বাংলার শেষ কবিয়াল এবং একটি কবিতার ইতিবৃত্ত || সরোজ মোস্তফা

বাংলার শেষ কবিয়াল এবং একটি কবিতার ইতিবৃত্ত || সরোজ মোস্তফা

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ বিক্ষিপ্তভাবে বাংলার প্রাচীন কবি ও কবিয়ালদের লুপ্তপ্রায় জীবনবৃত্তান্ত ও অপ্রকাশিত রচনা সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি যদি ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর পাতায় বাংলার নির্জন এই কবিয়ালদের স্থান না দিতেন, তাহলে কালের গর্ভে হারিয়ে যেত প্রাকৃতজনের কবি ও সাধুদের নাম। অক্ষরের পৃষ্ঠাতে লিখেও কী মানুষের নাম, কর্ম ও জীবনযাপনকে টিকিয়ে রাখা যায়! মনে হয় যায় না। গোঁজলা গুঁই, ‘লালু-নন্দলাল’, ‘রামজি’, ‘রঘু’, ‘কেষ্টামুচ’, ‘হর ঠাকুর’,  ‘রাসু’, ‘নৃসিংহ’, ‘নিত্যানন্দদাস বৈরাগী’, ‘রাম বসু’, ভোলা ময়রা’, ‘নীল ঠাকুর’, ‘রামপ্রসাদ সেন’, ‘রামনিধি গুপ্ত’, ‘লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস’ — এইসব নাম হয়তো বাংলার ভাঁটফুলের মতো ঝরে যেত। কিন্তু কবিজীবনীতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখায় কবিওয়ালাদের শিষ্যপরম্পরায় একটা ইতিহাস তিনি লিখেছেন।

কবিয়াল মদন সরকারের জীবনীভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা লিখেছেন কবি মাহবুব কবির। কবিতাটিতে শুধু একজন কবিয়ালের জীবনবৃত্তান্তই উঠে আসেনি; একজন কবিয়ালের জীবনের লড়াইটা দেখাতে দেখাতে কবি স্পষ্ট করেছেন শেষ হয়ে এসেছে আসরের কবি এবং কবিগানের ধারা। মাহবুব কবির বলেন,  ‘বাংলার শেষ কবিয়াল মদন সরকার কুঁজো হতে হতে চাকা হয়ে গেছেন’। কেন বলেন? শুধু কী মদন সরকারের বয়সটাই চিত্রায়িত হয়েছে এই পঙক্তিতে? না-কি  ‘বাংলার শেষ কবিয়াল’ বলে কবিগানের সমাপ্তির কথাই ইঙ্গিত করেছেন? পূর্ববাংলার গ্রামে গ্রামে যে কবিগানের সমৃদ্ধি সেই কবিগানের শেষ পুরুষ কবিয়াল মদন সরকারের বয়স, দেহকাঠামো, জীবনজীবিকা, বেঁচে থাকার লড়াই তুলে ধরে কবি মূলত লুপ্তপ্রায় কবিয়াল সম্প্রদায়ের প্রতি দরদ ও অভিজ্ঞানই প্রকাশ করেছেন। কী সেই অভিজ্ঞান! এই কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কবি মাহবুব কবির বলেন :

“কবি, গীতিকার, গায়ক বিপ্লব চক্রবর্তী আমার শৈশব-বন্ধু। বাংলা স্টেশন সংলগ্ন ওর বাড়ি। দুপুর-রোদ মাথায় নিয়ে একদিন বন্ধুর খোঁজে বাংলায় গেছি। বাংলা স্টেশন সংলগ্ন তালগাছের ছায়ায় ছোট্ট বাজার। বাজারের মধ্য দিয়ে রেললাইন অতিক্রম করে গ্রামের পথ। রেললাইন পার হচ্ছি; দেখি, কবির আশি পেরোনো গোলাকার শরীরটা রোদে চিকচিক করছে। পিঠ বাঁকিয়ে, মাথাটা হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে কবি ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে হারিকেনের ছিদ্র তলা সারিয়ে দিচ্ছেন; ছোট্ট-সরু একটা বাটালিতে পিতলের থালাবাটিতে নাম খোদাই করে দিচ্ছেন। একটাকা, দু-টাকা কিংবা আধুলির ভাংতি পয়সা পকেটে রেখে দিচ্ছেন। দেখে খুব মায়া হল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। রেললাইনের একপাশে দাঁড়িয়ে কবিতাটি লিখেছিলাম। জীবনের বাস্তবতায় একজন কবিয়াল অক্ষর খোদাই করছেন; হারিকেন কিংবা ডেকচির তলার ছিদ্র সারিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু নিজের জীবনের ছিদ্র সারাতে পারছেন না। কবিয়ালের অভাবে কিংবা কবির আসর না থাকায় নিজের জীবনের সাধনাটা আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। পরম্পরাছাড়া সাধক ও সাধনা কেউ বাঁচেন না। খুব মায়া হল, কষ্ট লাগলো। কবিয়াল বেঁচে আছেন ভিন্ন জীবিকায়। জানি, কাছে গিয়ে কবিতা শুনতে চাইলে তিনি কিছু টপ্পা শুনাবেন। কিন্তু এভাবে কী একজন কবিয়াল বাঁচেন! কবিয়ালের জন্য চাই আসর, চাই যোগ্য সঙ্গী’।* [টীকা দ্রষ্টব্য, রচনাশেষে — লেখক]

এই কথাটা আবারও প্রমাণিত হলো সময় ও সমাজ না-চাইলে যে-কোনো শিল্পই মরে যায়। মানুষ এবং সমাজের বাইরে শিল্পের কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই। আমাদের গাঁয়ের বাজারে একসময় চৈত্রমাসে বারুণীর মেলা বসতো। একসময় কী উত্তেজনাই-না ছিল বারুণী মেলার! চিনি ও গুড়ের তৈরি হাতি-ঘোড়া, জিলিপি ভাজা, কুড়মুড় ভাজার কী আকর্ষণই ছিল সেই সময়! কিন্তু সব আকর্ষণই ম্লান করে দেয় সময়। সময়ের আগ্রাসন এবং সস্তা আভিজাত্য অনেক অগ্রসরমান, শক্তিমান মনন ও সংস্কৃতিকেও গিলে খায়। গিলে খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকতে হলে চলমান সবকিছুকে নিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হয়।

নেত্রকোণার বাজারে বাজারে, সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবারে, তালুকদারবাড়িতে, জমিদারের কাচারি বাড়িতে, ধানকাটা শেষে উন্মুক্ত প্রান্তরে কবিগানের আসর বসতো। এইসব তর্কগানের ভেতর দিয়ে সমৃদ্ধ হতো মানুষের মন ও মনন। একটা টেলিভিশনবাকশের কাছে কিংবা মার্ক জাকারবার্গের ফেইসবুকের দুনিয়ায় মদন সরকাররা হারিয়ে যাবেন। বৃহৎ দুনিয়ার কাছে হারিয়ে গেছে বাংলার কবিগানের ছোট দুনিয়া। কবি মাহবুব কবির বলছেন : “তার কাছে নিচু এলাকার নিচু ঘরদোরের মানুষজন আসে। / জংধরা প্রায়-বাতিল কুপিবাতি, হারিকেন, মগ,  লেটার অসুখ সারাতে আসে তারা। / মদন সরকার হারিকেনে পানি ভরে / খালি চোখেই নিশ্চিত হচ্ছেন।  /  কোথায় ছিদ্র, ফুটো। / ছিদ্রের ওপর সিসা বসিয়ে টুকটুক করে / হাতুড়ি পেটাচ্ছেন তিনি, / নিচু মানুষের নিচু ঘরদোরের অন্ধতা সারাচ্ছেন।”

কবিতায় মাহবুব কবির যাদের ‘নিচু ঘরদোরের মানুষজন’ বলছেন, তারাই বাংলার প্রাকৃতজন। এই প্রাকৃতজনের সংস্কৃতিকেই ধারণ করেছিলেন মদন মোহন আচার্য। কবিয়ালদের মানুষ ‘সরকার’ সম্বোধন করেন। তাই তিনি মদন সরকার। তিনি যে-গানের চর্চা করতেন, সেই কবিগানের মাধ্যমে এই প্রান্তিক জনের অন্ধতা দূর হতো। কবিগানের মতো তর্কগানের মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলার সাধারণের মনন তৈরি হতো। কবিগান শুনতে শুনতে ‘নিচু মানুষের নিচু ঘরদোরের অন্ধতা’ অর্থাৎ সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতা ভুলে প্রত্যেকেই মানুষ হয়ে উঠতেন। রাম-রহিম পরিচয় থেকে ‘মানুষ’ পরিচয়কেই বড় করে দেখতেন। বাড়ির উঠানে, আসরে-আসরে বাংলার কবিগান এবং বাংলার কবিয়ালরা গানে গানে সম্প্রদায়গত এই ভেদাভেদ ভুলিয়ে মানুষ এবং মানবজন্মের সার্থকতাকেই বড় করে প্রকাশ করতেন। কবিয়াল মদন সরকার পূর্ববাংলার আসরগানের শেষ সমৃদ্ধ পুরুষ। কবিজীবনীতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যে দায়িত্ব পালন করেছেন, ‘ফুলচাষি মালি যাই বলো’ কাব্যগ্রন্থে একজন কবিয়ালের প্রতি মাহবুব কবির সেই দায়িত্বই পালন করেছেন।

মাহবুব কবিরের ‘ফুলচাষি মালি যাই বলো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি তুলে দিচ্ছি —

ম দ ন  স র কা র
বাংলার শেষ কবিয়াল মদন সরকার কুঁজো হতে হতে
চাকা হয়ে গেছেন।

এখন তিনি কারো মুখ দেখতে পান না —
শুধু পা দেখেন আর মাটি দেখেন,
মাটিকে দিগন্ত ভেবে ভ্রম করেন।
ডাক পেলে এ-বয়সেও মাইল মাইল।
গড়িয়ে গিয়ে মঞ্চে ওঠেন, আসর মাতান।

এখন বাংলা স্টেশনে রেললাইনের পাশে
ঠাডা রোদের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছেন মদন সরকার।
তার অসমর্থ হাতে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ হাতুড়ি।
তার কাছে নিচু এলাকার নিচু ঘরদোরের মানুষজন আসে।
জংধরা প্রায়-বাতিল কুপিবাতি, হারিকেন, মগ,
লেটার অসুখ সারাতে আসে তারা।
মদন সরকার হারিকেনে পানি ভরে
খালি চোখেই নিশ্চিত হচ্ছেন।
কোথায় ছিদ্র, ফুটো।
ছিদ্রের ওপর সিসা বসিয়ে টুকটুক করে
হাতুড়ি পেটাচ্ছেন তিনি,
নিচু মানুষের নিচু ঘরদোরের অন্ধতা সারাচ্ছেন।


টীকা — কবিয়াল ‘মদন সরকার’ নিয়ে কবি মাহবুব কবির যে-কবিতাটি লিখেছেন এই কবিতাটি কবির ‘ফুলচাষি মালি যাই বলো’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট জানতে চাইলে কবি উদ্ধৃত কথাগুলো বলেছেন।


প্রাসঙ্গিক আরেকটা লেখা
কবিয়াল মদন সরকার ও বাংলার কবিগান

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you