লাক্সমি পূর্ণিমা

লাক্সমি পূর্ণিমা

ধবধবে দুধরাত্রি, নির্জল জ্যোৎস্নার, শাদা পূর্ণিমার। নরম, সফেদ, মসৃণ।

লক্ষ্মীপুজো। লক্ষ্মীপূর্ণিমা। প্রবারণা। আশ্বিনী পূর্ণিমাও বলে, এবং কোজাগরী।

কিন্তু সবই বিজ্ঞাপনী বিশেষণ দেখছি! কী সব … নরম, সফেদ, মসৃণ … এ কী তোমার প্যাডিকিওর-করা নোখসম্বলিত পদযুগলের মায়াবী ভিশ্যুয়ালওয়ালা হেয়ার-রিম্যুভিং ক্রিমের টিভিসি নাকি? মিঞা! ফাটকাবাজারী বিটকেলে পোস্টমোডার্নিস্ট কোথাকার! অবশ্য ‘পোস্ট’ প্রেফিক্সের স্থলে কেউ কেউ ‘পুটু’ ওয়ার্ড বসাইতে চায়, কে জানে, কেন যে! পুটুমোডার্নিস্ট — ওয়াট ডাজ ইট মিন, ড্যুড? খবর্দার! খামোশ! নোটক হইতে না-পারো নোটবইপ্রণেতা হইতে যেও না বাপু। প্রভাষকের সংখ্যা বাংলায় এত বেড়েছে যে এই বোধিনীবিজনেসে তুমি বিশেষ প্রোফিটমার্জিন রাখতে পারবা না।

শারদীয় দুর্গাপুজো উৎসবের হপ্তান্তে এই দিন উদযাপন করা হয়ে থাকে। এটি হিঁদু ধার্মিক-অধার্মিক নির্বিশেষের একদম ঘরোয়া আচারানুষ্ঠানের একটি হিশেবে পালিত হয়ে থাকে, দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। সেই থেকেই জানি যে দুর্গা বিসর্জনের অব্যবহিত বাদেই লক্ষ্মীরে বরণ করে নেয়া হয় গৃহে। লক্ষ্মী হলেন ধনদৌলত ও সমৃদ্ধিসুন্দরের দেবী। গৃহকর্মে শ্রী ফিরবে না লক্ষ্মী ঘরে না-রইলে। কাজেই লক্ষ্মী ইজ অ্যান ইম্পোর্ট্যান্ট গডেস্। লক্ষ্মী ইন-ফ্যাক্ট বছরভর বিরাজেন ঘরের কোণে কুলুঙ্গিতে। লক্ষ্মী বিহনে গেহ অন্ধকার। লক্ষ্মী গৃহাগমের দিন রাত্তিরবেলায় এমন জোচ্ছনা হয় মাইরি! জ্বি, কত্তা, জানি। অ্যাই, নারকোলগাছে কিডা রে? — দে চম্পট লেঙ্গুটি ছিঁড়েফেঁড়ে — ততক্ষণে তিন-তিনখানা নারকেলভারাতুরা গাছ সাফা। পাড়ার পোলাপানে এই দিন ফরাশি কী-এক কবির বইয়ের নামকরণ সার্থক করে তোলে — নরকে এক ঋতু। মধুচৌর্যবৃত্তির রজনী বটে। টেইকেন ফর গ্র্যান্টেড।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একই দিন প্রবারণা পূর্ণিমা। তাদিগের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব।

লক্ষ্মীর সঙ্গে টুসু বিগ্রহের মিল লক্ষণীয়। বিগ্রহগত মিল, বা বলা ভালো আচার-সংস্কারগত। টুসু সাঁওতালদের, সম্ভবত সাঁওতালদের, গৃহদেপ্তা। তা, এ নিয়ে তেমন শোনাজানা-আন্দাজ-আইডিয়া নাই বক্ষ্যমাণ নোটকের। শাস্ত্রজ্ঞ কোনো পণ্ডিতের দ্বারস্থ হতে হবে। আইজ্ঞা, দাদা, আপনে কি পণ্ডিত? আখাম্বা জ্ঞানের এক্সপ্লোরার? সংস্কৃতিক্রিটিক? নব্য তর্করত্ন গোসাঁই? খিলিপান খান, না সাঁচিপান? আপনের ফেসবুকে আইডি আছে? কয়টা লাইক অন অ্যান অ্যাভরেইজ? কোয়ান্টিটি অফ কমেন্টস্?

