পৃথিবীতে কোনো মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। কিন্তু কিছু মানুষ ইতিহাসে অমর হয়ে যুগের পর যুগ কালের পর কাল তাদের কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। মানুষের কর্মই তাকে অমরত্ব দান করতে পারে। যেমন বাউলগুরু লালন সাঁইজি, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ তাদের কর্ম, তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। ইতিহাসের এই-সকল কালজয়ী মহাপুরুষদের অধিকাংশই মৃত। আজ আপনাদের সামনে এক জীবন্ত কালজয়ীর কথা লিখতে চাচ্ছি, যিনি এখনো জীবিত। এখন প্রশ্ন হলো, ইনি কে? বাংলা লোকসসংগীতকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন, লোকসংগীতের শিরায় শিরায় যাদের সৃষ্টি মিশে আছে, যাদের রচনা ও গায়কিতে জমে উঠত আসর, তাদের মধ্যে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি হলেন বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন (Kari Amir Uddin)। বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ বাউলদের মধ্যে তিনি প্রধানস্থানীয়। তার লেখা গান করেননি এই-রকম বাউলগানের শিল্পী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কমবেশি প্রত্যেক বাঙালিই তার রচিত গান শুনেছেন। তবে অনেকেই জানে না এই গানগুলোর রচয়িতা সেই মরমী জীবিত বাউলকবি ক্বারী আমির উদ্দিন। বর্তমান বাংলাদেশের নবপ্রজন্মের চাইতে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের কাছে তিনি অধিক জনপ্রিয় বা পরিচিত। কারণটা হলো, দীর্ঘ সময় থেকে আমাদের কাছে না-বলা কোনো অভিমানে প্রবাসেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতেছেন এই বাউল সাধক। যদি উনি দেশে থাকতেন তাহলে তাঁর শিষ্য-ভক্তদের অভাব হতো না। শতশত ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান কখন বাউল দেশে আসবেন, আর তাঁর শিষ্যত্ব তথা গুরুর দর্শন লাভ করে তারা ধন্য হবে। জানি না ভক্তদের সেই আশা কোনোদিন পূর্ণ হবে কি না। যদিও বাউল দেশে বসবাস করতেছেন না তারপরও ভুলে যাননি দেশ ও দেশের মানুষকে। এখনো এই মরমী কবি অনবরত লিখে যাচ্ছেন গান। শতশত দেশী-বিদেশী শ্রোতাদেরকে কণ্ঠের জাদু দিয়ে আকৃষ্ট করতেছেন। উনার লিখিত গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক। বলতে গেলে বাউলকবিদের মধ্যে সর্বাধিক গানের লেখক ক্বারী আমির উদ্দিন।
এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামে। পিতার নাম শাহ মুহাম্মদ রুস্তম আলী শেখ, মাতার নাম আলিফজান বিবি। ক্বারী সাহেবের লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের আলমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীকালে ইসলামিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে বেশ-কতকগুলো মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু কোনো স্থানেই মন স্থির করতে পারেননি। অবশেষে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা ও সৎপুর কামিল মাদ্রাসায় কিছুকাল লেখাপড়া করেন। এই