কুমার চক্রবর্তী : চরৈবেতি, চরৈবেতি || আহমদ মিনহাজ

কুমার চক্রবর্তী : চরৈবেতি, চরৈবেতি || আহমদ মিনহাজ

ভাবুকতার জটিল শিহরণ পাঠক টের পায় কুমার চক্রবর্তীর কবিতায়। নব্বইয়ের প্রথম দশ বছর তিনি আশি না নব্বইয়ের কবি এ-নিয়ে মতভেদ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সেটি স্তিমিত হয়ে এসেছে। মানব-অস্তিত্বের আত্মিক সারার্থ অবধানে নিমগ্ন কবিগণের কাতারে তাঁর নাম প্রীতিকর অনুভূতির জন্ম দিয়ে যায়। চেতনপ্রবাহের অতল থেকে উঠে আসা স্মৃতিকাতর বিষাদ জলমর্মর হয়ে বাজে কবির কবিতায়। বস্তুলিপ্ত জীবনের পরিকাঠামো ছাপিয়ে যাওয়া অনুষঙ্গে ডুবসাঁতারু সত্তার আত্মমুক্তির কিনারা খুঁজে না পাওয়ার চাপা হতাশা ও ক্ষরণ সেখানে নীরব অশ্রুপাত ঘটায়। অস্তিত্বের মৌল উদ্ভাস নিয়ে জিজ্ঞাসার হাজার প্রহেলিকা ব্যক্তিচৈতন্যে অহরহ জাগে ও ঘুম যায়,— এইসব জিজ্ঞাসার সংকেতঘন ব্যঞ্জনা কুমার চক্রবর্তীর কবিতার অর্থস্তরকে ভাবুকতায় গাঢ় ও সময়-প্রাসঙ্গিক রাখে। অস্তিত্ব যাপনের মৌন সংগীতকে ঘিরে বিবাদরত ভাবনায় নিজেকে পরখ করার বাসনা কবির মধ্যে প্রবল। যারপরনাই তাঁর কবিতায় সেইসব অনুষঙ্গের দেখা মিলে যারা হয়তো মন্ময় চৈতন্যের ফসল এবং কবিসত্তাকে মাননিক ভাবনায় দ্রবীভূত করতে সমর্থ :—

কখনো কখনো হলুদ বনের ভেতর আমি এক সাদা কাঠের গুঁড়ি। কুঠারের ধ্বনিগুলো আমাকে শাসন করে দীর্ঘকাল। অদ্ভুত নির্জনতার ভেতরে আমি পড়ে থাকি, গায়ে জমে আছে মন্ত্রকুশল শ্যাওলা। যখন রাত বাড়ে, আমি গড়াই, শ্যাওলারা চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়। আমি গড়িয়ে পাথরের চাঁইয়ের ওপর পড়ি আর রক্তাক্ত হই। এইভাবে মনোজগতের রহস্য বেড়ে গেল। ব্যথারা পাহাড় হলো। এইভাবে জীবনের গভীরতর কৃষ্ণগহ্বরেরও জন্ম হলো।
(স্যানাটোরিয়াম)
*
ফুটিফাটা রৌদ্রের ভেতর, ছায়াবিছানো কোনো বৃক্ষের ভেতর,
প্রতারণার কোনো অন্ধকার মৌচাকের ভেতর, অথবা ধরো অরণ্যের বৈঠকখানায়
জড়ো হওয়া যাবতীয় স্টিললাইফ রহস্যের ভেতর
জমানো জীবনগুলোকে যখন পেরিয়ে যাই তখন প্রশ্ন আসে—
ফুল না শেকড়, কে অধিক গুরুত্বপূর্ণ!
(আমি কোথাও নেই)
*
‘মনে রেখ, মৃত্যুই নিয়তি,’ দিয়োনিসুস,
শীতকাল জুড়ে জমা হওয়া মদ শেষ হলে
মনে রেখ, যা তোমাকে ঘিরে রাখে—
তার অর্ধেক বিস্ময় আর বাকিটা নৈঃশব্দ্য…
(মেমেন্তো মোউরি)
*
চোখ দিয়ে যা কিছু দেখেছ তা দৃষ্টিগত, ত্বক দিয়ে যা কিছুই ছুঁয়েছ তা স্পর্শগত। চিন্তা ও অনুশীলনের মাঝখানে যা ছিল-সব ধ্বনিগত সমগ্রতাবোধ; দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রুর মাঝখানে যা ছিল সবই হারাকিরি বিস্ময়বোধ। যেখানে মানবিক কেন্দ্রের মুখে তুমি, সেখানেই অবসাদ ও সমর্পণের অনুসন্ধিৎসায় ভরপুর হয়ে ওঠে জীবন সরল ফুলপাখির রীতিমুগ্ধতায়।
(লিথোগ্রাফ)

