কাজীসাহেব! || সোহেল হাসান

কাজীসাহেব! || সোহেল হাসান

মানুষের অনেক ধরনের দুঃখ থাকে। কচুপাতার উপর টলমলে পানি গড়িয়ে পড়ে গেলে দুঃখ লাগতে পারে। সকালের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলে মনটা ভারী হতে পারে কিংবা বৃষ্টির দিনে কিশোরদলের মাঠে খেলার দৃশ্য শৈশবের স্মৃতি টেনে এনে মনকে বিষণ্ণ করতে পারে। এমনই এক অদ্ভুত দুঃখ আমার মনকে ছেয়ে দিয়েছিল যেদিন আমার নবম শ্রেণি পড়ুয়া ভাগ্নী জাতীয় কবির জীবনী বলতে পারেনি।

সমাজটা খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আমার শৈশব এবং কৈশোরে আমার শিক্ষকদের এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোর বাসায় সবসময় কবিগুরু এবং বিদ্রোহী কবির ছবি টানানো থাকতে দেখতাম দেয়ালে। সেই সময় এবং ঐতিহ্য এখন মৃত্যুমুখী। এখন এডুকেশনকে এজুকেশান বলতে পারলে কিংবা দুই-চারটা ইংরেজি গানের লাইন ভুলভাল উচ্চারণে গাইতে পারা মানে জাতে উঠে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ছাড়া কী বাঙালি হওয়া সম্ভব?

মুসলমানদের কিছু টাকাপয়সা হলে তারা সাহেব হয় এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের টাকাপয়সা হলে হয় বাবু। আমাদের দুখু মিয়ার টাকাপয়সা হলে কলকাতার সুধী সমাজ তাকে কাজীসাহেব নাম দিলেও তিনি নিজেকে কখনো সাহেব ভাবেননি। অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহী স্বাধীনতাকামী বাঙালি সংস্কৃতির বরপুত্র আমাদের জাতীয় কবি। বেঁচে থাকতে ফতোয়ার জ্বালাতনে অস্থির কবি নির্বাচনে হেরেছেন খুব কম ভোট পেয়ে। শ্যামাসংগীত এবং ইসলামি গজল লিখেছেন এবং কামাল পাশার মতো কবিতা লিখে গেছেন তা নিয়ে এখন কোনো আলোচনা নেই।

প্রতিক্রিয়াশীল চক্র খুব করে চেষ্টা করে তাকে ইসলামিক কবি কিংবা ধর্মের খাদেম রূপে প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ধর্মজীবী দাঁতালদের পূর্বপুরুষরা কবিকে বলেছে কাফের। হুলিয়া জারি করেছে কিংবা বর্জনের ডাক দিয়েছে। সরদার বল্লভভাই প্যাটেল হয়তো বেঁচে থাকতে কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি যে সাম্প্রদায়িক বর্বর বিজেপিনেতারা তাকে তাদের রাজনীতির স্বার্থে সাইনবোর্ড বানাবে বা বানাতে চাইবে। ঠিক তেমনি শিশুসাহিত্যে অনন্য, দেশপ্রেমে অনুকরণীয়, অসাধারণ শ্যামাসংগীত এবং ইসলামি গজলের স্রষ্টা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিসচেতন নজরুলও হয়তো কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেননি তার সকল অর্জন আর শ্যামাসংগীত বাদ দিয়ে কেবলমাত্র তার ইসলামি গজল নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র একদিন রাজনীতি করবে, ওয়াজ করবে, ঘৃণা ছড়াবে।

আমি সামগ্রিক নজরুলকে ভালোবাসি। তার জীবনযাপন, সুরবাঁধা, গানলেখা, কবিতা কিংবা ঝাকড়া চুল সবকিছুকে আমি ভালোবাসি। মাত্র চল্লিশ বছরে কীভাবে সম্ভব এত সৃষ্টি, এত প্রখর দর্শনের জন্ম দেওয়া!

আসলেই নজরুল মানে বিস্ময়। নজরুল মানে সৃষ্টিকর্তার অসাধারণ সৃষ্টি। যে-মানুষ রুটি বেলার কাজ করার পরেও কিংবা যাযাবর পথিক হয়ে কিংবা সৈনিকের জীবন ধারণ করার পরেও লিখতে পারেন — “আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর! আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তার কাঁকন চুড়ির কন-কন। … মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না — বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত।”

তাকে জানতে না-পারলে, শ্রদ্ধা জানাতে না-পারলে এ বাঙালি জাতীয়তাবাদ  এবং জীবনকে কী সার্থক বলা যাবে?


সোহেল হাসান, কবি ও গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক, খুলনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা, চাকরিসূত্রে নিবাস সিলেটে


কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কিত অন্যান্য রচনা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you