সময় দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী হতে “ক্বারীয়ানা” পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং তখন থেকেই নামের শুরুতে “ক্বারী” টাইটেল যুক্ত হয়। দেশে থাকাকালীন তিনি ক্বারী আমির উদ্দিন নামেই পরিচিত ছিলেন। তখন তাঁর নামের সঙ্গে বাউল, ক্বারী, সাধক ইত্যাদি যুক্ত ছিল না। বরং সকলের প্রিয় ক্বারীসাব নামেই মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন। পীর ও মুর্শিদ ক্বারী আমীর উদ্দিন সাহেব বাইয়্যাত গ্রহণ করেন সিলসিলায়ে ফুলতলীর অন্যতম কামিল পীর মরহুম শাহ মুহাম্মদ আনাছ আলী (র)-এর নিকট। তিনিই ছিলেন ক্বারীসাহেবের মুর্শিদ বা গুরু। ক্বারীসাহেবের পিতামাতাপ্রদত্ত নাম ছিল রওশন আলী। অধিকাংশ জীবনীকারদের মতে ‘আমীর উদ্দিন’ উনার মুর্শিদপ্রদত্ত নাম। কেউ কেউ বলেন তাঁর আসল নাম ছিল মো. আমিরুল ইসলাম। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ লোকদের মুখে এখনো প্রচলিত আছে, আমির উদ্দিন নামটি প্রদান করেছিলেন বাউলসাধক দুর্বিন শাহ। আল্লাহই ভালো জানেন প্রকৃত সত্য কি।
ক্বারীসাহেবের পূর্বসুরীরা ফকিরি ধারার লোক ছিলেন, তাই তার রক্তের সাথে ফকিরি টান বংশগত বলা যায়। পিতামাতা উভয়ই ছিলেন সংগীত-অনুরাগী। দশ বছর বয়স থেকেই পিতার অনুপ্রেরণায় গান গাওয়া শুরু। তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, কোনো গান একবার শ্রবণ করলেই মস্তিষ্কে গেঁথে যেতল; সেটা আর ভুলতেন না। তাছাড়া শৈশব থেকেই এই সাধকের বিশেষ দক্ষতা ছিল দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানোর। যেমন বাঁশি, কাসি, ঢোল, একতারা, বেহালা, হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি খুবই সুন্দরভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। আনুমানিক ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি পূর্ণভাবে সংগীতের সাথে যুক্ত হয়ে যান।
শুরুর দিকে তিনি নিজে গান রচনা করতেন না। গানের প্রতি ভালোবাসার টানে অন্য মরমীদের গান গাইতেন। সিলেটের অনেক মরমী কবির গান করেছেন ক্বারী আমির উদ্দিন; যেমন সৈয়দ শাহনুর, রাধারমণ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ, ইব্রাহীম তশনা, কামাল উদ্দিন, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম সহ তাঁর পূর্বসুরীদের অনেকেরই। ধীরে ধীরে তাঁর শ্রোতাসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। দুর্বিন শাহের আখড়া ক্বারীসাহেবের এলাকার কাছে হওয়ায় সেখানে যাতায়াত বেশি ছিল। সেই সময় জীবিত বাউলকবিদের মধ্যে দুর্বিন শাহের জনপ্রিয়তা ছিল অনেক উর্ধ্বে। তাঁর রচনা ছিল জ্ঞানগর্ভ। ক্বারীসাহেবের জীবনে নিজের রচিত গান ব্যতীত অন্য লোককবিদের মধ্যে দুর্বিন শাহের গান সবচাইতে বেশি গেয়েছেন। দুর্বিন শাহের গান করেই প্রথমদিকে আলোচনায় আসেন ক্বারীসাহেব। ক্বারীসাহেবের ছিল অসাধারণ মেধাশক্তি। অনেকেই তাঁর জীবনে সৌভাগ্যের নিয়ামক হলেও এটা সত্য যে ক্বারীসাহেব এই পর্যায়ে এসেছেন তাঁর মেধা, শ্রম, সাধনার বিনিময়ে। তাঁর