কুমার চক্রবর্তীর মননবিশ্বের প্রতি অঙ্গে জড়ানো বাকপ্রতিমা জড়বস্তু দিয়ে বিরচিত অস্তিত্বের বিরামহীন অবক্ষয় ও বিকাশের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে সত্তার সারার্থ নিয়ে ভাবে। যত অনুষঙ্গের আন্তর সমাবেশ ও বিচ্ছেদ অস্তিত্বের অনুপলকে প্রতিনিয়ত গড়েভাঙে তার সূচনা ও অন্তের কিনারা সম্ভব নয় বুঝে কবি হয়তো সোনালি মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকেন! মধ্যবিন্দুতে দণ্ডায়মান কবিসত্তা দোদুল্যমান এক পেন্ডুলাম বটে! তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয়,— জড়বস্তুর সমাবেশ থেকে সৃষ্ট প্রাণবান অস্তিত্বের সত্তায় পরিণত হওয়ার সুনির্দিষ্ট ক্ষণ ও যাত্রাবিন্দু রয়েছে এবং অবক্ষয় ঘটার পর যথাবিহিত স্থানকালে তারা গমন করে ইত্যাদি। কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় মধ্যবিন্দু যারপরনাই অস্তিত্বের প্রহেলিকায় পাঠককে ভেসে থাকতে বাধ্য করে, আবার অন্যদিক থেকে অনুমানসিদ্ধ সিদ্ধান্তের ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসার জন্য সহায় হয় :—

অজানার উদ্দেশে এখানে রয়েছে এক মন্দির যেখানে প্রার্থনা করে পাখিরা। ছায়ার পৃথিবী এ কথাই প্রমাণ করে যে মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে বিরাজ করছে এক টলোমলো ঐক্য, সুতরাং প্রথম কাজ হলো যা কিছু অস্তিত্বময়, তার ক্ষণভঙ্গুরত্বকে প্রতিষ্ঠা করা।…

মনে রেখ, অস্তিত্বহীন আমি চর্চা করি অস্তিত্ববিদ্যার, যা তোমাদের অসোয়াস্তিতে ফেলে। আমার ভুলগুলো হলো আমার বিম্ব ও প্রতিবিম্ব, আর শুদ্ধগুলো হলো তোমার স্নায়ুসন্ধির সৌন্দর্য।

আরও মনে রেখ, যা অসীম তার কোনো অস্তিত্ব থাকে না।
(অধিবিদ্যা)
*
মনে করো তোমার জীবন ডুবোজাহাজের লগবই। বৃত্তান্ত আছে কিন্তু ধারণা নেই, ভ্রমণ আছে কিন্তু মাইলেজ নেই।

আমিও একদিন ডুবোজাহাজের সংকেত হব, একটু উঁচু করে রাখব মহাকালের পেরিস্কোপ। সন্ধিপত্রহীন এই জীবন, শুধু ভ্রমণে ভরে আছে নেপথ্যের আর-সব ডাকপাখির যাওয়া-আসা।
(হারানো ফোনোগ্রাফের গান)
*
সবকিছুই কাছাকাছি, মাটি আর মানুষের মতো — শুধু আলাদা হয়ে গেছে তাদের ভাষা
চাঁদ খুব নিচু দিয়ে হাঁটছিল রাংতা পায়ে
হাওয়া একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
মাটির নৈকট্যে চলে আসি আমরা
বুঝতে চেষ্টা করি স্থিরতার কথাবার্তা

তারা কথা বলছে বিলম্বিত লয়ে
আরও যেন বলতে চাইছে, ‘বরফের শকটে চড়ে আমাদের বর্ণমালাহীন দেশে চলে আসো।’
(মৃতরা)

