশার্স। প্রকাশকাল ইয়াদ নাই। শুধু মনে পড়তেসে, বইটি ছিল সুদৃশ্য পেপারব্যাক। তুলনামূলক সস্তাও। বইটি সম্পর্কে অনেক বেশি জানেন ও জানাতে পারতেন বইটির লেখক স্বয়ং অথবা বইটির মালিক সত্যজিৎ চক্রবর্ত্তী ওর্ফে সত্যজিৎ রাজন ওর্ফে জিৎ রাজন।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

এই লেখকের অন্যান্য রচনা 

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you