সৌভাগ্যের নিয়ামক হিসাবে দুইজন ব্যক্তির নাম প্রকাশ না-করলে ইতিহাসে আমি দায়বদ্ধ হয়ে থাকব, তাই তাদের নাম প্রকাশ করতেছি; যা দেখে হয়তো ক্বারীসাহেবের নবীন ভক্তরা রাগ করতে পারেন; কিন্তু অতীত স্বীকার করলে সম্মান কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। যেমন শাহ আব্দুল করিম নিজের গরিবি অবস্থা, নিজে রাখাল ছিলেন সেই কথা অনায়াসে প্রকাশ করতেন। তাই বলে শাহ আব্দুল করিম আমাদের কাছে অপ্রিয় হননি বরং বাউলসম্রাটরূপে হৃদয়ে মিশে আছেন।
ক্বারীসাহেবের জীবনে দুই সৌভাগ্যনিয়ামক হলেন বাউল সাধক দুর্বিন শাহ ও তুরন মিয়া সাহেব। ক্বারীসাহেব বেশিরভাগ আসরে দুর্বিন শাহের গান করতেন। সিলেট অঞ্চলের অনেক মানুষ জানত বা বিশ্বাস করত ক্বারীসাহেব দুর্বিন শাহের সন্তান। যদিও ঘটনাটি সত্য নয়। কিন্তু ক্বারীসাহেবের রচনা, শব্দচয়ন, গভীর অর্থবোধক শব্দপ্রয়োগ ইত্যাদিতে দুর্বিন শাহের প্রভাব ছিল। হয়তো এইজন্য মানুষ মনে করত তিনি দুর্বিন শাহের ছেলে। তাছাড়া ক্বারীসাহেবের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় দুর্বিন শাহের মৃত্যুর পর। অথ্যাৎ দুর্বিন শাহের অভাব তাকে দিয়েই পূরণ হয়। তাই দুর্বিন শাহ ছিলেন ক্বারীসাহেবের জন্য সৌভাগ্যের এক নিয়ামক। দ্বিতীয় যে-ব্যক্তির নাম বললাম তিনি বাউল, গীতিকার কিংবা শিল্পী নন কিন্তু বাউলজগতের এক অভিভাবক ছিলেন। ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পিছনে জনাব তুরন মিয়া সাহেবের ভূমিকা অনেক। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ক্যাসেটনির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্বারীসাহেবকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। কারো কারো মতে ইহা ছিল তাঁর বাণিজ্যিক কাজের অংশ। যদি এটা মেনে নেই তারপরও তুরন মিয়া সাহেবের ভূমিকাকে তুচ্ছ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তুরন মিয়া ক্বারীসাহেবের প্রচার-প্রসারের জন্য ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। তিনি কেবল ক্বারীসাহেবকে নয় বরং সিলেটের বাউলজগতের জন্য অনেক করেছেন। অনেক শিল্পীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল। কিছু লোকের প্রত্যক্ষ অবদান থাকলেও মূলত মালজোড়া গান, কিচ্ছা গান, সুললিত কণ্ঠ, রচনাশৈলী ইত্যাদি গুণে তাঁর জনপ্রিয়তা শূন্য থেকে শীর্ষে নিয়ে যায়।
একটি ঘটনা মনে পড়ল, তো বলি। ঘটনাটি তখনকার যখন ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবের এত জনপ্রিয়তা হয়নি। একদিন ক্বারীসাহেব বাসস্টেশনের পাশে বসে বেহালা বাজিয়ে গান করতেছিলেন এমন সময় ওই স্থানের নিকটে সিলেটের লোকগানের প্রবাদপুরুষ বিদিত লাল দাস ছিলেন। তিনিও গান শুনতেছিলেন। জাদুময় কণ্ঠ। তখন তুরন মিয়া সাহেব বিদিত লাল দাসকে বললেন, দাদা এই ছেলেটার নাম আমির উদ্দিন, খুব ভালো গান করে, আপনি তো দেশ-বিদেশে অনেক প্রোগ্রাম করেন, যদি সুযোগ হয় তাহলে তাকেও প্রোগ্রাম দিয়েন। এই প্রথম বিদিত লাল দাসের সাথে