নব্বই-পরবর্তী যুগবিশ্বে ভাববাদী ও জড়বাদী চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত এইসব পঙক্তিতে মর্মরিত ভাবসংকেত ইতিহাস (history) ও ঐতিহাসিক (historic) শব্দে নিহিত বিরোধকে যেন মূর্ত করে যায়! বিলয় ও সৃষ্টির বিরামহীন গতির ভিতর দিয়ে জড় উপাদানের অস্তিত্ব হয়ে ওঠার ঘটনাটি হলো ইতিহাস; অন্যদিকে অনুমান নির্ভর যুক্তি ও ব্যাখ্যা-ব্যাখ্যান সহকারে ইতিহাসে সংঘটিত ঘটনাকে সুনির্দিষ্ট ভাষা ও প্রামাণিক চরিত্র দানের অনুশীলন তাকে ঐতিহাসিক করে তোলে। এখন সত্তার অস্তিত্ব গ্রহণকে কবি যদি ঐতিহাসিক ঘটনা ভাবেন সেক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা সেইসব পঙক্তিতে বিরাম নিতে বাধ্য যেখানে সমগ্র বিশ্বের গতি ও পরিণাম অনুমানের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকলেও একপ্রকার নির্ধারিত। প্রাণবিশ্ব নিয়ে মানুষের ভাবনা ও অনুসন্ধান মূলত রকমারি ঐতিহাসিক নির্ধারণের নকশায় দূরাতীত কাল থেকে বাঁধাই হয়ে আসছে। ঐতিহাসিকের ওপর দাঁড়িয়ে সেকাল থেকে একাল অবধি মানুষ তার সত্তার সারার্থকে অনুভব ও সেখানে বিশ্বাস স্থাপনের কর্মে বহাল রয়েছে। পক্ষান্তরে ইতিহাস হচ্ছে চরৈবতির উপমান এবং এখানে বিচরণশীল মানুষ তথা সামগ্রিক প্রাণবিশ্বের সত্তায় পরিণতি লাভের ঘটনাটি স্বয়ংক্রিয়। অস্তিত্বের ইতিহাসে পুষ্প কেন ফোটে বা কে তাকে ফুটতে বাধ্য করে সে-ব্যাখ্যাটি বিশেষ দামি নয়। পুষ্প ফোটে এবং ঝরে পরে এবং পুনরায় ফোটে…সরল এই অভিজ্ঞান সত্তার গতিশীল ঘূর্ণিকে মহিমা দান করে এবং অস্তিত্বের স্বরূপ অবধানের জন্য তাকে যথেষ্ট মনে হয়। একালের কুমার চক্রবর্তী যখন কবিতায় সত্তা ও অস্তিত্বের নির্ণয় খোঁজেন তখন ইতিহাস ও ঐতিহাসিকে বিদ্যমান এইসব বিরোধাভাস উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না! কবির এই সংকট ‘ব্যক্তি আমি’-র পরিচয় বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে অসোয়াস্তি থেকে তাঁকে মুক্তি দিতেও ব্যর্থ হয়। প্রাণবিশ্বের স্রোতে তাঁর ভ্রমণ সংগত কারণে সোনালি মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে; জীবনকে ঘিরে বহমান অনুষঙ্গরা যেখানে ‘অর্ধেক বিস্ময় আর বাকিটা নৈঃশব্দ্য’ কিংবা ‘হারাকিরি বিস্ময়বোধ’-র অতিরিক্ত জীবনবেদে নিজেকে আবিষ্কার করার পথ পায় না।