কোজাগরী নিয়া বাংলায় বেশকিছু গান তো রয়েছে, বেশ দুই-তিনটা কানে এসেছে আমাদেরও, মরমেও পশেছে বেশ দু-আধলাইন। পূর্ণিমা আর জ্যোছনা নিয়া গানের তো সংখ্যাসীমাশুমার নাই ফিল্মি বাংলায়-হিন্দিতে, আধুনিক বা স্বর্ণযুগীয় বঙ্গগানবাজনা তো জ্যোছনাচাঁদফুলের মনোপোলি প্রায়। অ্যানিওয়ে। একটা গান আছে মৌসুমী ভৌমিকের, ‘তুমিও চিল হও’ অ্যালবামে সম্ভবত, সরাসরি লক্ষ্মীপুজো-কোজাগরী নিয়ে একটা আনফর্গেটেবল গান। কলকাতার কন্টেক্সটে গানটা, আই রিকালেক্ট সো-ফার, গানটার ন্যারেশনে দেখা যায় যে একজন লক্ষ্মীর পটবিক্রেতা গ্রাম থেকে শহরে এসে এই সিজনে লক্ষ্মী বিক্রি করেন মাটিনির্মিত। মৌসুমী বলছেন যে এই বিক্রেতা তার হাতে-গড়া মাটির লক্ষ্মী বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে টাকা জমাচ্ছেন। ফলে এক লক্ষ্মী বিক্রি করে আরেক লক্ষ্মীর হিল্লে করার এই অক্সিমোরোন গানটাতে একটা সাংঘাতিক মোচড় ঘটায়। এইটা আজও ভুলি নাই। শারদীয় ছুটির আমেজ একসময় ট্রেনভ্রমণসুযোগ নিয়া আসত ঘরে ঘরে। এই গানটার পুরো পশ্চাদাবহ তৈয়ার হয়েছে ট্রেনের কুঝিকঝিক আর ঢাকের আওয়াজ দিয়ে। টেরিফিক ইট ওয়াজ!

এছাড়া আরও গান আছে বাংলা গানভাণ্ডারে কোজাগরী পূর্ণিমা উপজীব্য করে যেগুলো শ্রবণধন্য ও সুন্দর। একটা যেমন : “এই মোমজোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে / এসো না গল্প করি / দ্যাখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ সারারাত / আকাশে সলমা জরি” … ইত্যাদি। কিংবা পূর্ণিমা নিয়া গানের তো শুমার নাই বলা হয়েছে আগেই। কিন্তু বেশুমার সেইসব গানে পূর্ণিমা এসেছে প্রেমের পার্শ্বচর হিশেবে, এফডিসি গেইটের এক্সট্রা যেমন, বাংলা গানে পূর্ণিমা লিড রোল পেয়েছে রেয়ার্লি কালেভদ্রে। জেমসের একটা গানে এইটা দারুণ করেছে, গানটার টাইটেলই তো ‘পূর্ণিমানৃত্য’, লিরিক্ এই-রকম : “পূর্ণিমানৃত্য / হে সন্ধ্যা / শুভ সন্ধ্যা!”

একই জিনিশ, নানান বানান। তবু বানানের ফেরে রূপও বদলিয়া যায়। জ্যোৎস্না, জোছনা, জ্যোছনা, জোচ্ছনা, জোসনা, জ্যোস্না। ফারাক অর্থগত দিক থেকে কিচ্ছুটি নাই। দ্যোতনাগত দিক থেকে আছে কিছুটা-বা। ধ্বনিসাম্য সুরক্ষার গরজে একেক জায়গায় একেক বানান অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে বা দেয় বা দেবে। তোজাম্মেল হক বকুলের সিনেমায় “বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে / আসি আসি বলে জোসনা ফাঁকি দিয়েছে” এবং জেমসের “হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার / নাচে-গানে মন মাতিয়ে সবার / চারিদিকে দর্শক করে থৈ থৈ / নাচ দেখে গান শোনে করে হৈ চৈ / বেদের মেয়ে জোছনা … বেদের মেয়ে জোছনা” — একই মেয়ের দুই রূপ ও দুই ভিন্ন প্রসাধন অবধারিত। নয় কি?

জ্বি-অয়, আইচ্ছা, ইতা মাত তো বুজরাম। কিন্তুক লাক্সমি? এইনেরে তো হারাম ছিনরাম না। এইন কে বা? ‘লাক্সমি পূর্ণিমা’ বিয়াফারটা কিতা-বা সোনা? খাড়াও, থোড়া দম লও তে, খইরাম।

স্পেলিং ফ্রম টুমরো। লোল। এলওএল। লক্ষ্মী-ওলটপালট-লিট্রেচার। হালুম!

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you