ক্বারীসাহেবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্বারীসাহেব সিলেট এলেই বিদিত লাল দাসের বাসায় যেতেন। সেই সময় বিদিত লাল দাসের একটি গানের দল ছিল যেখানে সিলেটের মহান গুণীজনরা যেমন পণ্ডিত রাসবিহারী চক্রবর্তী, পণ্ডিত রামকানাই দাশ, গীতিকবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ, আকরামুল ইসলাম, সুবীর নন্দী, হিমাংশু গোস্বামী, হিমাংশু বিশ্বাস, আরতি ধর, ইয়ারুন্নেসা খানম সহ অনেকেই ছিলেন। ধীরে ধীরে ক্বারীসাহেবের সাথে তাদেরও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এমনকি রাগসংগীতের ব্যাপারটি ক্বারীসাহেব আয়ত্ত করেন পণ্ডিত রামকানাই দাশের রেওয়াজ দেখে দেখে।
সুরস্রষ্টা বিদিত লাল দাস ক্বারীসাহেবের প্রসংশা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “একজন শুকনো মানুষ, বয়স কম কিন্তু এত প্রতিভার মিশ্রণ ছিল যা বলে শেষ করার মতো না। একবার আমির উদ্দিন সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিলাম দাওয়াতে। সেখানে গিয়ে দেখি একটি আলমারি পুরোপুরি ভর্তি আজ থেকে ১০০-২০০ বছর পূর্বের বইপুস্তকে। তিনি এইগুলো সংগ্রহ কি করে করলেন তা ভেবে আমি অবাক হই। বলতে গেলে সিলেটের সকল পুরাতন বইয়ের ভাণ্ডার তার কাছে ছিল। তাঁর উপস্থিত গানরচনার প্রতিভা দেখে অবাক হতে হয়।”
ক্বারীসাহেবকে মানুষের মনের গভীরে স্থান করিয়ে দেয় মালজোড়া গান, যেটাকে সিলেটের বাইরে কবিগান বলা হয়। ক্বারীসাহেব আস্তে আস্তে মালজোড়া গানের দিকে নিজেকে ঝুঁকিয়ে দেন। মালজোড়া গানে ক্বারী আমির উদ্দিনের মতো বিচক্ষণ বাউল পূর্বেও ছিলেন না আর কখনো আসবে বলেও মনে হয় না। মালজোড়া গানের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক হলেন ক্বারীসাহেব। তিনি সর্বপ্রথম বাউল মফিজ আলী নামের এক বাউলশিল্পীর সাথে মালজোড়া গান করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে তৎকালীন সকল বর্ষীয়ান বাউলদের সাথে মালজোড়া গান করেন। তাঁর জীবনে তিনি কোনো মালজোড়া গানে হেরে যাননি, তবে পতিপক্ষের বারোটা বাজিয়েছেন কথার মারপ্যাঁচে। উপস্থিত গানরচনার গুণ ক্বারীসাহেবের খুব প্রবল ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই গান রচনা করতে পারতেন।
ক্বারীসাহেব অসংখ্য বিখ্যাত বাউলের সাহচর্য পেয়েছেন। একই আসরে একসাথে গান করেছেন অনেক মরমী মহাজনের সাথে; যেমন বাউল কামাল উদ্দিন, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, জ্ঞানের সাগর দুর্বিন শাহ, বাউল মান উল্লাহ, বাউল মিরাজ আলী, বাউল শফিকুন্নুর, বাউল আবেদ আলী, বাউল কফিল উদ্দীন, বাউল আব্দুল হামিদ, বাউল ছাবুল মিয়া, রজ্জব দেওয়ান ,খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, আব্দুর রহমান বয়াতি প্রমুখের সঙ্গে।
প্রবাদ আছে ‘সাগর জানে না যে তার কত জল’। সেইরূপ ক্বারীসাহেব নিজেই বলতে পারবেন না উনার জীবনে কত গান গেয়েছেন কত গান রচনা করেছেন। এখন নিজের লেখা ও সুর-করা গান গেয়ে অন্যদের লেখা গান গাইতে সময় পান না। ধারণা করা হয় ক্বারীসাহেব এ-পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন। বর্তমানে ‘আমিরি সংগীত’ নামে কয়েক খণ্ডে তাঁর রচিত গান নিয়ে বই প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি বাউলকবিদের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ গানের রচয়িতা যার সৃষ্টি এখনো পাণ্ডুলিপি এবং বইয়ে বর্তমান আছে। তারঁ রচিত উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো :
(১) লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে / না গো না চাঁদ নয় আমার বন্ধু এসেছে।
(২) হেলায় হেলায় মনের আনন্দে দিন ফুরাইল সই।
(৩) আমি তোমার সেবা করমু আমার ঘরে আইলে / বড় লজ্জা পাইমু রে বন্ধু তোমারে না পাইলে।
(৪) হেলায় হেলায় কার্য নষ্ট রে।
(৫) আমার প্রতি ভালোবাসা থাকে যদি মনে / কদমতলায় দেখা দিয়ো বন্ধু কেউ যেন না জানে।
(৬) তোমারে দেখিবার মনে চায় / দেখা দেও আমায়।
(৭) মন কাড়িয়া নিলো গো প্রাণ কাড়িয়া নিলো সখি, খালি আমার দেহপিঞ্জিরা।
(৮) আমারে খুঁজিয়া দেখি আমি নাই / মিছামিছি আমার আমার, করছি যা রঙ্গের বড়াই।
(৯) সোনারও যৌবন গেল রে বিফল / আমি কাঁদি অবলা / কোকিলা দিস না রে জ্বালা।
(১০) কে এমন চাঁদরূপসী / জাদুভরা মুখের হাসি ।
(১১) মায়া লাগাইয়া রে বন্ধু এত লাঞ্চনা জানলে আগে নবযৌবন সপে দিতাম না।
(১২) বন্ধু তুমি আমার জানের জান / তুমি আমার প্রাণের প্রাণ / হৃদয়ে থাকো আমার হৃদ আকাশের চান।
(১৩) যদি ভালোবাসো না, কাছেও আসো না, দেখেও দেখো না, / কোনোদিন আমি তোমারে বন্ধু বাসিব না ভিন।
(১৪) শাহজালালের পুণ্যভূমির নাম জালালশরিফ, আমার আল্লাজির তারিফ।
(১৫) শিখাইয়া পিরিতি করিল ডাকাতি / ভুলিয়া রইয়াছে আমায় / সখি কি করি উপায় …
(১৬) আগে ভক্তির চুলা বানাও, সবুরের হাঁড়ি বসাও / ভাবের লাকড়িতে জ্বালাও প্রেমেরই চিতা / স্বার্থবাদী প্রেম করে যায় না কভু জিতা।
(১৭) জগতস্বামী নিজেরে প্রকাশ করিবার তরে / অপূর্ব কৌশলে করেন মানুষ তৈয়ারি / এই মানুষে মানুষে কেন মারামারি।
(১৮) বন্ধুর দেশের পাখিরে ও তুই বল আমারে আমার বন্ধু কেমন আছে।
(১৮) বাংলা আমার মায়ের ভাষা বাংলা আমার মাজননী।
(১৯) আমানতের খেয়ানত হইব রে, ও ভাই কেয়ামতের আলামত আইব রে।
(২০) বন্ধুর আশায় আর কতদিন থাকি প্রাণসখি গো ফিরে নি আর আসবে হৃদয়পাখি।
(২১) নৌকা বানাইয়া দিলো সুজন মেস্তরী ময়ুরপঙ্কি নায়ে রে আপন কান্ডারী।
(২২) সৃষ্টিতে যার সকল প্রাণের দাবি সেজন আমার নবি
(২৩) ইসলামেরই চেরাগ তৌহিদি দেমাগ আশিকে রাসুলুল্লাহ আল্লাহর ওলি
(২৪) হাছা কথায় শরম করে, মিছা মাতলে আরাম পাই / কি জাতের মুছল্লি আমি কইয়া যাই।
(২৫) সাধ করে তোর নামের মালা পরেছি আমার গলে / আমি যে তুই বন্ধুর পাগল দেখতা সকলে।
(২৬) কবর দেখলে চমকিয়া উঠি, ভয় জাগে মোর মনে / একা থাকব কোন পরানে।
(২৭) তোরা কেউ দেখছো নি বন্ধুয়ারে।
(২৮) বন্ধু যাইয়ো না রে বন্ধু যাইয়ো না রে / থাকো রে আমার হৃদয়বাসরে থাকো রে প্রাণবন্ধু যাইয়ো না।
(২৯) নিষ্ঠুর বন্ধু রে কোন পরানে তুমি রইলা বৈদেশে।
(৩০) বন্ধুয়ারে বিফলে সজ্জা সাজাইলাম।