কবিতার শর্ত মেনে সত্তার অস্তিত্ব যাপনের সংকটকে ভাষাঅঙ্গে ফলবান করে তোলার কুশলতা কুমার চক্রবর্তীকে যুগ-প্রাসঙ্গিক রাখে তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর কবিতার অর্থস্তর পাঠককে সেই পরিসরে গমনের সুযোগ করে দেয় যেখান থেকে কবিতা নিজে চিন্তনপদ্ধতি হয়ে ওঠে ও তাত্তি¡ক বাহাসের খোরাক যোগায়। পাঠক-হৃদয়ে রসমাধুর্য ও সংবেদঘন সাংগীতিক অনুভব বহানোর কাজে দোষ না ঘটিয়ে কবিতাকে মন্ময় ভাবনা ও চিন্তাশ্রয়ী বাহাসের বিষয় করে তোলা সহজ নয়। এই ধারায় সেইসব কবি সচরাচর গমন করেন যারা জায়মান পরিপার্শ্বে অস্তিত্বের সংগীত শ্রবণের পর এমন লোকে উত্তীর্ণ হতে ব্যাকুল থাকেন যেটি হয়তো বাস্তবে বিরাজিত নয়, তথাপি কবির মনোবিশ্বে ধ্রæবসত্য রূপে সেই জগৎ তরঙ্গ বহায়। সংগতকারণে লোক থেকে লোকোত্তরে কবির নিষ্ক্রমণ এক পরাবিশ্বকে তালাশ করে এবং এর বিশ্বস্ত বিবরণ কবির মনোবিশ্বে জায়মান সাংকেতিক শব্দের নিরন্তর প্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়! উইলিয়াম ব্ল্যাক এভাবে ‘উরিজেন’-র কাহানি ফেঁদে পরাবিশ্ব সৃষ্টি করেন, যেটি বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরকে পরিহাস ও স্থানান্তরিত করার লক্ষ্যে খেটে মরে। হোল্ডারলিন সত্তার উৎস ও পরিণতি নিয়ে ভাবিত হওয়ার জেরে ঐতিহাসিক ভাষাচিহ্ন অতিক্রম করে ইতিহাসের বৃত্তে প্রবেশ করেন। কবির এই ইতিহাসবৃত্তে সত্তার সূচনা ও অন্ত বলে কিছু থাকে না; তবে অনাদি কাল ধরে অনস্তিত্বে বিলীন হলেও সত্তা সেখানে বারংবার অস্তিত্বে আগমন ও সেখান থেকে নির্গমনের স্বয়ংক্রিয় চক্রে বাঁধা থাকে। জড়বস্তুর সমাবেশে বিরচিত বিশ্বের অবিরত বিলীন হওয়া ও ফেরত আসার ইতিহাস কেবল সজ্ঞার অনুধ্যানে ডুব দিয়ে হয়তো উপলব্ধি করা সম্ভব! গৌতম বুদ্ধ যেমনটি করেছিলেন সেই সময়। সত্তার উৎস নিয়ে বিরচিত বাখানে হাইডেগার একে ঐতিহাসিক সত্য (historicity) বলে দাগিয়েছিলেন। হোল্ডারলিনের কবিতায় তিনি সেই জগৎ চমকাচ্ছে টের পেয়েছিলেন, যেটি তাঁর ভাষায় অনুমানসিদ্ধ যুক্তি ও ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের ভাষা দিয়ে বোনা ইতিহাসজ্ঞানকে বাতিল ও অবৈধ করে।