বাউল আসলে কারা, এই নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যেই মতপার্থক্য আছে। ক্বারীসাহেবের অনেক ভক্তরা তাকে বাউলসম্রাট বলে থাকেন। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, বর্তমান সময়ে জীবিত লোককবির মধ্যে বাউলগানে কেউ বাউলসম্রাট হওয়ার যোগ্যতা রাখলে তিনি কেবলই ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেব। যেমনভাবে বাংলার ইতিহাসে বহু সম্রাটের নাম পাওয়া যায় ঠিক তেমনিভাবে বাংলার লোকগানে একাধিক সম্রাট থাকাটা অযৌক্তিক নয়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, লালন সাঁই তার যুগের জন্য বাউলসম্রাট ছিলেন, শাহ আব্দুল করিম তাঁর যুগে, এবং বর্তমান যুগে জীবিত বাউলদের মধ্যে ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবকে বাউলসম্রাট বলাটা অঠিক নয়। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম আমাদের গর্ব। তিনি জীবিত থাকাকালীন তিনিই বাউলসম্রাট ছিলেন, আর বর্তমানে ক্বারীসাহেবকে এই পদবী দেয়া যৌক্তিক।
ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেব লোকসংগীতপ্রেমীদের কাছে অনুপ্রেরণীয় আদর্শরূপে গণ্য হয়ে থাকেন। তাঁর রচনা মানুষের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে। তাঁর অনুপ্রেরণায় আজ অনেকেই বিখ্যাত গীতিকার হয়েছেন; যেমন প্রয়াত পল্লিকবি রমিজ আলী, গীতিকার সৈয়দ দুলাল সহ অসংখ্য গুণীজন। তাঁর ছাত্রসংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। লন্ডনে বসবাসরত অনেক শিল্পী, গীতিকার সরাসরি আমির উদ্দিন সাহেবের শিষ্য। বাংলাদেশে এখনো শতশত মানুষ অপেক্ষায় কোনদিন ক্বারীসাহেব দেশে আসবেন আর তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে জীবন ধন্য হবে। জানি না সেই আশা তাদের পূরণ হবে কি না। তবে যেখানেই ক্বারীসাহেব থাকুন তার প্রতি বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের ভালোবাসা চিরন্তন থাকবে।
বলতে গেলে তাঁর গান গেয়েছেন দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব গায়কগায়িকারা। যেমন পবন দাস বাউল, গনি সরকার, আরিফ দেওয়ান, ফকির শাহাবুদ্দিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মমতাজ বেগম, বেবী নাজমীন, আসিফ আকবর, শাহনাজ বেলী, কায়া, আশিক, রিন্টু সহ অনেকেই।
বাউলসাধকরা পদ-পদবির লোভে কাজ করেন না। বরং তাঁরা গানের প্রতি ভালোবাসার টানেই গান রচনা করেন, গেয়ে থাকেন। কারণ গান তাদের প্রাণরক্ষার মহৌষধের মতো। সত্যিকারের বাউল যারা তারা প্রচারবিমুখ হয়। কে তাদের মূল্যায়ন করল কে তাদের বিরোধিতা করল সেটা চিন্তার সময় তাদের নেই। কারণ ছয় রিপুর ভেদ ভেঙেই তারা এই পর্যায়ে এসেছেন। তারা দেশ ও জাতিকে অনেক দিয়েছেন। তাই আমাদেরও উচিত তাদের ন্যূনতম সম্মানটুকু দেয়া। ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেব যদি দেশে আসেন তাহলে তাঁর গান শোনার জন্য কত লক্ষ লোকের জনসমাগম ঘটবে তা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু এই যে বললাম প্রচারবিমুখ মানুষ। জীবনের শুরুর দিকে প্রচার পাওয়ার যে আগ্রহ ছিল আজ যেন সেই আগ্রহ আর নেই ক্বারীসাহেবের। আর এটাই সাধনার ফসল। জাতি হিসাবে রাষ্ট্র এবং আমাদের দায় আছে তাদের কাছে। তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু না দিতে পারলে আমরা ব্যর্থ জাতি বলে চিহ্নিত হব। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবকে কোনো পদক বা সম্মান দেয়া হয়নি। এই রকম জীবন্ত গুণী মরমীকে যদি একুশে পদক না দেয়া হয় তাহলে একুশে পদক বলতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপাত্রেই অর্পণ করা হচ্ছে। আমি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করতেছি। অচিরেই এই জীবন্ত কিংবদন্তি বাউলকে যেন একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তাহলে কিছুটা হলেও জাতি হিশেবে আমাদের দায়মুক্তি ঘটবে।
বেঁচে থাকাকালীন গুণীজনদের সম্মান বা প্রাপ্য মূল্যায়ন করতে বারবার আমরা ব্যর্থ হই। যারা দেশ ও জাতিকে অনেককিছু দিয়েছে তাদের দেশ ও জাতি কি দিলো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন গুণীজনদের মৃত্যুর খবর যে-কোনো মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে গিয়ে পৌঁছে তখন সরকারের দ্বায়িত্বশীলরা একটি শোকবার্তা অথবা ফুলের তোড়া কফিনে দিয়ে, কাঁদো কাঁদো চেহারায় মাইকে বলে থাকেন ওনার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এই কথার মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র দায়মুক্তি লাভ করে। কিন্তু জীবিত থাকাকালীন রাষ্ট্র তাদের অধিকাংশের ন্যূনতম খোঁজখবরটাও রাখে না। অধিকাংশ পদক দেয়া হয় রাজনীতি বিবেচনা করে, কর্ম দেখে নয়। প্রকৃত গুণীজনরা অবহেলিত ছিলেন, আছেন, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জার, পুরো জাতির জন্য লজ্জার। আমরা ভিনদেশী গুণীজনদের না চিনেই তাঁর আদর্শ গ্রহণ করি, তাকে নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে কতকিছু বলি, লিখি; অথচ আমাদের ঘরের নিকটে জন্ম-নেয়া গুণীজনদের খবর আমরা রাখি না। মনে রাখবেন লালন সাঁই, হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিম, ক্বারী আমির উদ্দিন পৃথিবীতে একবারই আসেন, এবং দ্বিতীয় কারো পক্ষে তাদের সম হওয়া কখনই সম্ভব না। তাই আমরা যেন তাদের আদর্শ ,তাদের চিন্তা, তাদের চেতনা মূল্যায়ন করতে পারি। তাদের রেখে-যাওয়া সৃষ্টিগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি। জয় হোক মানবতার, জয় হোক বাউলদের। আমি এই গুণী বাউলকবি ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
- ভোটের গান রচনায় শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী - December 29, 2018
- লোকগানে সিলেটের নারী কিংবদন্তিরা || আজিমুল রাজা চৌধুরী - December 12, 2018
- অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় বাউল আবদুর রহমান : প্রসঙ্গ শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী - October 16, 2018
COMMENTS