সত্তার অস্তিত্ব লাভের ইতিহাসকে হাইডেগার যুক্তি-বিরচিত-ইতিহাস (historiological) ও ঐতিহাসিক সত্য (historicity) দুইভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথমটি হলো যুক্তি ও অনুমানের অংক দিয়ে মাপা জগতের ইতিহাস; এর বহু সংস্করণ থাকতে পারে এবং থাকা স্বাভাবিক; যেমন বিগ ব্যাং, যেমন প্লেটোর ভাবজগৎ, যেমন কল্পকথায় বর্ণিত অণ্ড বা ডিম থেকে জগতের আবির্ভাব ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য অর্থাৎ বস্তুজগৎকে গড়ে তোলা মৌল উপাদানরাশির নিরাকার সদৃশ অরণ্যে বিহারের ইতিহাস। এর কোনো শুরু ও সমাপ্তি নেই; সচেতন অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে একে অনুমান করা সম্ভব হলেও বাস্তবে প্রমাণ করা অসম্ভব। ঐতিহাসিক সত্যে বিরাজিত সত্তা সমাপ্তিবিহীন শুরুর বৃত্তে নিজেকে সর্বদা গতিশীল রাখে। এই ইতিহাসের ছটা হোল্ডারলিনে পেয়ে তিনি চমকে উঠেছিলেন। কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে ব্ল্যাক বা হোল্ডারলিনের কাব্যঘরানার পার্থক্য রয়েছে। বঙ্গদেশের কবি যুক্তি-বিরচিত ইতিহাস ও ঐতিহাসিক কোনোটিতে দাঁড়িয়ে থাকেন না। যুক্তি-বিরচিত ইতিহাসকে অতিক্রম ও কল্পনা-প্রতিভার সাহায্যে হোল্ডারলিনের মতো নতুন ভাষাপৃথিবী নির্মাণে তাঁর মনের সায় নেই। তিনি এক স্বয়ংক্রিয় সংগীতে নিজেকে জুড়তে ইচ্ছুক। অস্তিত্বহীন নিরাকারে সত্তার অবক্ষয় অনিবার্য জেনেও জড়বস্তুর মিথস্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট ক্ষণভঙ্গুর এই অস্তিত্ব যেসব ইতিহাস অবিরাম জন্ম দিয়ে চলে সেটি তাঁর কাছে অস্তিত্বের সারার্থ হিসেবে দামি হয়ে ওঠে। সুতরাং ক্ষণভঙ্গুর অস্তিত্বের প্রতি পরতে বিজড়িত ঘটনার স্রোতে যত কাহিনির জন্ম সম্ভব করে তোলে সেগুলো পরিহার করে অসীম পারাবারে সমাধি ও নির্বাণের বন্দনা তাঁর কাছে আত্মঘাতের শামিল হয়ে ওঠে। কুমার চক্রবর্তীর কবিতারা সে-কারণে মেটাফিজিক্যাল (metaphysical) বা অধিবিদ্যক নয়, তারা হয়তো অধিবাস্তব (metareal); অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মিথস্ক্রিয়া থেকে জাত নিখিল জাগতিক বাস্তবতা, যেখানে অবিরত ‘হয়ে ওঠা’-র মধ্যে ‘জীবন সরল ফুলপাখির রীতিমুগ্ধতায়’ ইতিহাস সৃষ্টি করে যায়!

তাঁর কবিতার ভাষা-প্রকরণ চরৈবেতির অনুষঙ্গে নিজেকে খুঁজে ফেরে! জীবন ও মৃত্যুর কুহক বজায় থাকে বলে অস্তিত্ব এক জটিল অসুখ হলেও অবিরাম নানা রূপে জারি থাকায় স্বয়ংক্রিয় জীবনবেদের প্রতীক। অস্তিত্বের প্রবাহণ আসলে কেমন? এই জিজ্ঞাসা যে-ভাবুকতার জন্ম সম্ভব করে চতুর্মাত্রিক বিশ্বে সচল কুমার চক্রবর্তীর কবিতা সেই প্রবাহণকে উন্মদাবেশ আক্রান্ত জীবনের প্রতি তন্ত্রী ছুঁয়ে পরখ করে যায়। ‘কবি ও বৃষ্টিপাত’ কবিতার পঙ্ক্তিনিচয়ে স্বকীয়তাটি ধরা পড়ে :— ‘আমরা কবি কুলশীল / মাটির গভীরে কাব্যকলার চাষ করি / এন্টিনার মতো শিশ্ন জাগিয়ে রাখি / আর চিরন্তন চিরন্তন বলে / কী কাণ্ড / কুহকী ভাষার শরীর গড়ি।’ এইসব মিলেঝুলে কুমার চক্রবর্তীর কবিতার ভুবনে প্রবেশ না-করে পাঠকের উপায় থাকে না।

লোকে বলে রাইনার মারিয়া রিলকের কবিতায় গীতিময় চোরাটান পাঠককে আপনা থেকে কবির চেতনপ্রবাহে সঞ্চারিত হতে বাধ্য করে! এর কাছাকাছি একটি অভিজ্ঞতা বোধহয় বাংলাদেশের এই কবিকে পাঠ করতে যেয়ে ঘটে। তাঁকে পড়তে হয় না, বরং বলা ভালো অন্তর্লীন গীতিময়তায় জমাট পঙক্তিরা আপনা থেকে পাঠকের চেতনায় পঠিত হয়ে চলে।


নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: